Thank you for trying Sticky AMP!!

জনহিতৈষী মুক্তিযোদ্ধা মুশতাক ভাই

রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক।

রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক গত বৃহস্পতিবার মারা যান। তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় চট্টগ্রাম সরকারি মুসলিম হাই স্কুলে। তিনি আমার এক ক্লাস সিনিয়র ছিলেন। তখনো স্কুলে ছাত্ররাজনীতির প্রবেশাধিকার ঘটেনি। তবে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন হতো। বিপুল ভোটে তিনি স্কুল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। স্কুল শেষ করে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। আমি চট্টগ্রাম কলেজে পড়তে থাকায় আমাদের যোগাযোগ সাময়িকভাবে বিচ্ছিন্ন হয়। ঢাকা কলেজে থাকাকালে তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধিটি প্রথম চালু করেন, যা পরে সর্বজনীনতা লাভ করে।  

পরে আমি আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলে আমাদের যোগাযোগ পুনঃস্থাপিত হয়। আমরা পাশাপাশি হলে থাকতাম তিনি সূর্যসেন ও আমি মহসিন হলে। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কিছুদিন পরই অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়ে যায়। প্রতিদিনই কলাভবনের সামনে প্রতিবাদ সভা। তারপর এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। প্রতিবাদ সভা চলছে। হঠাৎ দেখি মুশতাক ভাইসহ কয়েকজন ছাত্র দৌড়ে কলাভবনের সামনে আসছে। মুশতাক ভাইয়ের হাতে একটা পতাকা। সবুজ জমিনে লাল বৃত্ত। বৃত্তের মধ্যে সোনালি আখরে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের মানচিত্র। তিনি ও অন্যরা মিলে পতাকাটা ডাকসু ও ছাত্রনেতাদের (চার খলিফা নামে পরিচিত) হাতে তুলে দেন। ছাত্রদের পক্ষে আ স ম আবদুর রব পতাকা উত্তোলন করেন। এরপর তিনি মুক্তিযুদ্ধে চলে যান।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তিনি জাসদপন্থী ছাত্রলীগে যোগ দেন এবং একদিন তাঁকে প্রতিপক্ষের কাছে এ জন্য শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখি। এতদ্‌সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও এর মহানায়কের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল অবিচল। এ ছাড়া যখনই দেশের ব্যাপারে কেউ কখনো বিরূপ মন্তব্য বা কটাক্ষ করেছে, তাঁকে একাধিকবার বলতে শুনেছি, সরকারের সমালোচনা করেন ঠিক আছে, কিন্তু দেশের বিরুদ্ধে কথা বলবেন না।

এরপর তিনি রাজনীতি থেকে দূরে সরে পড়েন এবং ঢাকার চট্টগ্রাম সমিতির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে সমিতির সম্পাদক ও পরে একাধিকবার সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তোপখানায় চট্টগ্রাম সমিতির ভবন নির্মাণ, বার্ষিক মিলনমেলা ‘মেজবান’ আয়োজন সবকিছুরই মধ্যমণি ছিলেন তিনি।

আমি তখন ইডকলে কাজ করি। একদিন অফিসে এসে মুশতাক ভাই একটা ফর্ম হাতে দিয়ে বললেন, পাঁচ হাজার টাকা দাও। ফর্মটি ছিল চট্টগ্রাম সমিতির আজীবন সদস্য হওয়ার আবেদন। সভা ও সমিতিতে আমার ব্যক্তিগত অনাগ্রহ সত্ত্বেও আমি কেবল তাঁর অনুরোধে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে ফর্মটি পূরণ করে চট্টগ্রাম সমিতির আজীবন সদস্য হয়ে যাই।

আমি সরকারি চাকরিতে যোগ দিলে তিনি চট্টগ্রাম, ঢাকা শুল্ক ভবন ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে বহুবার আমার অফিসে এসেছেন। তাঁর হার্বার কনসোর্টিয়াম বলে একটি লজিস্টিক কোম্পানি ও কাস্টমস ক্লিয়ারিং এজেন্সি ছিল। কখনোই নিজের ব্যবসার ব্যাপারে কোনো অনুরোধ করেননি। নিজেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি মুশতাক ভাই, আপনাকে কি কোনো সাহায্য করতে পারি? তিনি বলতেন, এদিকে একটা কাজে এসেছিলাম। তোমার সঙ্গে দেখা করে গেলাম। অন্যের জন্য তদবিরে সিদ্ধহস্ত মুশতাক ভাই, নিজের জন্য কখনোই সাহায্য চাইতেন না।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ছাত্রলীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। তিনি জাসদপন্থী ছাত্রলীগে যোগ দেন এবং একদিন তাঁকে প্রতিপক্ষের কাছে এ জন্য শারীরিকভাবে নিগৃহীত হতে দেখি। এতদ্‌সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও এর মহানায়কের প্রতি তাঁর আস্থা ছিল অবিচল।

পরিবার, বন্ধুবান্ধব, নিজগ্রাম অন্তঃপ্রাণ ছিলেন তিনি। তাঁর ছেলে সাদিদ একসময় ম্যানিলায় সিটি ব্যাংকে কাজ করত। আমি একবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সভায় গেলে তিনি আমাকে বারবার তাঁর ছেলে, পুত্রবধূকে দেখে আসতে বলেন। আমি এক সন্ধ্যায় গিয়ে আমি তাদের দেখে আসি। বন্ধুদের সুদিন দুর্দিনে সব সময়ই তিনি পাশে থাকতেন। বন্ধুদের চিকিৎসা থেকে ছেলেমেয়েদের বিয়ে, চাকরির সমস্যা সবকিছুতেই তিনি থাকতেন। প্রায় দিনই সচিবালয়ে যাওয়া হতো তাঁর। নিজের কাজের জন্য কমই, বেশির ভাগ সময় অন্যের জন্য নিঃস্বার্থ তদবির করার জন্য। রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী, সচিব পদস্থ কর্মকর্তা সবার অফিস বাসা ছিল তাঁর জন্য অবারিত দ্বার। তিনি কত লোকের যে উপকার করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

আপ্যায়ন করতে ভালোবাসতেন তিনি। গেল রমজানেও আমাদের বাসায় ইফতার ও ডিনার পাঠান তিনি। ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন করলে বললেন, ‘আমি আবার কী পাঠাব? তোমার স্ত্রীর বান্ধবী ও তোমার নাজনীন ভাবি তাঁর বেয়াই বাড়ি থেকে পাঠানো খাবার খানিকটা শেয়ার করেছে।’ উল্লেখ্য, মুশতাক ভাইয়ের স্ত্রী রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে আমার স্ত্রীর সহপাঠী ছিলেন। কখনোই নিজে কিছুর কৃতিত্ব নিতে চাইতেন না। সর্বশেষ তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয় তাঁদের গ্রামের বাড়িতে ব্যাকআপ ব্যবস্থা হিসেবে সৌরবিদ্যুৎ স্থাপন বিষয়ে। আমি তাঁকে আইপিএস এবং সৌরবিদ্যুতের তুলনামূলক কার্যকারিতা ব্যাখ্যা করি ও একটি সৌরবিদ্যুৎ কোম্পানির প্রধান নির্বাহীর ফোন নম্বর দিই।

নেতৃত্ব ও রাজনীতি ছিল তাঁর সহজাত প্রবৃত্তি। তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ও সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ছিল কিংবদন্তির মতো। চট্টগ্রাম সমিতি ছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অ্যালামনাই সমিতি, ঢাকা কলেজের সতীর্থ ‘৬৭ সমিতিসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। অথচ তিনি কখনোই সাংসদ কিংবা মন্ত্রী হননি। অথচ আমাদের সময়ের বাঘা বাঘা রাজনীতিবিদেরা সবাই ছিলেন তাঁর অত্যন্ত কাছের মানুষ। একবার আমাদের এক বন্ধুর তদবির নিয়ে তিনি এক ডাকসাইটে মন্ত্রীর কাছে যান। কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়াই। পিএস জিজ্ঞেস করলেন আপনার অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে? তিনি বললেন, না নেই। পিএস বললেন, মন্ত্রী তো অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া কারও সঙ্গে দেখা করবেন না। মুশতাক ভাই বললেন, উনি কি রুমে আছেন? রুমে আছেন শুনে বললেন, মেহেরবানি করে একটু বলবেন, আমার নাম রেজাউল হক মুশতাক। আমার সঙ্গে একজন বন্ধু আছেন। আমরা একটু তাঁর সঙ্গে দেখা করতে চাই। অগত্যা, বিনয়ী লোকটির প্রতি সদয় হয়ে পিএস মন্ত্রীকে জানান। কিছুক্ষণের মধ্যেই মন্ত্রী নিজেই বের হয়ে এসে তাঁকে বলেন, কী ব্যাপার মুশতাক? নিজেই তাঁকে সঙ্গে করে রুমে নিয়ে যান।

এ ব্যাপারে আমি তাঁকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করেছি। তাঁর জবাব ছিল সবাইকে দিয়ে সবকিছু হয় না। অথচ নিবেদিত রাজনীতিবিদের সব গুণ, ঘরের খেয়ে ও খরচে পরের উপকার করে বেড়ানো, দলমত-নির্বিশেষে সবার সঙ্গে মিশতে পারা, কখনোই রাগ না করা, উত্তেজিত না হওয়া, পরোপকারের সীমাহীন তৃষ্ণা তাঁর মধ্যে ছিল। প্রায়ই ভাবতাম ক্ষমতার বলয়ের বাইরে থেকে সর্বজনের যতটা উপকার করেছেন, ক্ষমতায় থাকলে আরও কত বেশি মানুষই তাঁর কাছ থেকে উপকৃত হতো।

আবার এটাও ভাবি মন্ত্রী, সাংসদ তো কত শত সহস্রই আছেন। কিন্তু মুশতাক ভাইয়ের মতো নিঃস্বার্থ সেবক কয়জন আছেন। তিনি রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়ায় আমাদের রাজনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন বলতে আমরা যা বুঝি, তা মুশতাকের মতো নেতারাই বাস্তবায়ন করতে পারতেন। কিন্তু যিনি নিজেই ছিলেন একটা প্রতিষ্ঠান, তাঁর জন্য পদ–পদবির প্রয়োজন হয় না। তবুও মনে করি, মুশতাক ভাইদের মতো মানুষ যত বেশি রাজনীতির নেতৃত্বে আসবেন, ততই আমাদের জন্য মঙ্গল হবে।
আমি মুশতাক ভাইয়ের আত্মার মাগফিরাত কামনা করছি। নাজনীন ভাবি, কন্যাদ্বয় মাহজাবীন ও অনিকা, একমাত্র সন্তান সাদিদকে বলি আপনাদের ভালোবাসার মুশতাক ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। তাঁর জনহিতকর কাজের জন্য তিনি দেশের অসংখ্য মানুষের মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ী আসন লাভ করেছেন।

মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ