শাকিব, যৌথ প্রযোজনা এবং চলচ্চিত্রের ফাঁড়া
যৌথ প্রযোজনার নামে যৌথ প্রতারণার অভিযোগে আন্দোলনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পরিবার। বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে চলচ্চিত্রশিল্পে জড়িত মানুষসহ দর্শকমহলেও। এর পরিপ্রেক্ষিতে যৌথ প্রযোজনা ও চলচ্চিত্রশিল্পের নানা দিক নিয়ে কথা বলেছেন চিত্রনায়িকা কবরী ও প্রযোজক হাবিবুর রহমান। গ্রন্থনা করেছেন মনজুর কাদের
ব্যক্তিস্বার্থ খেয়ে ফেলছে চলচ্চিত্র শিল্পকে
কবরী
এখন যারা আন্দোলন করছে ওদের আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তোমরা আন্দোলন কেন করছ?
উত্তরে বলেছে, যৌথ প্রযোজনার অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা আন্দোলন করছি।
জিজ্ঞেস করি, তাহলেই কি সিনেমার সব সমস্যার সমাধান হবে?
কোনো উত্তর না পেলেও আমি মনে করি হবে না। আমাদের আগে এফডিসি সচল করতে হবে। সিনেমা প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। আমাদের মধ্যে যারা বাইরের সিনেমা করছে করুক। এফডিসি নামে আমাদের যে একটা প্রতিষ্ঠান, এটা নিয়ে সবার আগে ভাবতে হবে।
আমার কথা হলো, কেন ইনু সাহেব (তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু) সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বসছেন না।
ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে অনুরোধ করেছিলাম, আপনি শুধু বারবার বলেন, এফডিসির উন্নয়নের জন্য এত টাকা দিলাম, কেউ তো তা খরচ করতেই পারল না।
আমি বিনয়ের সঙ্গে জানতে চাই, কাকে দিয়েছেন টাকাগুলো?
কার মাধ্যমে দিয়েছেন?
কার সামনে দিয়েছেন?
কত টাকাই বা দিয়েছেন?
আমি বারবার বলেছি, এফডিসির সার্বিক ব্যাপারে দেখভাল করার জন্য উচ্চপর্যায়ের একটা কমিটি করতে।
এমন লোককে রাখা হয় যাঁরা ইনু সাহেবের অনুগত। এঁরা কারা, এঁদের নাম বলতে চাই না। এটা সবাই জানেন।
হেদায়েতুল্লাহ মামুন যখন তথ্যসচিব ছিলেন, তখনো একটা মিটিং করেছিলাম। সেখানে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি নিয়ে অনেক কথা বলেছিলাম। সমস্যা সম্ভাবনা সবই আলোচনায় এসেছিল। এরপর তিনি আর আমাদের সঙ্গে বসেননি। সমাধানও করেননি। নতুন কোনো উদ্যোগও নেননি। ইতিমধ্যে তিনি এখন অন্য দপ্তরে চলে গেছেন।
মন্ত্রী মহোদয় তো অনেক কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। তিনি যদি আমাদের সঙ্গে বসার সময় না পান, তাহলে তো সচিব সাহেবও বসতে পারেন। তিনি আপিল বোর্ডের সেক্রেটারি। তাঁর সঙ্গে বসে আমরা সিনেমার সমস্যাগুলো নিয়ে কথা বলতে পারি। করণীয় কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে সিদ্ধান্তেও আসতে পারি।
এর আগের মেয়াদে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক বছর পরই ৩ এপ্রিল দিনটিকে চলচ্চিত্র দিবস ঘোষণা করা হয়। এই দিবসে করণীয় কী হওয়া উচিত, এটা কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত কেউ কিছু জানে না। এখানে শুধু সবাইকে দাওয়াত দিচ্ছে, বক্তৃতা করছে, নাচ-গান করছে, যেমন খুশি তেমন করছে। কিন্তু চলচ্চিত্রের উন্নয়নে কিছুই হচ্ছে না।
চলচ্চিত্র দিবসকে কেন্দ্র করে তো জ্যেষ্ঠ শিল্পীদের সমন্বয়ে একটা কমিটি থাকা দরকার। এর মধ্যে রাজ্জাক, ফারুক, আলমগীর, সোহেল রানাসহ জ্যেষ্ঠ শিল্পীরা থাকবেন। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, আমাদের নিজেদের মধ্যেও বিভাজন আছে। আমরা সমষ্টিগত স্বার্থ ভুলে যাই। ব্যক্তিস্বার্থটাকে প্রাধান্য দিই। সবাই চুপি চুপি মন্ত্রীর অনুগত হওয়ার চেষ্টায় থাকি। সবার জ্ঞাতার্থে বলতে চাই, একজন মানুষ দিয়ে কখনোই সংগঠন চলতে পারে না। সংগঠন করতে সাংগঠনিক মানুষ লাগবে। তার মধ্যে সবাই মিলেমিশে থাকতে হবে।
এবার আসছি অনুদানের সিনেমা প্রসঙ্গে। কারা পাচ্ছেন এই অনুদান? একবার তো বলা হয়েছিল, যাঁরা একবার পেয়েছেন তাঁরা আর দ্বিতীয়বার পাবেন না। পরে আবার দ্বিতীয়বারের পর্যন্ত বিষয়টি শিথিল করা হয়। তোষামোদকারী অনেকে দুইবার বা তারও বেশিবার অনুদান পাচ্ছেন। মূলধারার নির্মাতারা দেখি কোনো অনুদান পান না। অনুদানের টাকাও দিয়ে দেওয়া হচ্ছে বাইরের পরিচালকদের। অনুদানের এসব সিনেমার কোনো হিসাব নেই। সব সময় কথা হয় কিন্তু মূলধারার সিনেমা নিয়ে। মূলধারার সিনেমার পরিচালকদের সরকার কোনো পৃষ্ঠপোষকতাও করতে চায় না। একসময় কিন্তু এই মূলধারার সিনেমাই আলোচনায় ছিল। আমাদের দেশে যেসব কালজয়ী সিনেমা তৈরি হয়েছে তা এখনো মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখে। এসব বানিয়েছেন এফডিসি ঘরানার নির্মাতারাই। সেই এফডিসিতে এখন সিনেমা উৎপাদন হচ্ছে না। তাহলে এত কথা বলার দরকারই বা কী আছে।
আজ জাজ মাল্টিমিডিয়া নিয়ে নানা কথা হচ্ছে। তারা নাকি সারা দেশের সিনেমা হল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। আমি বলতে চাই, সিনেমা হলমালিকেরা কেন বহিরাগতদের ঢুকতে দিয়েছেন। এখানকার প্রযোজক যাঁরাই আছেন, তাঁরা কেন এসব ভাবছেন না। আমাদের ইন্ডাস্ট্রির কী হবে, সেটা নিয়ে কেউ একসঙ্গে বসছেন না কেন? খসরু (খোরশেদ আলম খসরু) যে দাদাগিরি করছে, সেই-বা সিনেমার জন্য কী করছে? তার সিনেমা তো সেন্সর বোর্ড ও আপিল বোর্ড বাতিল করেছিল।
আমরা ভারতীয় সিনেমা আমদানির বিপক্ষে। কিন্তু আমরা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্বের বিপক্ষে নই। তারা আমাদের প্রতিবেশী, একাত্তরের বন্ধু, এটা আমরা সব সময় মনে রাখব। তাদের ইন্ডাস্ট্রি ১০০ বছরের পুরোনো। তাদের অভিনয়শিল্পী, গানের শিল্পীসহ সিনেমার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ মানুষই আমাদের চেয়ে অভিজ্ঞ এবং অনেক বেশি পেশাদার। সেখানে অভিনয় শেখা ও নির্মাণবিষয়ক নানা স্কুল-কলেজ আছে। মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়, তপন সিনহা, ঋত্বিক ঘটকের মতো ভারতীয় অনেক নির্মাতা সিনেমা দিয়ে সেখানকার রাজনীতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশ্বস্বীকৃতি লাভ করেছেন। আমরা কি তা পারছি?
কোথায় আমাদের রাজনীতি, কোথায় আমাদের অর্থনীতি, কোথায় আমাদের শিক্ষা, কোথায় আমাদের সংস্কৃতি? আমাদের সিনেমা দেশ স্বাধীনের আগেই কিন্তু অনেক ভালো ছিল। রমরমা একটা অবস্থা ছিল। আমাদের সিনেমার গোল্ডেন জুবিলি ও সিলভার জুবিলি পালন করা হতো। বিভিন্ন দেশের উৎসবে আমাদের মূলধারার অভিনয়শিল্পী ও নির্মাতাদের আমন্ত্রণ জানানো হতো। দেশ স্বাধীনের এত বছর পর যেখানে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি আরও ওপরে ওঠার কথা, সেখানে এই সময়ে এসে স্ট্যান্ডার্ডে উঠতে পারছে না।
শাকিব খান শিকারি ও নবাব দিয়ে নতুন করে আলোচনায় এসেছে। আমি বলব, ভারতের সিনেমাতে যদি সে সুযোগ পায় ভালো, কিন্তু দেশের সিনেমার বৃহত্তর স্বার্থেও তার কথা বলা উচিত। তার একটা অবস্থানও তৈরি হয়েছে। আজকে ওর কিছু ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথার কারণে শিল্পীদের মধ্যে একটা অংশ তার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তার কথা বলায় আরও সংযত হওয়া উচিত। শাকিব তো এখন সুপার-ডুপার। আর ওদিকে কলকাতায় দেব-জিৎ এরা। শাকিব যদি ওখানে সিনেমা করে তাহলে তো সিনেমা নিয়ে যা ব্যবসা হচ্ছে তাতে আমরা লাভ পাচ্ছি কম। টাকা ভাগাভাগির প্রক্রিয়াটাও স্বচ্ছ থাকতে হবে।
সরকারের সঙ্গে চলচ্চিত্রশিল্পের একটা ভুল-বোঝাবুঝি হচ্ছে। সরকার যদি মনেই করে মূলধারার মানুষেরা সিনেমা বানাতে পারে না, তাহলে ইন্ডাস্ট্রি বন্ধ করে দিক। শিল্পীদের রাস্তায় নেমে আন্দোলন, একে অপরকে লাঞ্ছিত করা, মারামারি-এসব তো দেশের বদনাম। এতে শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছেও বলা যেতে পারে। আমরা যদি আমাদের জন্য না কাঁদি, তাহলে সরকারের সঙ্গে কি মারামারি করব। তবে আমি আশা করব, সরকার যেন এ বিষয়ে সুদৃষ্টি দেয়। আমাদের উচিত সরকারের সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি বসা।
নীতিমালা না মেনেও তারা পারছে কী করে?
হাবিবুর রহমান
বর্তমানে যৌথ প্রযোজনা যেভাবে হচ্ছে, এ বিষয়ে আমার কিছুই বলার নেই। আমি মনে করি, সরকার যৌথ প্রযোজনার যে নীতিমালা করে দিয়েছে, সেটা সবাইকে মেনে চলতে হবে। এই নিয়মের বাইরে যাওয়ার সাধ্য তো আমাদের কারোরই থাকার কথা না। তবে টেকনিক্যাল কারণে সমান সমান করা সম্ভব না হলে ৬০ বনাম ৪০ হতে পারে। সব সময় তো সবকিছু আর সমান ভাগে করা যায় না। সিনেমা এখন যাঁরাই বানাচ্ছেন, তাঁরা কেউ যৌথ প্রযোজনার নিয়মনীতি মানছেন না। কারণ নীতিমালা না মানলেও তাঁদের চলে।
দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশ ও ভারতের বেশ কটি যৌথ প্রযোজনার ছবি নির্মাণ করেছে আশীর্বাদ চলচ্চিত্র। এই প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের প্রথম যৌথ প্রযোজনার সিনেমা ‘অবিচার’। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, ‘পদ্মা নদীর মাঝি’র মতো কালজয়ী সিনেমাও উপহার দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠান। আমাদের শেষ ছবিটি ছিল ‘শঙ্খচিল’। আমাদের এখানে যেমন ল্যাবের কাজটা ভালো হয় না। তাই আমি সেসব কাজ বাইরে থেকে করিয়েছি। যৌথ প্রযোজনার সিনেমার শুটিংয়ের ক্ষেত্রে দুই দেশের বাইরে তৃতীয় কোনো দেশেও যদি শুটিং করতে হয়, তা-ও সরকারের অনুমতি লাগবে। কিন্তু এখন যৌথ প্রযোজনার নামে যা চলছে, এটাকে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই দেখছি না। আমি যদি কারও সঙ্গে কোনো চুক্তি করে তা পালন না করি, তাহলে সেটাকে তো প্রতারণাই বলব।
সব সিনেমাই নীতিমালার বাইরে থেকে তৈরি হচ্ছে, আবার সব সিনেমাই মুক্তি পাচ্ছে। আমি যতগুলো সিনেমা যৌথ প্রযোজনায় বানিয়েছি সরকারের নীতিমালা মেনেই করেছি। আর সামনেও যদি বানাই, তবে নিয়ম মেনেই বানাব। বাংলাদেশে এখন যে প্রতিষ্ঠানটি যৌথ প্রযোজনার সিনেমা বানাচ্ছে তারা খুবই চৌকস। তারা সবকিছুই ম্যানেজ করতে পারছে। তা না হলে এভাবে দিনে পর দিন কাজ করছে কীভাবে?
আমার ৪৮ বছরের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে, সিনেমার লোক কখনোই সিনেমার ভালো চায় না। সবাই ব্যক্তিস্বার্থে দৌড়ায়। সিনেমা বানানোর পর মুক্তির ঠিক আগে সিনেমার ১০% এর মালিকানা তৃতীয় পক্ষ নিয়ে যাবে। অথচ এই সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে তাঁর ১০ পয়সাও অবদান নাই। বুকিং দিতে এসে সে নিয়ে গেল। এটার কোনো আইন আছে! আমি অনেককেই এটা বলেছি। বৃহত্তর স্বার্থ আমরা কেউ দেখি না। বৃহত্তর স্বার্থে সবাইকে এক হতে হবে।
হাবিবুর রহমান: স্বত্বাধিকারী-আশীর্বাদ চলচ্চিত্র
আরও পড়ুন
-
অস্ত্রোপচার আজও হয়নি, শুরু হতে পারে আগামীকাল
-
যুক্তরাষ্ট্রে দুর্বৃত্তের গুলিতে ছেলের মৃত্যু, কান্না থামছে না মা–বাবার
-
সাকিবের সঙ্গে দেখা করলেন প্রতিদ্বন্দ্বী দুই প্রার্থী, মুহূর্তেই ছবি ভাইরাল
-
মোস্তাফিজের এবারের আইপিএল: সাবেক দলের বিপক্ষে উইকেট যে কারণে কম
-
রাজধানীর তাপমাত্রা আরও বাড়ল, চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ