Thank you for trying Sticky AMP!!

মোজাফ্ফর আহমেদের প্রয়োজন আজ সবচেয়ে বেশি

আজ তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকাই পালন করতে পারছে না বিভক্ত নাগরিক সমাজ। এ খামতি দূর করতে পারতেন মোজাফ্‌ফর আহমদ

আজ ২২ মে। প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদের নবম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০১২ সালের এই দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। গত নয় বছরে আমরা তাঁর গুণগ্রাহীরা প্রতি দিনই তাঁর অভাব অনুভব করেছি। তবে এবার যেন তাঁর অভাবটা সবচেয়ে বেশি অনুভব করছি। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের মুক্তবুদ্ধির চর্চাসহ নাগরিকদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হরণ করার ন্যক্কারজনক ও বেসামাল চেষ্টার প্রেক্ষাপটে অনেক ক্ষেত্রে যা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে রূপ নিয়েছে।

জন্মগতভাবে মানুষের কতগুলো অধিকার থাকে। এসব অধিকারের অনেকগুলোই মৌলিক অধিকার হিসেবে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত। আইনের মাধ্যমেও কতগুলো অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে। নাগরিকের এসব অধিকার সমুন্নত রাখার জন্য আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় কতগুলো সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করে একটি ‘পাহারাদারত্বের’ কাঠামো গড়ে তোলা হয়, যাতে ক্ষমতাসীনেরা এগুলো হরণ করতে না পারে। কিন্তু অনেক দেশেই দুর্নীতিগ্রস্ত ও অযোগ্য বশংবদদের নিয়োগের মাধ্যমে এসব প্রতিষ্ঠানকে অকার্যকর করে ফেলা হয়। ফলে পদদলিত হয় নাগরিকের অধিকার। তারা রাষ্ট্রের মালিকের পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের ‘দাসে’ পরিণত হয়।

এ অবস্থা থেকে উত্তরণের একটি বড় রক্ষাকবচ হলো শক্তিশালী নাগরিক সমাজ ও স্বাধীন গণমাধ্যম। বর্তমানে আমাদের গণমাধ্যমের অবস্থা নাজুক, বহুলাংশেই তারা অনুগত। যে দু–একটি ব্যতিক্রম আছে, তাদের কণ্ঠরোধের জন্য নিবর্তনমূলক কতগুলো অতি ধারালো অস্ত্র—যেমন, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট—ক্ষমতাসীনেরা শাণিত করে তাদের ভান্ডারে রেখেছে। ক্ষমতাসীনেরা যে এসব অস্ত্র ব্যবহারে সামান্যতমও দ্বিধা করে না, তা প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ ও নন্দিত সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টে গ্রেপ্তারের মাধ্যমে আবারও প্রমাণিত হলো।

প্রসঙ্গত, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় যে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম সচিবালয়ে যেসব নথির সংগ্রহ করেছেন, তা প্রকাশ পেলে দেশের বড় ক্ষতি হয়ে যেত। আমরা জানি, রোজিনা ইসলাম স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। তাহলে কি রোজিনাকে হেনস্তা ও গ্রেপ্তারের মাধ্যমে সরকার দুর্নীতিবাজদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করল? এ ছাড়া একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার কী করছে, নাগরিকদের কাছ তা গোপন করে রাখার অধিকার রাষ্ট্রযন্ত্রের নেই।

ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি কে কে মেথু একটি বক্তব্য এ প্রসঙ্গে অত্যন্ত প্রণিধানযোগ্য। তিনি স্টেট অব ইউপি বনাম রাজ নারায়ণ [এআইআর (১৯৭৫) এসসি] মামলার রায়ে লিখেছেন: ‘আমাদের মতো একটি দায়িত্বশীল সরকারে, যেখানে জনগণের সকল “এজেন্ট” তাদের আচরণের জন্য দায়বদ্ধ, সেখানে গোপনীয়তার সুযোগ নেই বললেই চলে। জনগণের পক্ষে কাজ করা কর্মকর্তাদের (পাবলিক ফাংশনারিজ) সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে, যেগুলো তারা জনগণের জন্য করেন, জনগণের জানার অধিকার রয়েছে।’ আমাদের দায়ের করা একটি মামলায়ও বাংলাদেশ হাইকোর্ট রায় দেন যে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে থাকা সব তথ্যই পাবলিক ইনফরমেশন, যা তারা প্রকাশ করতে বাধ্য [বদিউল আলম মজুমদার ও অন্যান্য বনাম বাংলাদেশ, ৬৯ ডিএলআর (২০১৭)]।

বর্তমান দুঃসহ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হলো শক্তিশালী নাগরিক সমাজ, প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদ ছিলেন যে সমাজের পুরোধা। যেখানে নাগরিকের অধিকার সংরক্ষণকারী সাংবিধানিক ও বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংসপ্রায় এবং পক্ষপাতদুষ্ট গণমাধ্যম বহুলাংশে ‘প্রচারমাধ্যমে’ পরিণত হয়েছে, সেখানে নাগরিক সমাজই একমাত্র ভরসা। নাগরিক সমাজের ভূমিকা পাহারাদারদের ওপরও পাহারদারিত্ব করা। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ফায়দার রাজনীতির কারণে বিভক্ত নাগরিক সমাজ আজ তেমন কোনো কার্যকর ভূমিকাই পালন করতে পারছে না। প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদের মতো অকুতোভয় ও অদম্য প্রতিবাদী কণ্ঠ কিছুটা হলেও এ অভাব দূর করতে পারতেন।

প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদের সাহসিকতার বহু দৃষ্টান্ত আমি নিজের চোখে দেখেছি। ১৯৬৬ সালে নিজের স্বার্থ বিসর্জন দিয়েও প্রতিবাদ করার একটি বড় দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং উপাচার্য ওসমান গনির আশ্রয়-প্রশ্রয়ে লালিত এনএসএফ সে সময় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ড. আবু আহমদের ওপর আক্রমণ করে। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে নিজের জীবিকা বিসর্জন দিয়ে প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা থেকে পদত্যাগ করেন।

আরেকবার ১৯৯৮ সালে প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদের অদম্য সাহসিকতার দৃষ্টান্ত আমরা দেখতে পাই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সরকারি দলের ক্যাডারেদের দ্বারা একের পর এক ছাত্রী ধর্ষণের শিকার হচ্ছিলেন। দুর্বৃত্তরা এত বেপরোয়া ছিল যে তাদের একজন, জসিমউদ্দিন মানিক, ঘটা করে তার শততম ধর্ষণ উদ্‌যাপন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বুকে-পিঠে পোস্টার লাগিয়ে সে সময়ে তিনি একা একটি চেয়ারে বসে প্রতিবাদ করেছিলেন। আরও কয়েকজন শিক্ষকের এ প্রতিবাদে যোগ দেওয়ার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তাঁরা তা করেননি।

২০০১ সালে নির্বাচিত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে আরেকবার প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদের সাহসিকতার পরিচয় পাই। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির সূচক নিয়ে সে সময় ক্ষমতাসীনদের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রতিবাদ হয়। এমনকি হুমকিও এসেছে। এসব কিছু উপেক্ষা করে দায়িত্ব পালনে অটল থাকেন তিনি।

প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদকে নিয়ে আরেকটি স্মৃতি আমার মনে আজও অম্লান। সময়টা ছিল নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি, ঢাকার আশপাশে ডেভেলপারদের দৌরাত্ম্য তখনো পুরোপুরি শুরু হয়নি। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের হয়ে প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদ আর আমি তখন গিয়েছিলাম আমাদের দেশের একজন বিশিষ্ট আইনজীবীর কাছে। উদ্দেশ্য দখলদারির বিরুদ্ধে আইনি লড়াই শুরু করা। আইনজীবীর একজন জুনিয়র রিটের একটি খসড়াও তৈরি করেন। কিন্তু রিটটি দাখিল করার আগের দিন সিনিয়র আইনজীবী হঠাৎ বলে বসেন, তিনি মামলাটি দাখিল করতে পারবেন না, কারণ এ ক্ষেত্রে তাঁর স্বার্থের দ্বন্দ্ব রয়েছে। আমাদের রিট আবেদনের একটি কপি দিতেও তিনি অস্বীকৃতি জানান। এরপর বহু আইনজীবীর দ্বারে দ্বারে ধরনা দিয়েও কাউকে দিয়ে ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে একটি রিট আমরা দাখিল করাতে পারিনি। আমার ধারণা, নব্বইয়ের দশকে সে রিট করা গেলে বাংলাদেশে দখলদারত্বের সমস্যা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করা যেত।

আজকের এ বেদনার দিনে আমরা প্রফেসর মোজাফ্‌ফর আহমদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি। একই সঙ্গে আসুন, তাঁর নীরব হওয়া প্রতিবাদী কণ্ঠকে নিজেদের কণ্ঠ দিয়ে সরব করি।

ড. বদিউল আলম মজুমদার সম্পাদক, সুজন—সুশাসনের জন্য নাগরিক