Thank you for trying Sticky AMP!!

আত্মনিবেদিত জাতীয় বীর কাজী আরেফ

কাজী আরেফ আহমেদ (১৯৪২ -১৯৯৯)

একজন দেশপাগল ব্যতিক্রমী মানুষ, প্রকৃত জনকল্যাণে নিবেদিত এক মানবতাবাদী ও স্বদেশ সাধক ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। তিনি শুধু ছাত্রলীগের ছিলেন না, ছিলেন আপামর ছাত্রসমাজের অত্যন্ত এক জনপ্রিয় ছাত্রনেতা। ষাটের দশকে নন্দিত ছাত্রনেতাদের অন্যতম ছিলেন আরেফ। দলের সীমানা তাঁকে আটকাতে পারেনি, দলীয় নেতার পরিচয় ছাপিয়ে তিনি হয়ে ওঠেন ছাত্রসমাজের নেতা-গণছাত্র আন্দোলনের এক আস্থাভাজন ও আত্মনিবেদিত নেতা। তিনি হয়ে ওঠেন এমন একজন, যিনি নিজের নন, পরিবারের নন, শুধু দলের নন-তিনি হয়ে ওঠেন দেশের ও দশের একজন।

এরূপ স্বদেশিয়ানার ধারা দেখতে পাই পূর্বসূরি অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের জীবনসংগ্রাম থেকে। ব্রিটিশবিরোধী অখণ্ড ভারতবর্ষের স্বাধীনতার ডাকে, মাতৃভূমির শৃঙ্খলমুক্তির সাধনায় সেই দিনগুলোতে কিশোর-যুব জাগরণের যে বাঁধভাঙা জোয়ার প্লাবিত করেছিল, সেই স্বাধিকার ধারায় পুষ্ট হয়ে উঠেছিল কাজী আরেফের জীবনসাধনা। অগ্নিযুগে এই ধারাটি ছিল প্রধানত জাতীয় ধারা, যা পরবর্তীকালের সাম্প্রদায়িক বিভাজন মানব বিভক্তি, মানব বিতাড়নের নজিরবিহীন ট্র্যাজেডির বেদীমূলে ক্ষীয়মাণ ধারায় পরিণত হয়।

এই ক্ষয়িষ্ণু ধারা ধরে আরেফ আহমেদ তাঁর স্বল্পস্থায়ী অথচ বর্ণাঢ্য ও বহুমাত্রিক স্বদেশ ব্রতে আত্মনিয়োগ করেন। আক্ষরিক অর্থে আত্মবলিদান করেন স্বদেশ সাধনায়। প্রতিক্রিয়ার পাহারাদার সন্ত্রাসী গণশত্রু ঘাতকেরা তাঁকে বাঁচতে দেয়নি।

কাজী আরেফ আহমেদের জন্ম ১৯৪৩ সালের ৮ এপ্রিল কুষ্টিয়ার কোতোয়ালি থানার কাওদিয়া গ্রামে। লেখাপড়ার শুরু ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে, কলেজজীবন কাটে জগন্নাথ কলেজে, শিক্ষা সমাপন হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬০ সনে ছাত্র রাজনীতিতে অংশ নেন। ১৯৬২-এর রক্তাক্ত সামরিক শাসনবিরোধী এবং শরীফ কমিশনের শিক্ষা সংকোচন নীতির বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৩ সনে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং ’৬৪ সনে ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ’৬৪ সনের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি। ষাটের দশকের সূচনা থেকে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতেন। ১৯৬২ সালে সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ পরিচালনা করতেন। ’৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত করার কাজে তিনি অসাধারণ ভূমিকা পালন করেন।

তৎকালীন জাতীয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, যিনি পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন, তাঁর একান্ত বিশ্বস্ত অন্যতম ছাত্রনেতা ছিলেন কাজী আরেফ আহমেদ। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তিনি অন্যতম সংগঠক হিসেবে ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্সের অন্যতম নেতা ছিলেন, যা পরবর্তী সময়ে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিতি পায়। মুক্তিযুদ্ধকালে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কাজী আরেফ ও তোফায়েল আহমেদ নেতৃত্ব দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১০ জানুয়ারি তিনি দৈনিক গণকণ্ঠ প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন গণকণ্ঠ-এর প্রকাশক ও মালিক।
স্বাধীনতার পর ’৭২ সনের মে মাসে ছাত্রলীগের বিভক্তি ঘটে এবং তারই জের ধরে ওই বছরের ৩১ অক্টোবর জাসদ গঠিত হয়, অন্যতম নেতা হন কাজী আরেফ। ১৯৭৫ সনে বাকশাল গঠন করা হলে সরকারবিরোধী দলগুলো নিষিদ্ধ হয় এবং জাসদ নেতা কাজী আরিফ পলাতক অবস্থায় জাসদ গড়ে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ১৯৭৫-এ তিনি জাতীয় কৃষক লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।

কাজী আরেফ রাজনীতি বিশেষত, ক্ষমতা দখলের রাজনীতির সীমা-সরহদ্দ বুঝতে পেরেছিলেন, বুঝতে পেরেছিলেন ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে নীতি ও আদর্শকে কৌশলের নামে জায়েজ করার রেওয়াজ, যা তিনি মানতে পারতেন না। তিনি এটাও বুঝেছিলেন তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে, দলগুলো ক্রমেই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ছে, দলের ওপর মানুষের আস্থা ক্রমেই নিম্নমুখী হচ্ছে। দলীয় নেতা অনেকে আছেন, আছেন প্রভাব-প্রতিপত্তির নেতা, জাতীয় কর্তব্য পালনের জাতীয় নেতার অনুপস্থিতি সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রকট হচ্ছে ক্রমাগতই।

তিনি এটাও মর্মে মর্মে বুঝেছিলেন,সমগ্র পাকিস্তানি বহুমাত্রিক শোষণ-বঞ্চনা-জাতিগত বৈষম্যের ধর্মের বর্ম ব্যবহার করে করা হয়েছে। পাক শাসকচক্র ২৩ বছর বাঙালিসহ পূর্ব বাংলার জনগণের নাম-নিশানা-ঐতিহ্য-ভাষা-সংস্কৃতি মুছে ফেলতে চেয়েছিল। শুধু রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রামের মাধ্যমে তা মোকাবিলা সম্ভব হয়নি। বহুমুখী সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহ্য জাগানিয়া সংগীত-নাটক-নৃত্য-নাট্য, কবিগান, জারি-সারি-ভাটিয়ালি-গম্ভীরা-মুর্শিদি-পয়লা বৈশাখ রবীন্দ্রনাথ-নজরুল চিত্রকলা সবকিছু নিয়ে জাতীয় শত্রু-বিদেশি শক্ত সকলে বিরুদ্ধে জাতীয় প্রতিরোধ ব্যূহ তৈরি করতে সমর্থ হয়েছিল।

ধর্মের নামে মানুষকে বিভ্রান্তি শোষণ থেকে রক্ষাকবচ বানাতে কৃষক-শ্রমিক-নারী-যুব-ছাত্র আন্দোলনে সব গুলো হাতিয়ারে শান দেওয়া হতো। অথচ স্বাধীনতার পরে প্রধান জাতীয়তাবাদী শক্তি আর বাম-প্রগতিশীল শক্তির স্বাধীনতা সংহতের পথে না গিয়ে জনঘনিষ্ঠ বহুমুখী কর্মযজ্ঞের পরিবর্তে জনবিচ্ছিন্নতা ও ক্ষমতাকেন্দ্রিকতার পথে হাঁটতে গিয়ে দেশি-বিদেশি বৈরী শক্তিকে জনগণের মধ্যে শূন্যতা পূরণের সুযোগ করে দিয়েছে।

উল্লিখিত বিবেচনা থেকে তিনি দলীয় রাজনীতির ঘেরাটোপ ছেড়ে গোলাম আযমদের নাগরিকত্ব বাতিল, গণ-আদালতে বিচার, জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে আন্দোলন, সেখানে সংকীর্ণতাকে প্রশ্রয় না দিয়ে বৃহত্তর প্ল্যাটফর্ম রচনায় আবদুর রাজ্জাক-আরেফ-মেনন-মানিক-পঙ্কজ-সেলিম-অজয় রায়সহ প্রায় সব রাজনৈতিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করতে প্রাণপাত করেছেন বললে অত্যুক্তি হয় না।

রাজনীতির ওপর গণচাপ বাড়াতে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে পীর হাবিবুর রহমান, অজয় রায়, ও আমাকে(পঙ্কজ ভট্টাচার্য) যুক্ত করে রাজনৈতিক মেরুকরণে অসমর্থ হয়ে একটি শক্তিশালী সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে ১৯৯৮ সনে উপরিউক্ত ব্যক্তিরা মিলে জন্ম দেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন নামের ব্যতিক্রমী সংগঠনটির। তা ছাড়া সাংস্কৃতিক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কাজী আরেফের ছিল ঐকান্তিক উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে উচ্চকণ্ঠ, জঙ্গিবাদ ও উগ্র ধর্মান্ধ

সাম্প্রদায়িকতা এবং হরেক রকমের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার কাজী আরেফ কুষ্টিয়ায় ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে সন্ত্রাসী ঘাতকদের হাতে ব্রাশ ফায়ারে শহীদ হলেন। এভাবে আদর্শের জন্য, জনগণের জন্য আত্মবলিদানের অনন্য ইতিহাস গড়লেন কাজী আরিফ। তাঁর সংগ্রামমুখর বাউন্ডুলে জীবনে প্রকৃত দেশব্রতী হিসেবে তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী রওশন জাহান সাথী তাঁকে দিয়েছেন প্রেরণা-সর্বাত্মক সহায়তা, যা ছাড়া তাঁর জাতীয় কর্মোদ্যোগ সম্পাদনা অনেকাংশে ব্যাহত হতো, তাঁর পুত্র-কন্যাদের লালনপালনের কর্তব্যও পুরোটাই পালন করেছেন সাথী।

কাজী আরেফের মতো উদ্যমী জনস্বার্থে ও আদর্শ-নীতিতে অবিচল জাতীয় কর্তব্য পালনে একনিষ্ঠ নেতার অভাব অনেক কাল অনুভূত হবে জনমনে। জয়তু কাজী আরেফ।

পঙ্কজ ভট্টাচার্য ঐক্যন্যাপের সভাপতি