Thank you for trying Sticky AMP!!

এই শিক্ষকেরা রাষ্ট্রদ্রোহী?

বিষয়টি দুভাবেই ব্যাখ্যা করা যায়। চট্টগ্রামের বাঁশখালী উপজেলার একজন স্কুলশিক্ষক নবম শ্রেণির প্রশ্নপত্রে স্থানীয় আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী একজন চেয়ারম্যানের ভূমিকার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (নাম উল্লেখ না করে) তুলনা টেনেছেন। একদিক থেকে দেখলে নেহাত সাধারণ মানের একজন গ্রামের নেতার সঙ্গে একজন বিশাল মাপের মানুষের তুলনা টানা অসমীচীন তো বটেই, একধরনের অন্যায়ও বটে। আবার অন্যদিক থেকে যদি বিবেচনা করা হয়, এই শিক্ষকের অবচেতনে হয়তো এ দেশের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস ও এর সঙ্গে অনিবার্যভাবে যে নামটি সর্বাগ্রে চলে আসে, সেই নামই প্রোথিত ছিল। যেকোনো প্রসঙ্গের সূত্রে শিক্ষার্থীদের সেই মহান মানুষটির অবদানের কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চান তিনি। তাই প্রশ্নপত্রে এই তুলনা এসে গেছে হয় স্বতঃস্ফূর্তভাবে, নয়তো অসতর্কতার কারণে।

>কিন্তু বাঁশখালী বঙ্গবন্ধু উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক দুকুল বড়ুয়ার সেই সুযোগ বা সৌভাগ্য হয়নি। তাঁর তৈরি করা প্রশ্নটিতে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার চেষ্টা হয়েছে, নাকি এই অবিসংবাদী নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও অনুরাগবশত এই প্রশ্নের অবতারণা—এসব বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশও হয়নি কারও।

প্রসঙ্গক্রমে বরগুনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গাজী তারিক সালমনের ভোগান্তির কথা পাঠকের মনে পড়তে পারে। স্কুল-ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি আঁকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিলেন তিনি। এই শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবির মধ্যে যেটি সেরা বলে বিবেচিত হয়েছিল, সেই ছবি একটি সংকলনের প্রচ্ছদে মুদ্রণের ব্যবস্থাও করেছিলেন তারিক সালমন। শিশুরা তো দক্ষ অঙ্কনশিল্পী নয়, বঙ্গবন্ধুর ছবিটি হয়তো সব দিক থেকে নিখুঁত হয়নি। এর সুযোগ নিয়েছিলেন কিছু মানুষ। তাঁরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধিতে নেমেছিলেন। বিষয়টাকে অন্যদিকে প্রবাহিত করে বঙ্গবন্ধুর ছবি বিকৃত করা হয়েছে বলে মামলা করেছিলেন তারিকের বিরুদ্ধে। নানাভাবে হেনস্তার পর বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল ও খোদ প্রধানমন্ত্রীর নজরে এলে তারিক বিপদমুক্ত তো হয়েছিলেনই, উপরন্তু প্রশংসিত হয়েছিল তাঁর উদ্যোগ।
কিন্তু বাঁশখালী বঙ্গবন্ধু উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক দুকুল বড়ুয়ার সেই সুযোগ বা সৌভাগ্য হয়নি। তাঁর তৈরি করা প্রশ্নটিতে বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার চেষ্টা হয়েছে, নাকি এই অবিসংবাদী নেতার প্রতি শ্রদ্ধা ও অনুরাগবশত এই প্রশ্নের অবতারণা—এসব বিষয়ে দ্বিতীয়বার ভাবার অবকাশও হয়নি কারও।
গত বছরের জুলাই মাসে বাঁশখালীসহ চট্টগ্রামের ছয় উপজেলায় নবম শ্রেণির অর্ধবার্ষিক পরীক্ষায় একটি প্রশ্ন নিয়ে কারও কারও আপত্তির মুখে পরীক্ষার পরদিন পুলিশের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়। ওই দিনই আটক করা হয় দুকুল বড়ুয়া ও বাঁশখালী উপজেলা শিক্ষক সমিতির সভাপতি তাহেরুল ইসলামকে। ওই যাত্রায় এই দুজন শিক্ষক যথাক্রমে ৪৯ দিন ও ১৫ দিন কারাভোগ করে জামিনে মুক্তি পান।
কিন্তু এখানেই দুর্ভোগের শেষ হয়নি তাঁদের। তৎকালীন জেলা প্রশাসকের নির্দেশে একটি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। সেই তদন্ত কমিটির কাছে ‘অনিচ্ছাকৃত’ ত্রুটির জন্য লিখিতভাবে ক্ষমা প্রার্থনাও করেছেন দুকুল বড়ুয়া। কিন্তু তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার সুপারিশ করা হয়।
শুধু দুকুল বড়ুয়া নন, প্রশ্নপত্র যাচাই-বাছাই, মুদ্রণ ও বিতরণের দায়িত্বে থাকার কারণে শিক্ষক সমিতির সংশ্লিষ্ট ছয়টি উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককেও এই মামলায় অন্তর্ভুক্ত করে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। গত ২৩ আগস্ট থেকে কারাভোগ করছেন দুকুল বড়ুয়াসহ মোট ১৩ জন শিক্ষক। এর মধ্যে ঈদুল আজহার মতো ধর্মীয় উৎসবের ছুটিও অতিবাহিত হয়েছে। মানবিক কারণে এই শিক্ষকদের মুক্তি দেওয়ার জন্য বিভিন্ন মহলে আবেদন-নিবেদন, সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন—সবই হয়েছে। কিন্তু অন্ধকার প্রকোষ্ঠ থেকে মুক্তি মেলেনি ১৩ জন শিক্ষকের। তাঁদের জীবন কতটা দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে, তা সহজেই অনুমেয়।

যে প্রশ্নটি নিয়ে দুকুল বড়ুয়াসহ ১২ জন শিক্ষকের দুর্ভোগের সূত্রপাত, সেই প্রশ্নটি এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি। প্রশ্নপত্রের ৪ নম্বর প্রশ্নের উদ্দীপক অংশটি ছিল এ রকম: ‘কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে কেন্দ্র করে গন্ডামারা গ্রাম আজ লন্ডভন্ড। যেদিকে তাকাই শুধু ধ্বংসযজ্ঞ। চেয়ারম্যান জনাব “L” এ অবস্থা দেখে খুবই মর্মাহত হন। তিনি এ অবস্থা দেখে তাঁর গ্রামবাসীকে উদ্ধার করেন। অল্প সময়ের মধ্যে গ্রামবাসী ঘুরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে এবং সফলকাম হয়। সকলে এক বাক্যে স্বীকার করে যে জনাব “L” এর জন্যই এটা সম্ভব হয়েছে।’
উদ্দীপক এই অংশের নিচে চারটি প্রশ্নের একটি ছিল: ‘উদ্দীপকে উল্লেখিত নেতা জনাব “L” এর সঙ্গে বাংলাদেশের কোন নেতার মিল রয়েছে? যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গঠনে উক্ত নেতার গৃহীত পদক্ষেপগুলো পাঠ্যপুস্তকের আলোকে ব্যাখ্যা কর।’
পাঠকদের স্মরণে থাকতে পারে, বাঁশখালীর গন্ডামারা গ্রামে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনকে কেন্দ্র করে গত বছর এপ্রিল মাসে অশান্ত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে এলাকায় পরিবেশ বিপর্যয়ের সৃষ্টি হতে পারে এমন আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী এর বিরুদ্ধে এককাট্টা হয়ে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেই সময় সংঘর্ষে চারজনের প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে। এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী। সেই আন্দোলন যুক্তিসংগত ছিল কি না বা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছেছিল কি না, সেই প্রশ্নে যাব না। তবে লিয়াকত আলী যে গ্রামের মানুষকে তাঁর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছিলেন, এ কথা সত্য। এই ঘটনা হয়তো স্থানীয় অধিবাসী ও শিক্ষক দুকুল বড়ুয়ার মনে প্রভাব ফেলেছিল।
সন্দেহ নেই, শেখ মুজিবের সঙ্গে কোনো বিচারেই তুলনার যোগ্য নন এই স্থানীয় নেতা। কিন্তু মানুষের স্বাভাবিক প্রবণতা সাম্প্রতিক কালের কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনাকে তাঁর স্মৃতির সঞ্চয়ে থাকা অনেক বড় কিছুর সঙ্গে তুলনা করা। আমাদের ধারণা, আবেগের আতিশয্যে সেই ‘ভুল’ই করে ফেলেছিলেন দুকুল বড়ুয়া। অবচেতনে বাঙালির অবিসংবাদী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যে ছবি ছিল, সেই ছবিই হয়তো উদ্বুদ্ধ করেছে তাঁকে এ রকম একটি প্রশ্ন তৈরি করতে।
প্রশ্নপত্রটিতে এই একটি মাত্র প্রশ্ন তো ছিল না, বাকি প্রশ্নগুলো লক্ষ করলে আমরা দেখব, বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের নানা বিষয় সেখানে আছে। এসব বিষয় কিশোর শিক্ষার্থীদের একটি দেশের প্রকৃত ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহী করবে এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করবে। বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো’ করার কোনো দুরভিসন্ধি যে তাঁর থাকতে পারে না, এই প্রশ্নগুলোর দিকে নজর দিলেই তা বোঝা যায়। প্রশ্নপত্রে শেখ মুজিবুর রহমানকে অবমাননার চেষ্টা করা হয়েছে কি না, তা নিরূপণের জন্য যাঁদের নিয়ে তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তাঁরা সামগ্রিকভাবে বিষয়টি ভেবে দেখলে সুবিবেচনার পরিচয় দিতেন বলে আমাদের ধারণা। দুকুল বড়ুয়া ছাড়া বাকি ১২ জন শিক্ষক প্রশ্নপত্র প্রণয়নের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিলেন না। এই ঘটনায় তাঁদের কারাভোগ করার যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। তা ছাড়া কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান, সাময়িক বরখাস্ত করাসহ শাস্তিদানের পর্যায়ক্রমিক ব্যবস্থাও তো নেওয়া যেত।
লিয়াকত আলী নামের যে উপজেলা চেয়ারম্যানের নেতৃত্ব ও জনপ্রিয়তার প্রসঙ্গ উল্লেখ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর অবদানের কথা স্মরণ করা হয়েছে, ঘটনাচক্রে তিনি বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত বলে বিষয়টি এত দূর গড়িয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। কিন্তু এই আটক শিক্ষকেরাই বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাঁরা এই সংগঠনের বিভিন্ন উপজেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। আমরা জানি, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের একটি পেশাজীবী সংগঠন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য অধ্যক্ষ কামরুজ্জামানের হাতে গড়া এই সংগঠনের নেতারা ‘ড. কুদরাত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন’ ও ‘জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০’ প্রণয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। আজ একটি ‘অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি’ বা ‘অসতর্কতার’ কারণে এই সংগঠনের আদর্শের অনুসারী শিক্ষকেরা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে বিবেচিত হলে ইতিহাসই তো উপেক্ষিত হয়।

বিশ্বজিৎ চৌধুরী: কবি, লেখক ও সাংবাদিক।
bishwabd@yahoo.com