Thank you for trying Sticky AMP!!

আমার দেশ ভালো নেই, অবনি!

সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের বারান্দায় পা রেখেছি; নতুন নতুন এসেছি ঢাকা শহরে। ভর্তিযুদ্ধের দীর্ঘ যাত্রার বেলা-অবেলা কিংবা কালবেলার শত দুঃখ বেদনাকে সরিয়ে একদিন পথে নামলাম। জাদুর শহরের কত কত গল্প আমাদের মফস্বল শহরের আটপৌরে বাস্তবতার দেয়ালে দেয়ালে ছড়ানো, তাই যেন স্বচক্ষে দেখার লোভ সামলাতে না পেরে এক বিকেলে মেট্রোরেল দেখতে বেরোলাম।

জীবনে সেদিন প্রথমবার মেট্রোরেলে ভ্রমণ। স্টেশন থেকেই দেখছি অবিরত জনতার মধ্যে হাজার জোনাকির আলোর মতো জ্বলা দুটি চোখ। আমি বিস্মিত, হতভম্ব! স্বয়ং দেবী আফ্রোদিতি আমাদের মর্ত্যলোকে কেন?

হুমায়ুন আহমেদের কোনো এক বইয়ে পড়েছিলাম যে, এ পৃথিবীতে সবচেয়ে সুন্দর চোখ নিয়ে দুটি মাত্র পুরুষ এসেছিলেন। একজন বুদ্ধদেব পুত্র কুনাল আর একজন ইংরেজ কবি পার্সি বিসি শেলি। আমার মনে হল, তার চোখ ওনাদের দুজনের চেয়েও শত কোটি গুণ সুন্দর! কেবলই কী সুন্দর? প্রহর শেষের আলোয় রাঙা সেদিন চৈত্র মাস ছিল কিনা জানি না, তবে আমার যা সর্বনাশ হওয়ার তা ততক্ষণে হয়ে গেছে।

তখন সব পাখি নীড়ে ফিরেছিল কিনা তা ও আমার জানা নেই, তবে পাখির নীড়ের মতো সে চোখ আমাকে যেন ফেলে দিল বিম্বিসার অশোকের কোনো এক ধূসর জগতে কিংবা কোনো প্রাগৈতিহাসিক অন্ধকারে! কাঁপা কাঁপা পায়ে আমি যখন মেট্রোতে উঠলাম, সেও উঠল আমারই সঙ্গে। সে আমার পাশে, আমি তার পাশে।

জানি না, আমাদের দুপাশে কী ছিল! বোধ হয় দুই মহাদেশের নীরবতা। আচমকা ট্রেন চলতে শুরু করল; কক্ষপথ ঘুরতে ঘুরতে মঙ্গল যেমন কখনো কখনো পৃথিবীর খুব কাছে চলে আসে, ঠিক তেমনি গতিজড়তা হঠাৎ তাকে ঠেলে দিল আমার দিকে। আমার ভেতরটা বজ্রবিদ্যুতের মতো চমকে উঠল। এক পৃথিবীর সব বজ্রবিদ্যুৎ এখন আমার শরীরে!

কাঁপা কাঁপা গলায় ‘সরি’ শুনবার সুযোগ পেয়ে তারপর কিছুক্ষণ আমাদের মধ্যে যে গল্প চলল সে অপূর্ব কথোপকথন কিংবা ওই কুড়ি মিনিটের যাত্রার পরবর্তী শব্দহীন পৃথিবীর গল্প যদি আপনাদের শোনাতে পারতাম; মানিক বাবুর মতো আজ তাহলে বলতাম যে, সেই অপূর্ব কথন সাহিত্যে না হোক, তা আমার কাছে হয়তো সবচেয়ে মূল্যবান হয়ে উঠত। জীবনানন্দের ভাষায়—মনে হয় শুধু আমি আর শুধু তুমি/ আর ওই আকাশের পউষ নীরবতা; রাত্রির নির্জন যাত্রী তারকার কানে কানে কতকাল/ কহিয়াছি আধো আধো কথা!

ট্রেন থামল, যাত্রা থামল তোমার আমার।
জানি আর তার সঙ্গে দেখা হবে না কখনোই; তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি, স্বপ্ন বুনি। আমাদের স্বপ্নগুলো স্বপ্নই থেকে যায়।
আবার বছর কুড়ি পরে তার সঙ্গে দেখা হয় যদি; আমি তারায় তারায় রটিয়ে তাকে বলে দেব, আমার শহর ভালো নেই, অবনি!

উদ্ভট উটের পিঠে চলছে স্বদেশ। মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছরের মাথায় মহাকাশে স্যাটেলাইট গেছে; ১৮তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ হয়েছে বাংলাদেশ আর পৃথিবীর সর্বোচ্চ খেলাপি ঋণের তালিকায়ও আমরা আছি শুরুর দিকে।

একদিকে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের আগ্রাসী তৎপরতা প্রশ্নবিদ্ধ করেছে মানব অস্তিত্বকে; নৈরাজ্য-নৈরাশ্য-অনিশ্চয়তা-ক্লেদ-শঙ্কা আর মনস্তাপে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে আত্মপ্রতারণার।

অন্যদিকে দেশের মুদ্রাস্ফীতি সীমাহীন, রিজার্ভের তীব্র সংকট, দ্রব্যমূল্য আকাশছোঁয়া। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্ন শিক্ষার্থী-অভিভাবক সবাই, ব্যাংকগুলোয় তারল্য সংকট প্রখর, ডলার খুঁজে পাওয়া যায় না বাজারে। এখানে কাঁচামরিচ কিংবা সবজির বাজারে হাত দিতে গেলে রাশা-ইউক্রেন যুদ্ধের ওজর শুনতে হয়।

তবুও আমাদের মুখে হাসি। কোথাও কোনো প্রতিবাদ নেই। কোথাও কোনো আলোড়ন নেই। কিন্তু তা-ই কী হওয়ার কথা ছিল? নাকি কথা ছিল, জুলুমের দিনগুলোতে আমরা তীব্র ক্ষোভে ও রাগে ফেটে পড়ব। কথা ছিল রাজনীতি আমাদের হবে, কথা ছিল; আমাদের ধর্ম হবে ফসলের সুষম বণ্টন। হয়েছে কী? হয়নি।
কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না।

সাকির ইফাজ
শিক্ষার্থী, ইতিহাস বিভাগ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়