Thank you for trying Sticky AMP!!

রোজিনার মুক্তি এসেছে, পূর্ণ স্বস্তি আসেনি

মুক্তি পাওয়ার পর কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন রোজিনা ইসলাম। কাশিমপুর, গাজীপুর, ২৩ মে

অবশেষে সাংবাদিক রোজিনা ইসলাম কারাফটকের অন্তরাল থেকে মুক্ত আলো-হাওয়ার মধ্যে ফিরে এলেন। ফিরলেন তাঁর প্রাণপ্রিয় পরিবারের কাছে, ফিরলেন দেশের বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজের মধ্যে। সাংবাদিকের পেশাগত কাজে ১৭ মে সচিবালয়ে গেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী রোজিনাকে আটক করেন। সেখানে শারীরিক-মানসিক অবমাননাকর নিগ্রহের পর তাঁর একটি রাত কাটে শাহবাগ থানায়। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নথি চুরির অভিযোগে তাঁর নামে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট এবং দণ্ডবিধির ৩৭৯ ও ৪১১ ধারায় মামলা দায়ের হয়। পরদিন তাঁকে আদালতে পাঠানো হয়। এরপর গতকাল পর্যন্ত রোজিনার কেটেছে কাশিমপুর কারাগারে। অসুস্থ হয়ে পড়া রোজিনা এখন হাসপাতালে।

সাংবাদিক রোজিনা ইসলামকে নিগ্রহের এই পুরো সময়ে অভূতপূর্ব আরেকটি ঘটনাও ঘটেছে। ঘটনার শুরু থেকেই পুরো সাংবাদিক সমাজ প্রতিবাদে, বিক্ষোভে এবং রোজিনার মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে একাত্ম হয়ে পড়ে। জাতীয় প্রেসক্লাব, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশ সেক্রেটারিয়েট রিপোর্টার্স ফোরাম, বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামসহ রাজধানীর ও সারা দেশের সাংবাদিক সংগঠনগুলো সংহতিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। রোজিনা আটক থাকার প্রতিটা দিন, প্রায় সারাটা বেলা তাঁরা আন্দোলনে সজাগ ছিলেন। উদ্বেগ ও নিন্দা জানানোর পাশাপাশি রোজিনার মুক্তি দাবি করেছে সম্পাদক পরিষদ, নোয়াব ও এডিটরস গিল্ড।

শুধু সাংবাদিক সমাজের মধ্যেই এ প্রতিবাদ সীমিত থাকেনি। আন্দোলনের আগুন ছড়িয়ে গেল সবখানে। অন্যায়ের প্রতিবাদে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বুদ্ধিজীবী, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, শিল্পী ও সংস্কৃতিসেবীরা। দলমত-নির্বিশেষে সাংস্কৃতিক, পেশাজীবী ও নাগরিক সংগঠন, বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সংগঠন, ইউনিয়ন, রাজনৈতিক দল অকুণ্ঠচিত্তে ধারাবাহিকভাবে এ আন্দোলনে শামিল ছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপচে পড়েছিল রোজিনার প্রতি বাঁধভাঙা ভালোবাসা। সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নন্দিত তারকা থেকে সাধারণ মানুষ তাঁদের হৃদয় খুলে দিয়েছিলেন।

একটি ইস্যুতে দেশজুড়ে এমন অভূতপূর্ব ঐক্য শেষ কবে দেখেছি আমরা? আমরা অভিভূত, আমরা কৃতজ্ঞ। এই আন্দোলনে যুক্ত হওয়া প্রতিটি ব্যক্তি, সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানকে আমরা ধন্যবাদ জানাই।

সাংবাদিকতার কাজে গিয়ে আটক হওয়া রোজিনার জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। নিন্দা জানিয়েছে ও প্রতিবাদ করেছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টস (সিপিজে), অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ইনস্টিটিউট, রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজেএন), পিইএন বাংলাদেশ, সাউথ এশিয়ান উইমেন ইন মিডিয়াসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। খবর প্রকাশ করেছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রপত্রিকা ও তথ্যমাধ্যম। তাদের সবার প্রতি আমাদের গভীর কৃতজ্ঞতা।

হাসপাতালে রোজিনা ইসলামের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে তাঁর একমাত্র সন্তান আলভিনা ইসলাম। ঢাকা, ২৩ মে

রোজিনা ইসলাম জামিন পেয়েছেন, এই খবর আমাদের প্রাথমিক স্বস্তি দিয়েছে। তাঁর নামে দায়ের করা মামলাটি নিঃশর্তভাবে না তুলে নেওয়া পর্যন্ত আমরা পুরোপুরি নিঃশঙ্ক ও নিশ্চিন্ত হতে পারছি না। তাই বিষয়টির চূড়ান্ত সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত সাংবাদিকসহ সব মহলকে সজাগ থাকতে অনুরোধ করি।

রোজিনার মুক্তি আর তাঁর নামে দায়ের করা মামলা প্রত্যাহারের দাবিতে দেশে যে ঐক্যের উদ্বোধন হলো, তার পেছনে শুধু একজন ব্যক্তি সাংবাদিকই ছিলেন না; এর পেছনে ছিল বাক্‌স্বাধীনতা কিংবা আরও সুনির্দিষ্ট করে বললে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য মানুষের সুগভীর উৎকণ্ঠা ও আকুতি, সাহসী ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার প্রতি সবার স্বতঃস্ফূর্ত আস্থার বহিঃপ্রকাশ। এটিই আমাদের অসম্ভব ভরসা ও অসামান্য অনুপ্রেরণার জায়গা।

বাক্‌স্বাধীনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকারের অনুচ্ছেদটিতে গণমাধ্যম সম্পর্কে আলাদা একটি চরণ যুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ২(খ)-তে বলা হয়েছে, ‘সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।’ আমাদের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন সংবিধান-রচয়িতারা যেন এক সুদূর ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে ‘সংবাদক্ষেত্র’ শব্দটি সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। শুধু সংবাদপত্র নয়, যেকোনো ক্ষেত্রেই সংবাদ পরিবেশন করা হোক না কেন, আমাদের সংবিধান তা চর্চা করার অধিকারের নিশ্চয়তা দিয়েছে।

আমরা অসম্ভব উদ্বেগের সঙ্গে লক্ষ করে আসছি যে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, সাংবাদিকের সুরক্ষা এবং সাংবাদিকতার স্বাধীন চর্চা বিপন্ন করার করার মতো উপনিবেশ আমলের আইনগুলো তো বিলোপ করা হয়ইনি, স্বাধীন দেশে নিবর্তনমূলক নতুন নতুন আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে আছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ফৌজদারি কার্যবিধির মানহানিসংক্রান্ত ধারা, শপথ আইন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ইত্যাদি। বিভিন্ন সময়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদ এবং সরকারের সংশ্লিষ্ট পক্ষের নানা প্রতিশ্রুতির পরও সংবিধানের চেতনাবিরোধী এই আইনগুলো বহাল তবিয়তে থেকে গেছে এবং সংবাদপত্র, গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের ওপর তার অন্যায় প্রয়োগ অব্যাহত থেকেছে।

রোজিনা ইসলামের ঘটনায় দেশের মানুষের মধ্যে যে অভূতপূর্ব ঐক্যটি গড়ে উঠেছে, এই নিবর্তনমূলক আইনগুলোর বিলোপের মধ্য দিয়েই কেবল তা পূর্ণাঙ্গভাবে অর্থবহ হতে পারে।