Thank you for trying Sticky AMP!!

মা–ছেলের ক্রিকেট খেলার এই দৃশ্যের পক্ষে–বিপক্ষে মত এসেছে। চেহারা লুকানো বা ঢাকা যা-ই থাকুক না কেন, বহিরাবরণ দেখেই মানুষটি কী বা কেমন, ধারণা করে নেওয়া বিপজ্জনক

মা–ছেলের ক্রিকেট: রূপ দেখে ভুল কোরো না

‘ডোন্ট জাজ আ বুক বাই ইটস কভার।’ কথায় কথায় আমরা এই ইংরেজি প্রবাদ আওড়াই। প্রবাদটির সারকথা: প্রচ্ছদ দেখেই বইয়ের ভেতর কী আছে না আছে অনুমান করা অনুচিত। পোশাককে পোশাক ভাবাই সঠিক। আমেরিকায় টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর পাগড়ি-দাড়ি দেখে মুসলমান ভেবে প্রথম যে মানুষটিকে খুন করা হয়, তিনি ছিলেন শিখ ধর্মাবলম্বী। অনেক শিখ তখনো যেমন নিগৃহীত হয়েছেন, এখনো হচ্ছেন। রোমানি বা রোমা জিপসি নারীদের পোশাকও মুসলিম নারীদের হিজাবের মতো দেখতে হওয়ায় তাঁদেরও আক্রান্ত হওয়ার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।

কথাগুলো তোলার কারণ কয়েকটি ছবি ও ভিডিও। ব্যাট হাতে হিজাব পরিহিত মায়ের ক্রিকেট খেলার ছবি-ভিডিওগুলো সামাজিক মাধ্যমে ঠিক-বেঠিক আলোচনা উসকে দিয়েছে। সমাজবিজ্ঞানের ছাত্র হওয়ায় বিভিন্ন মন্তব্য-প্রতিমন্তব্যে নজর রাখছিলাম। সামাজিক মাধ্যমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা নানা মতের দলে ভাগ হয়ে গেছেন। সেটিকে সমস্যা ভাবি না। সম্ভাবনা ভাবি। তবু কিছু আলোচনা ও মন্তব্যকে দুর্ভাগ্যজনক মনে হয়েছে। কারণ, সেগুলো আমজনতার মন্তব্য নয়। সমাজের আলোকপ্রাপ্ত অংশের মন্তব্য। তাঁদের অনেকেই লৈঙ্গিক সম্পর্ক, নারীবাদ, পিতৃতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে পড়াশোনা করেন বা চর্চায় সেসব রাখার চেষ্টা করেন।

চেহারা লুকানো বা ঢাকা যা-ই থাকুক না কেন, বহিরাবরণ দেখেই মানুষটি কী বা কেমন, ধারণা করে নেওয়া বিপজ্জনক। বাংলা গানেও দর্শনটি ভালোই এসেছে, ‘রূপ দেখে ভুল কোরো না, রূপটা তো নয় মনের আয়না।’

বাল্যকালে শুনেছিলাম, রবিঠাকুরের কাচে বাঁধানো ছবি দেখে গ্রামগঞ্জের মানুষ তাঁকে পীর-আউলিয়া ভাবত। তাঁর মাজারটি কোথায় জানতে চাইত। সাদ্দামের জমানায় ইরাকের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন তারিক আজিজ। নাম শুনে অনেকে ভাবতেন তিনি মুসলিম। তিনি আসলে খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী। নামকরণ নিতান্তই একটি সাংস্কৃতিক বিষয়। মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ অমুসলিমের নাম শুনলে মুসলিম মনে হতে পারে। কানাডায় একবার ঘানার এক অভিবাসী যুবক আমার কাছে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করতে এল। তার এবং আমার উভয়ের নামের প্রথমাংশ ‘হেলাল’। যার অর্থ ‘নতুন চাঁদ’। আরেকবার একজন বন্ধুকে বোঝাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছিল যে ‘আফতাব’ নামের মুম্বাই সিনেমার অভিনেতাটি মুসলিম নয়।

এখন আর সেই সময় নেই। দুনিয়া ছোট হয়ে এসেছে। ফোনে ইন্টারনেট সংযোগ থাকলে বা অল্প কয়েক মেগাবাইট ডেটা থাকলেই চলে। দূর গাঁও-গেরামের একজন পিছিয়ে পড়া মানুষও ইউটিউবের বরাতে বুঝতে পারেন রবীন্দ্রনাথ, তারেক আজিজ, আফতাবরা কে বা কারা। ফলে, বেশভূষা দেখেই ‘বুঝে ফেলেছি’ ভাবখানা কমে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবতা হয়তো ভিন্ন। কারণ, আমাদের সামাজিকীকরণ একরৈখিক। পরিবারে দূরে থাক, বিদ্যায়তনেও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আলোচনার বিষয় হয় না। ফলে, আমরা প্রচ্ছদ দেখেই বইটি ভালো না মন্দ বিচার করে বসি। ‘নামে কী যায় আসে’ কথাটি স্বদেশি। আমরা হরহামেশাই শুনি। কতটা মানি, সেটিই বিবেচ্য। হয়তো ততটা মানি না।

ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, মা ও সন্তানের সুনির্মল মধুময় ভালোবাসার এই নিদারুণ দৃশ্যকাব্য সহসাই তৈরি হয় না। হয়তো হয়, কিন্তু ক্যামেরার চোখে ধরা পড়ে না। মা-ছেলের এই স্বাভাবিক সাবলীল ভালোবাসার দৃশ্যগুলো দেখে প্রাণ জুড়িয়ে যাওয়ার কথা। অনেকে তেমনটি বলেছেন এবং লিখেছেনও বটে। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষের চোখই শুধু ‘হিজাব’-এ আটকে আছে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে ‘হিজাব’। মা-সন্তানের ভালোবাসা সামান্যই গুরুত্ব পাচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, মাতৃত্বের কাব্যিক দৃশ্যটির আলোচনা ছাড়িয়ে ‘হিজাব’ই কেন আলোচ্য বিষয় হয়ে উঠল? হিজাবের পক্ষ-বিপক্ষ নেওয়া আলোচনাই–বা বড় বিতর্কের বিষয় হয়ে উঠছে কেন?

মা–ছেলের ক্রিকেট খেলার এই দৃশ্যের পক্ষে–বিপক্ষে মত এসেছে। চেহারা লুকানো বা ঢাকা যা-ই থাকুক না কেন, বহিরাবরণ দেখেই মানুষটি কী বা কেমন, ধারণা করে নেওয়া বিপজ্জনক

সমাজবিজ্ঞানে ‘কালচারাল ল্যাগ’ বা ‘সাংস্কৃতিক বেশকম’ বলে একটি তত্ত্বীয় ধারণা আছে। সংক্ষেপে ধারণাটি এমন: বস্তুগত সংস্কৃতি, যেমন: টিভি, কম্পিউটার, সেলফোন ইত্যাদির বিকাশ ঘটে খুবই দ্রুততায়। অনেকটা চোখের পলকে। অথচ অবস্তুগত সংস্কৃতি, যেমন: ধর্মবিশ্বাস, পূর্বধারণা, সংস্কার-কুসংস্কার, মনোভাব, এমনকি আদর্শিক অবস্থান—সবকিছুই বদলায় খুবই ধীরে। ফলে, একজন মানুষ অত্যাধুনিক মডেলের সেলফোন হয়তো ব্যবহার করছেন, যেটা বিকশিত বস্তুগত সংস্কৃতির চিহ্ন, কিন্তু তাঁর চিন্তাভাবনা হয়তো মান্ধাতা আমলের। অথবা তিনি যা ভাবতেন বা ভাবছেন, সেসব ভাব-ভাবনায় সামান্যই পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। বস্তুগত সংস্কৃতির এগিয়ে যাওয়া, অবস্তুগত সংস্কৃতির সেই তুলনায় অনেক পিছিয়ে থাকার এই বেমিল অবস্থাটিই ‘সাংস্কৃতিক বেশকম’।

হিজাবকে মুখ্য বিষয় করা একদল বলছে, এবার দেখেছ হিজাব কোনো সমস্যা নয়। হিজাব পরেও খেলাধুলাও করা যায়। আরেক দল বলছে, হিজাব-পরিহিতার কাজটি ঠিক হয়নি। তিনি হিজাবের অবমাননা করেছেন। সন্দেহবাতিকগ্রস্তদের কেউ কেউ একধাপ এগিয়ে বলছেন, অন্য মানুষজন জড়ো হওয়ার পরও মেয়েটির সাবলীলভাবে খেলতে থাকা থেকে বোঝা যায় ভাইরাল হওয়ার জন্য, আলোচনায় আসার জন্য ভদ্রমহিলা এমন পোশাকে নেমেছেন। জানা গেছে, ঝর্না আক্তার নামের ওই নারী স্কুলপর্যায়ে খেলাধুলা-সংশ্লিষ্ট ছিলেন। হাইজাম্প, লংজাম্প, চাকতি নিক্ষেপ ইত্যাদিতে অংশ নিতেন। তাঁর পরিবারও ক্রীড়ামনস্ক, সন্তানও ক্রিকেটমুখী। এসব জেনে কেউ আক্ষেপ করেছেন, একজন সম্ভাবনাময় অ্যাথলেটকে হিজাব পরিয়ে তাঁর প্রতিভা বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এমনও কথা উঠেছে, যেহেতু খেলাধুলা করতেন, হিজাব সম্ভবত তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। একদল বলছে, এভাবে এই পোশাকে ব্যাট হাতে নিয়ে খেলার চেষ্টা, তা যত ক্রীড়াকৌতুকই হোক না কেন, শারীরিক আঘাতের ঝুঁকি তৈরি করেছে; তাই সমর্থনযোগ্য নয়। আরেক দলের বক্তব্য বিদ্রূপাত্মক। যেমন ‘নাচতে নেমে ঘোমটা কেন?’ খেলতে এলে খেলার পোশাকেই আসা কাম্য।

এরই মধ্যে এক দল আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে বাংলাদেশে হিজাবের ব্যবহার অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে এবং সেটি সব ক্ষেত্রেই দৃশ্যমান। তাদের আশঙ্কা, এসবের অর্থ ধর্মীয় মৌলবাদ শিকড় গেড়ে বসছে। তারা মনে করে, বিষয়টি উদ্বেগজনক এবং এখনই নজরদারি দরকার। এই নিয়ন্ত্রণবাদী চিন্তার ধারাটি বিপজ্জনক। কারণ, এই অতি সরলীকৃত মনোভঙ্গি প্রচ্ছদ দেখে বই বিচারের মতো।

‘হিজাব বাড়ছে মানেই ধর্মীয় মৌলবাদ বাড়ছে’ অথবা ‘সন্দেহ ও নজরদারি দরকার’ ধরনের মনোভঙ্গি অতি সরল ও বিপজ্জনক। এমনিতেই সন্দেহ, নজরদারি ও নিবর্তনমূলক আইনের আতিশয্যে জনজীবন বিপর্যস্ত। এ অবস্থায় নতুন নিবর্তনমূলক ভাবনা প্রকাশের আগে সতর্কতা দরকার। বেশভূষা দেখেই কারও অবস্থান বিচার করা কূপমণ্ডূকতা। কুয়োর ব্যাঙের মতো কুয়াটাকেই সারা দুনিয়া ভেবে নেওয়ার চর্চা বন্ধ হোক।

*হেলাল মহিউদ্দীন: অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ এবং রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি