Thank you for trying Sticky AMP!!

ভূমিকম্পের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা কতটা প্রস্তুত

প্রকৃতির কাছে মানুষ কতটা অসহায়, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেন তার চরম উদাহরণ। বড় ধরনের ভূমিকম্প কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা এর আগে আমরা জাপান, চীন কিংবা নেপালে দেখেছি। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে তুরস্ক ও সিরিয়ায় ৭.৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়। এই ভূমিকম্পে দেশ দুটির কিছু এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। প্রায় ৫০ হাজার মানুষ প্রাণ হারায়।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাংলাদেশে ছোট আকারের বেশ কয়েকবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে দেশে এক মাঝারি মানের ভূমিকম্প অনুভূত হয়, রিখটার স্কেলে যার তীব্রতা ছিল ৫.৬ এবং কেন্দ্র ছিল লক্ষ্মীপুরে।

গত ১০০ বছরে এই অঞ্চলে বড় কোনো ভূমিকম্প না হওয়ায় ভূকম্পনবিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, যেকোনো সময় মারাত্মক ভূমিকম্প হতে পারে। শুধু  ২০২১ সালে সিলেট শহরে ছোট আকারে সাত থেকে আটবার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। স্বাভাবিকভাবেই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে এই এলাকার মানুষ। ভূতত্ত্ববিদেরা বিভিন্ন সময় বলে আসছেন, ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের মধ্যে সিলেটসহ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার শহরগুলো বেশ ঝুঁকিপূর্ণ,  ঢাকা শহর আছে ঝুঁকির দ্বিতীয় স্তরে এবং দক্ষিণাঞ্চল আছে সবচেয়ে কম ঝুঁকির মধ্যে।

বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্বব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এক গবেষণায় দেখা গেছে, টাঙ্গাইলের মধুপুর ফল্টে (টেকটোনিক ফল্ট) দিনের বেলা ৬ দশমিক ৯ মাত্রার একটি ভূমিকম্প সংঘটিত হলে রাজধানীতে কমপক্ষে ৮ লাখ ৬৪ হাজার ৬১৯টি ভবন ধসে পড়তে পারে। প্রাণ হারাতে পারে ২ লাখ মানুষ। অন্যদিকে সিলেটের ফল্ট লাইনে দিনের বেলা ৭ দশমিক ১ মাত্রার একটি ভূমিকম্প হলে কমপক্ষে ৪০ হাজার ৯৩৫ ভবন ধসে পড়তে পারে। ১৬ হাজার মানুষের মৃত্যু হতে পারে।

তবে বিশেষজ্ঞদের ধারণা অনুযায়ী, সবচেয়ে বিপজ্জনক হচ্ছে সিলেটের ডাউকি ফল্ট। এই ফল্টে বারবার ছোট ছোট ভূমিকম্প অনুভূত হওয়া বেশ আতঙ্কের। বাংলাদেশ তিনটি টেকটোনিক প্লেটের মুখে অবস্থিত। ভূতত্ত্ববিদদের মতে, ইন্ডিয়ান, বার্মা প্লেট ও ইউরেশিয়ান প্লেটের মুখে থাকা বাংলাদেশের কিছু কিছু ফল্ট জোন সক্রিয় থাকায় যেকোনো সময় ঘটতে পারে মাঝারি কিংবা বড় আকারের ভূমিকম্প।

ভূমিকম্পবিশেষজ্ঞ সৈয়দ হুমায়ুন আক্তারের মতে, এই অঞ্চলের ফল্ট লাইনে যে পরিমাণ শক্তি সঞ্চিত আছে, তাতে করে রিখটার স্কেলে ৮ মাত্রার অধিক ভূমিকম্প হতে পারে। এতে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিরও আশঙ্কা আছে। ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকা আরেক দেশ নেপালে ২০১৫ সালের এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখ ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প হয় এবং প্রায় আট হাজার মানুষ এই ভূমিকম্পে প্রাণ হারান ও প্রায় ১৮ হাজার মানুষ আহত হন।

এই ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোও। এই ভূমিকম্পে বাংলাদেশে ৪ জন মানুষ প্রাণ হারান এবং ধসে পড়ে কয়েকটি ভবন। পরদিন ২৬ এপ্রিল ৬ দশমিক ৭ মাত্রার আরও একটি ভূমিকম্প আঘাত হানে নেপালে। এই ভূমিকম্পে নেপালের অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস হয় এবং ইউনেসকো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনমনে আতঙ্ক–উৎকণ্ঠার পাশাপাশি ভূমিকম্প–পরবর্তী শোক কাটিয়ে উঠতে অনেক দিন সময় লেগে যায় হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত দেশটির।

চলতি বছর ৫ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প হয়েছে তিনবার, যা কিনা ১০ বছরের মধ্যে হওয়ার কথা। এ রকম পরিস্থিতিতে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ বিদ্যমান। বিশেষজ্ঞদের মতে, বড় কোনো ভূমিকম্প হওয়ার আগে ছোট ছোট ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। সিলেটসহ সাম্প্রতিক সময়গুলোতে ছোট কিংবা মাঝারি আকারে হওয়া ভূমিকম্প তাই আমাদের জন্য অশনিসংকেত। ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশে তাই যেকোনো সময় ঘটতে পারে বড় ধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়। আর ভূমিকম্প এমনই এক প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যা কখনো পূর্বপ্রস্তুতির সুযোগ দেয় না।

দেশের বিশেষজ্ঞরা অনেক দিন ধরেই কাঠামো ও অবকাঠামোগুলোর উন্নতির কথা বলছেন, পাশাপাশি সঠিকভাবে বিল্ডিং কোড মেনে বাড়ি নির্মাণের পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে শহর এলাকা, বিশেষ করে ঢাকা শহরে যেভাবে পরিকল্পনাহীনভাবে বিল্ডিং তৈরি হয়েছে, তাতে মাঝারি কিংবা বড় কোনো ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হবে বলে ধারণা করেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাকিব হাসানের মতে, ভূমিকম্পের ঝুঁকি হ্রাস করার মূল অস্ত্র হচ্ছে বিল্ডিং কোড মেনে চলা।

কেবল বিল্ডিং কোড থাকলেই হবে না, প্রয়োজন এর সফল ও সঠিক প্রয়োগ।
নেপালের ওই ভূমিকম্পের পর বাংলাদেশে সরকারিভাবে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। যদিও তা বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সক্ষমতা যদিও আগের চেয়ে বেড়েছে, তারপরও এ রকম এক ঘনবসতিপূর্ণ দেশে ভূমিকম্প–পরবর্তী উদ্ধারাভিযানের জন্য তা কতটুকু কার্যকর হবে, বলা কঠিন। লক্ষাধিক স্বেচ্ছাসেবককেও প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে বলে জানানো হয় কর্তৃপক্ষ থেকে।

সিলেটের এই ঘন ঘন মৃদু ভূকম্পনকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, নেপাল ভূমিকম্পের পর নেওয়া উদ্যোগগুলোকে বাস্তবায়ন করতে হবে। নতুন করে প্রস্তুত রাখতে হবে কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবকদের। ভূমিকম্প–পরবর্তী উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি ক্রয় ও সংরক্ষণ করে রাখতে হবে। জাপান ও চীনের মতো দেশের সঙ্গে তাদের অভিজ্ঞার আলোকে প্রস্তুতি নিতে হবে আমাদের। মনে রাখতে হবে, ভূমিকম্পের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব নয়। তবে আগাম প্রস্তুতিতে কমানো যেতে পারে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ।

  • কে এম মাসুম বিল্লাহ কর্মকর্তা, জনতা ব্যাংক পিএলসি, পটুয়াখালী এরিয়া অফিস