Thank you for trying Sticky AMP!!

দলীয় কোন্দল ও পারিবারিক পরিচিতি ডুবিয়েছে আঞ্জুমকে

আওয়ামী লীগের বিভক্তিই কুমিল্লায় নৌকার পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন দলটির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। তাঁদের মতে, এই পরাজয় কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের বিভক্তি আরও বাড়াবে।
এর বাইরে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমার পারিবারিক পরিচিতিও পরাজয়ের একটা মূল কারণ বলে মনে করছেন স্থানীয় লোকজন।
তবে আওয়ামী লীগের নেতারা এ-ও বলছেন, এই নির্বাচনে সরকারের জন্য ইতিবাচক বিষয় হলো, শেখ হাসিনার অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, এটা প্রমাণিত হলো। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আঞ্জুম সুলতানার পরাজয়ের কারণ বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থা নিতে হবে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার ভোট গ্রহণ শেষে দলীয় প্রার্থীর পরাজয় নিশ্চিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরসহ কেন্দ্রীয় কয়েকজন নেতা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে দেখা করেন। কুমিল্লায় পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল কাজ করেছে এমন আলোচনা হয়েছে।
কুমিল্লার নির্বাচনে দলের পক্ষ থেকে তদারকের দায়িত্ব পালন করা সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, অভ্যন্তরীণ সমস্যা একটা বড় কারণ। তিনি সব কারণ অনুসন্ধান করছেন এবং দলীয় প্রধানকে প্রতিবেদন দেবেন।
গতকাল শুক্রবার ঢাকায় আলাদা দুটি অনুষ্ঠানে কুমিল্লায় পরাজয়ের জন্য অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে দায়ী করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ।
কুমিল্লা আওয়ামী লীগের সূত্রগুলো জানায়, আফজল খান পরিবারের সবাই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতিতে তাঁরা কখনোই সুবিধা করতে পারেননি। ২০১২ সালে আফজল খান নিজে কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুর কাছে বিপুল ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হন। এর দুই বছরের মাথায় ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান আফজল খানের ছেলে মাসুদ পারভেজ খান।
এর আগে আফজল খান একবার জাতীয় সংসদে ও দুবার পৌরসভা নির্বাচনে হারেন। এই পরিবারে জয়ের রেকর্ড আছে কেবল আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানার। তিনি একবার উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান এবং পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে একবার করে সংরক্ষিত কাউন্সিলর নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি প্রথম হারলেন মেয়র পদে।
অবশ্য আঞ্জুম সুলতানা প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘পরিবার কোনো ফ্যাক্টর নয়। আমি এর আগে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন নির্বাচনে তিনবার জিতেছি।’
আঞ্জুম সুলতানা গতকাল ফেসবুকে এক স্ট্যাটাসে তাঁর পরাজয়ের জন্য আওয়ামী লীগের ‘কিছু ব্যক্তিবিশেষের’ ষড়যন্ত্রকে দায়ী করেন। এই ষড়যন্ত্রকারী কারা—জানতে চাইলে আঞ্জুম সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এটা সময় হলে বলব।’
আওয়ামী লীগের এমন একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভী নৌকাকে অনেক দূর এগিয়ে দিয়েছিলেন। দল ছিল তাঁর সহযোগী। কিন্তু কুমিল্লায় দলের ওপর দায়িত্ব ছিল বেশি।
আরেকজন কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, কিছু কেন্দ্রে প্রকাশ্যে সিল দেওয়া হয়েছে। জয়ী হলে সমস্যা হতো না। কিন্তু এত কিছুর পরও পরাজয়ে বোঝা গেল প্রার্থী ও দলের অবস্থান কোন জায়গায়।
অবশ্য কুমিল্লা আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন, এই নির্বাচনে আঞ্জুম সুলতানার অনেক ইতিবাচক দিক খোঁজার সুযোগ আছে। আফজল খান হেরেছিলেন ২৯ হাজারেরও বেশি ভোটের ব্যবধানে। আর একই প্রার্থীর কাছে আঞ্জুম হেরেছেন ১১ হাজার ভোটের ব্যবধানে। ২০১২ সালের সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আফজল খান পেয়েছিলেন ৩৬ হাজার ৪৭১ ভোট। আর এবার আঞ্জুম সুলতানা পেয়েছেন ৫৭ হাজার ৮৬৩ ভোট। অন্যদিকে বিএনপির মনিরুল হকের ভোট বেড়েছে মাত্র তিন হাজারের কিছু বেশি।
পুরোনো কোন্দল
কুমিল্লা সদর আসনের সাংসদ আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের সঙ্গে আফজল খানের দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের। এই দ্বন্দ্ব অতীতে সংঘাতে রূপ নিয়েছে বহুবার। আফজল খানের বয়স হয়েছে। এখন তাঁর রাজনীতির উত্তরাধিকার মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা ও ছেলে মাসুদ পারভেজ। আফজল ও বাহারের সেই পুরোনো দ্বন্দ্ব উত্তরাধিকারের মধ্যেও বহমান।
এর প্রভাব দেখা গেছে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও। ওই নির্বাচনে কুমিল্লা সদর আসনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পান আ ক ম বাহাউদ্দিন। বিদ্রোহী প্রার্থী হন মাসুদ পারভেজ। বাহার ২১ হাজার ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। এবার সিটি নির্বাচনে বাহার প্রকাশ্যে আঞ্জুম সুলতানার পক্ষে কাজ করার ঘোষণা দেন। কিন্তু বাহারের সঙ্গে বিএনপির মেয়র মনিরুল হকের সখ্য কুমিল্লায় সর্বজনবিদিত। ফলে বাহাউদ্দিনের কর্মীদের সর্বাত্মক চেষ্টা না করার অভিযোগ রয়েছে স্থানীয় ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে ১০৩টি কেন্দ্রে ভোট হয়েছে। দুটি স্থগিত আছে। ফলাফল বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, নগরের উত্তরাঞ্চলের ৭২টি কেন্দ্রের মধ্যে ২৫টিতে নৌকা পাস করেছে। এই কেন্দ্রগুলো সাংসদ বাহাউদ্দিনের নির্বাচনী এলাকায়।
আ ক ম বাহাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, দলে মান-অভিমান আছে। তবে নৌকা প্রতীক পাওয়ার পর সবাই কাজ করেছে। কিন্তু কর্মীদের মধ্যে যতটা সমন্বয় করার দরকার ছিল, তা হয়নি। তিনি দাবি করেন, তাঁর নির্বাচনী এলাকায় ২০১২ সালে মেয়র প্রার্থী আফজল খান বিএনপির প্রার্থী মনিরুল হকের চেয়ে ২৮ হাজার ভোট কম পেয়েছিলেন। এবার আঞ্জুম সুলতানা চার হাজার ভোট কম পেয়েছেন।
বিএনপির মনিরুল হকের সঙ্গে সখ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে বাহাউদ্দিন বলেন, ‘এটা তো রাজনৈতিক শিষ্টাচার। ২০১৩ ও ২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত পেট্রলবোমা সন্ত্রাস করার সময় আমি তো মেয়রের হাতে পেট্রল তুলে দিইনি। আমি তাদের সন্ত্রাস প্রতিরোধ করেছি।’
দলীয় সূত্রগুলো জানায়, কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি হলেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আর সাধারণ সম্পাদক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক। কিন্তু কুমিল্লা শহরের রাজনীতিতে প্রভাব বেশি বাহাউদ্দিন ও আফজল খানের পরিবারের। বাহাউদ্দিনের সঙ্গে দুই মন্ত্রীর সম্পর্ক কখনো ভালো, কখনো খারাপ থাকে। আফজল খানের সঙ্গেও সম্পর্কটা মধুর নয়। তবে এবার সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে আঞ্জুম সুলতানার পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন দুই মন্ত্রী। তাঁকে জয়ী করার জন্য মাঠেও নেমেছিলেন।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের দক্ষিণ অংশের ২৯টি কেন্দ্রের মধ্যে ৯টিতে নৌকা পাস করেছে। এই এলাকার সাংসদ হচ্ছেন পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। মন্ত্রীর হয়ে তাঁর ভাই কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার এই অংশে আঞ্জুম সুলতানার নির্বাচন দেখভাল করেছেন।
আ হ ম মুস্তফা কামাল প্রথম আলোকে বলেন, বিভিন্ন ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের একাধিক কাউন্সিলর দাঁড়ানোর কারণে সমস্যা হয়েছে। আওয়ামী লীগের কাউন্সিলররা যত ভোট পেয়েছেন, নৌকা তত ভোট পায়নি। তাঁর দাবি, কোন্দলের কারণেই নৌকা হেরেছে, এটা বলা যাবে না।
পরাজয়ের জন্য প্রার্থীর পারিবারিক পরিচিতি একটা কারণ বলে অনেকে মনে করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুস্তফা কামাল বলেন, প্রার্থী খুব ভালো, স্বচ্ছ ইমেজের। পরিবারটি নিয়ে দীর্ঘদিনের একটা ধারণা তৈরি হয়েছে। তবে এখন তা কেটে গেছে।