Thank you for trying Sticky AMP!!

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও আরব আমিরাতের যুবরাজ মোহাম্মদ বিন জায়েদ।

ফিলিস্তিনের স্বপ্ন বেচে দিল আরব?

আরব আমিরাত ও ইসরায়েল দ্বিপক্ষীয় শান্তিচুক্তিতে সম্মত হয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘দ্বিপক্ষীয় শান্তিচুক্তি’ কেন? ইসরায়েল ও আমিরাতের মধ্যে কি যুদ্ধ হয়েছিল কখনো? না, যুদ্ধ হয়নি বরং আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের সময় আজকের আমিরাতের অস্তিত্বও ছিল না। আদতে মার্কিনরা ‘দ্বিপক্ষীয় শান্তিচুক্তি’ পরিভাষা দিয়ে ফিলিস্তিনিদের একমাত্র অভিভাবক বানিয়ে দিয়েছে আমিরাতসহ সৌদিবলয়কে। কৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে কাতার, ইরান ও তুরস্ককে। ট্রাম্পের ঘোষণায় চুক্তির শর্ত অনুযায়ী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপিত হবে এবং ইসরায়েল পশ্চিম তীরসহ অন্যান্য ফিলিস্তিনি ভূমি অধিগ্রহণে বিরত থাকবে। কিন্তু নেতানিয়াহু বলছেন, ভূমি অধিগ্রহণে ইসরায়েল বিরত হবে না। তাহলে কি শুধু জনগণকে ধোঁকা দিতেই এই চুক্তি? সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যায়।

ধোঁকাবাজির চুক্তির তালিকায় এই ‘দ্বিপক্ষীয় শান্তিচুক্তি’ই প্রথম নয়। অসলো শান্তিচুক্তিও ইসরায়েল মানেনি। এবারের দ্বিপক্ষীয় শান্তিচুক্তির কারিগর ট্রাম্প ও তাঁর জামাই কুশনার এর আগে ‘শতাব্দীর চুক্তি’ নামে ফিলিস্তিনিদের নিজ ভূমি থেকে উৎখাতের সব আয়োজন করেছিলেন। তখনো মিলেছিল সৌদিবলয়ের দেশগুলোর অকুণ্ঠ সমর্থন। ইসরায়েলের মতোই ট্রাম্প এই চুক্তি থেকে লাভবান হয়েছেন। তিনিও আর সব মার্কিন প্রেসিডেন্টকে অনুসরণ করে ট্রাম্প প্রকাশ্যে ইসরায়েলি রাষ্ট্রের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দেন এবং ‘শতাব্দীর চুক্তি’ নামে ফিলিস্তিনিদের শেষ আশাটুকুও নিভিয়ে দেন। সর্বশেষ আমিরাতকে রাজি করিয়েছেন ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ‘স্বাভাবিক’ করতে। ইসরায়েলের দাবিদাওয়া যেভাবে ট্রাম্প মিটিয়েছেন, আশা করা যায় ইসরায়েলি লবি, বিশেষ করে যাঁরা মার্কিন রাজনীতির অবয়ব অঙ্কন করেন, তাঁরা ট্রাম্পকে আগামী নভেম্বরের নির্বাচনে শক্ত সমর্থন দেবেন। করোনা মোকাবিলায় ট্রাম্পের ব্যর্থতা, মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে রাশিয়ার উত্থান এবং সর্বশেষ চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধে বেকায়দায় থাকা ট্রাম্পের জন্য তা হবে নির্বাচনে জেতার প্রধান উপায়।

এর আগে মিসর ১৯৭৯ সালে এবং ১৯৯৪ সালে জর্ডান ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। ১৯৭৯ সালের ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি অনুযায়ী মিসর প্রতিবছর প্রায় এক বিলিয়ন ডলার সাহায্য পায় মার্কিনদের থেকে। মার্কিনরা টাকার বদলে মিসরের সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তবে পূর্বোক্ত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সময়কাল এবং প্রাসঙ্গিকতা ভিন্ন ছিল। করোনার এই দুর্দিনে হঠাৎ করেই আমিরাতের এ পদক্ষেপ ব্যাখ্যার দাবি রাখে।

প্রশ্ন উঠতে পারে, আরব আমিরাত কেন? কেন সৌদি আরব কিংবা বাহরাইন নয়? মূলত এক দশক ধরে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে সরব সংযুক্ত আরব আমিরাত। যুক্তরাষ্ট্রের চালানো সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনবরত যুদ্ধের পর সৌদিদের সঙ্গে সক্রিয় হয়ে ওঠে আরব আমিরাত। মধ্যপ্রাচ্যের নতুন এই ভাগ্যবিধাতা পেট্রো ডলার আর পশ্চিমা মদদে অভ্যুত্থান ঘটিয়েছে বেশ কয়েকটি দেশে। মিসরের মুরসি ও সুদানের ওমর আল বসিরকে যেভাবে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করেছে, ঠিক একইভাবে লিবিয়ায় হাফতার, মিসরে সিসি এবং সিরিয়ায় আসাদকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রেখেছে আমিরাত ও সৌদিবলয়। আসাদ ইরানবলয়ে থাকলেও আমিরাত আসাদকে সাহায্য প্রদান করে আসছে তুরস্ক বিরোধিতার দরুন। তুরস্কের এরদোয়ান ও তিউনিসিয়ায় আন নাহদার বিরুদ্ধে বারবার চেষ্টা করেও সফল হয়নি আমিরাত। মোটকথা উপসাগরীয় ও মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলে আমিরাতই এখন পশ্চিমের স্বার্থ রক্ষার প্রধান খুঁটি। যেমনটি সৌদি আরব করেছে নব্বইয়ের দশকে। তাই মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার রাজনৈতিক পরিমণ্ডলকে নতুন অবয়ব দিতেই আমিরাতকে বেছে নিয়েছে ইসরায়েল ও আমেরিকা। আমিরাতের এই পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদের দুর্দশা বাড়াবে এবং স্বাধীনতার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেবে। আরবের রাজনৈতিক ও চিন্তার জগতে বিশাল পরিবর্তন ঘটবে।

প্রথমত, আরবরা বারবার যুদ্ধের ময়দানে হেরে গেলেও নৈতিক মানদণ্ডে ছিল শক্ত। মনোবল ছিল সুসংহত। এই শক্ত মনোবল সঙ্গে নিয়ে ইসরায়েলি উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যেসব গোষ্ঠী বুদ্ধিভিত্তিক এবং সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত, তাদের দুর্বল করে দেওয়া হলো। সৌদি যুবরাজ তো মাহমুদ আব্বাসকে চেঁচামেচি বন্ধ করে ট্রাম্পের শতাব্দীর চুক্তি মেনে নিতে বলেছেন। সৌদিবলয়ের রাষ্ট্রগুলো, বিশেষ করে আমিরাত ও কুয়েত হামাসের সব কার্যক্রমের ওপর অনানুষ্ঠানিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। গ্রেপ্তার করেছে প্রথম সারির নেতাদের। আরবরা ১৯৭২ সালের যুদ্ধের পর যেভাবে সামরিক শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল, ঠিক সেভাবে আমিরাতের এই পদক্ষেপের পর নৈতিক মনোবল হারিয়ে ফেলবে। অদূর ভবিষ্যতে সৌদি আরব, কুয়েত, বাহরাইন, ওমানসহ অন্যান্য দেশ যদি ইসরায়েলের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক স্থাপন করে, তবে তাতে অবাক হওয়ার মতো কিছুই থাকবে না।

দ্বিতীয়ত, আরব বিশ্ব পশ্চিমাকরণের জন্য উন্মুক্ত হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আরব সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠী পশ্চিমাকরণ ইস্যুতে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বিভক্তি থেকে শুরু হয় রাজনৈতিক আন্দোলন। যে আন্দোলন প্রথাগতভাবে ‘রাজনৈতিক ইসলাম’ বলে পরিচিত। পুঁজিবাদী বিশ্বকাঠামোর বিরুদ্ধে সংগ্রামে নানা আপস ও সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, রাজনৈতিক ইসলাম পশ্চিমাকরণের বিরুদ্ধে জনপ্রিয় সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। মিসরের মুসলিম ব্রাদারহুড, তিউনিসিয়ার আন নাহদা এবং সুদানের পপুলার কংগ্রেস পার্টি এই আন্দোলনের অগ্রভাগে ছিল। গণতান্ত্রিক শাসনের মধ্যেই পশ্চিমাকরণের বিরুদ্ধচারী রাজনৈতিক দলগুলো মুক্তি দেখেছিল। কিন্তু যেখানেই উপনিবেশবাদবিরোধীরা ক্ষমতায় এসেছে, সেখানেই হয় সেনা–অভ্যুত্থান, নতুবা গৃহযুদ্ধের উসকানি দিয়ে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে বা সেই চেষ্টা চলছে। মিসর, সুদান, আলজেরিয়া কিংবা তুরস্ক যার অন্যতম নমুনা। অপর পক্ষে সৌদিবলয় পশ্চিমাকরণের মাধ্যমেই নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখছে। ধর্ম আর পশ্চিমাকরণের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা নতুন আরব জাতীয়তাবাদের ফসল মোহাম্মদ বিন জায়েদ, মোহাম্মাদ বিন সালমানেরা ফিলিস্তিনকে তাঁদের পূর্বপুরুষের আবেগের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন না। বরং ফিলিস্তিনিদের নিজেদের অগ্রগতির অন্তরায় হিসেবে দেখছেন।

প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই ইসরায়েল মারমুখী ভঙ্গিতে খেলে যাচ্ছে। এর শিকার হয়েছে নিরস্ত্র ফিলিস্তিনিরা। জেরুজালেম হাতছাড়া হয়েছে। এই পরাজয় সৌদিবলয় মেনে নিলেও আঞ্চলিক রাজনীতির অন্য কর্তারা মানতে রাজি নন। তাই ভবিষ্যৎ রাজনীতির কেন্দ্র জেরুজালেম তথা ফিলিস্তিনই থাকছে। কারণ, ঐতিহাসিক সংঘাত দ্রুত মিলিয়ে যায় না। আমিরাতের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে ফিলিস্তিনিদের কফিনে শেষ পেরেক হিসেবে বিবেচিত হবে। যুদ্ধের ময়দানের মতো করে কূটনৈতিক ও নৈতিক ময়দানেও ফিলিস্তিনিরা হেরে যাবে। যাদের আশায় বছরের পর বছর ফিলিস্তিনিরা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে এসেছে, তাদের সেই সহোদর আরবরাই এখন তাদের পরিত্যাগ করে হাত মিলিয়েছে দখলদারদের সঙ্গে। তবে কার্ল মার্ক্স বলছেন ভিন্ন কথা। মার্ক্স বলছেন, সংগ্রাম আর পরিবর্তন বুর্জোয়াদের মাধ্যমে নয় বরং গরিব মেহনতি মানুষের মাধ্যমেই হবে। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামে সফলতা আসবে পশ্চিম তীরে এবং গাজা বা রামাল্লায় সংগ্রামরত নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর মধ্য দিয়ে, রিয়াদ বা আবুধাবি থেকে নয়।

রাহুল আনজুম: গবেষক