Thank you for trying Sticky AMP!!

নিয়মনীতি মানা হয়নি, অর্থের সংস্থানও নেই

>

*একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য প্রকল্প নেয় ইসি
*গত ১৮ সেপ্টেম্বর একনেক বৈঠকে এই প্রকল্প অনুমোদিত হয়
*দেড় লাখ ইভিএম কেনার প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা
*তড়িঘড়ি উদ্যোগ নেওয়ায় ইভিএম কেনার টাকার সংস্থান নেই
*ইভিএম কেনার টাকার জন্য এখন চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছে

আইন অনুযায়ী ১০০ কোটি বা তার বেশি টাকার পণ্য কিনতে গেলেই সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু সরকার আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) কিনছে ক্রয় কমিটির অনুমোদন ছাড়াই। এমনকি ক্রয় কমিটিতে ইভিএম কেনার প্রস্তাব উপস্থাপনই করা হয়নি।

সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির কার্যপরিধি বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২০১৬ সালের ৭ নভেম্বর জারি করা প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে সরকারি দপ্তরগুলোর এককভাবে ১০০ কোটি টাকার বেশি পূর্ত কাজ ও ভৌত সেবা এবং পণ্য, যন্ত্রপাতি, সরঞ্জামাদি ও সেবা কেনা ও চুক্তির ক্ষেত্রে ক্রয় কমিটির অনুমোদন লাগবে। একই বছরের ৬ ডিসেম্বর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের জারি করা পরিপত্রও বলছে, ১০০ কোটির বেশি টাকার কাজ হলেই সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন নিতে হবে।

আবার তড়িঘড়ি করতে গিয়ে ইভিএম কেনার টাকার সংস্থানও সরকার করেনি। ফলে ইভিএম কেনার টাকার জন্য এখন অর্থ মন্ত্রণালয়, পরিকল্পনা কমিশন ও নির্বাচন কমিশনের মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও দুই কমিশন এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সূত্রে এসব কথা জানা গেছে।

নির্বাচন কমিশন গত অক্টোবরে ইভিএম কেনার টাকা চায় প্রথমে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে। হঠাৎ এই চাহিদা আসায় অর্থ মন্ত্রণালয় কোনো জবাবই দেয়নি। নির্বাচন কমিশন পরে টাকা চায় পরিকল্পনা কমিশনের কাছে। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন জানায়, তাদের কাছে টাকা নেই। পরিকল্পনা কমিশন এ ব্যাপারে শরণাপন্ন হয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের। অর্থ মন্ত্রণালয়ও পরিকল্পনা কমিশনকে জানিয়ে দেয়, তাদের কাছেও টাকা নেই।

আসন্ন একাদশ সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের জন্য একটি প্রকল্প হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন। প্রকল্পের নাম ‘নির্বাচন ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রয়োগের লক্ষ্যে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে গত ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে এই প্রকল্প অনুমোদিত হয়। দেড় লাখ ইভিএম কেনার এ প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা, আর বাস্তবায়নের মেয়াদ ধরা হয় গত ১ জুলাই থেকে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত। বলা হয়, ইভিএম কেনা হবে সরকারি কোষাগারের টাকায়।

আবার প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে ইভিএম কেনার কথা বলা হয়েছে। টাকা বরাদ্দ ছাড়াই চীন ও হংকং থেকে ইভিএমের মূল যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ আমদানির কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি (বিএমটিএফ)। বাংলাদেশ ব্যাংক বেসরকারি ট্রাস্ট ব্যাংকের মাধ্যমে এই ইভিএম আমদানির ঋণপত্র (এলসি) খোলার অনুমোদনও দিয়েছে।

একদিকে ক্রয় কমিটির অনুমোদন ছাড়া বিপুল পরিমাণ টাকায় ইভিএম কেনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, অন্যদিকে উদ্যোগটি নেওয়া হয়েছে টাকার সংস্থান ছাড়াই। কারণ কী—এমন প্রশ্নের জবাবে গতকাল বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এটা ক্রয় কমিটিতে আসার দরকার নেই। প্রকল্পটির একটি কমিটি ওইভাবে অনুমোদন দিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু ১০০ কোটি টাকার বেশি হলে ক্রয় কমিটিতে আসতেই হবে, এটাই আইন—এ বিষয়ে জানতে চাইলে হেলালুদ্দীন বলেন, সরকার থেকে সরকার কিনলে তা লাগে না। সরকার থেকে সরকার মানে বাংলাদেশ সরকার থেকে চীন সরকার বোঝাচ্ছেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, না। সরকারি একটি প্রতিষ্ঠান থেকে আরেকটি প্রতিষ্ঠান।

সচিব হেলালুদ্দীন আরও ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে যে পরিমাণ টাকার চাহিদা যাবে, অর্থ মন্ত্রণালয় তা বিএমটিএফকে দিয়ে দেবে। টাকা আমাদের কাছেও আসবে না।’

টাকার জন্য চিঠি চালাচালি
একনেকে অনুমোদনের এক মাস পর গত ১৭ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন ১ হাজার ৯৯৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা চেয়ে চিঠি পাঠায় পরিকল্পনা কমিশনে। চিঠিতে প্রকল্পটির অনুকূলে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ‘বিশেষ প্রয়োজনে উন্নয়ন সহায়তা’ খাত থেকে অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়।

পরিকল্পনা কমিশনের কার্যক্রম বিভাগ ১২ দিন পর গত ২৯ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সচিব আবদুর রউফ তালুকদারকে জানায়, চলতি অর্থবছরে ‘বিশেষ প্রয়োজনে অর্থ সহায়তা’ খাতে বরাদ্দ ছিল ৫৪৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা। এই টাকা কয়েকটি প্রকল্পে এরই মধ্যে বরাদ্দ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। সুতরাং, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প হওয়া সত্ত্বেও চলতি অর্থবছরের এডিপিতে ১ হাজার ৯৯৮ কোটি ৯৩ লাখ টাকা সংকুলান করার সুযোগ নেই।

ইভিএম কেনায় নির্বাচন কমিশনের চাহিদা পূরণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বরং অর্থসচিবকে অনুরোধ জানায় পরিকল্পনা কমিশন। দুই দিনের মাথায় গত ৩১ অক্টোবর এক চিঠিতে অর্থ বিভাগও পরিকল্পনা কমিশনকে জানিয়ে দেয়, অর্থ বিভাগ থেকে কোনো বিশেষ প্রকল্পের অনুকূলে বরাদ্দ দেওয়ার রেওয়াজই নেই। চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয় নির্বাচন কমিশনকেও।

অর্থ বিভাগ অবশ্য ইভিএম কেনার টাকার জন্য পরিকল্পনা কমিশনকে একটি পথ বাতলে দেয়। অর্থ বিভাগের পরামর্শ হচ্ছে, এডিপিতে থাকা প্রকল্পগুলোর মধ্যে যেগুলোর বাস্তবায়নে অগ্রগতি কম, সেগুলো থেকে টাকা কেটে (পুনঃ উপযোজন) ইভিএম কেনা যেতে পারে।

টাকা আসবে কোথা থেকে
নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, দেড় লাখ ইভিএম কেনা হবে তিন ধাপে এবং চলতি অর্থবছরে ৫০ হাজার মেশিন কেনা হতে পারে। ইভিএমগুলোর ওয়ারেন্টি ১০ বছর।

নির্বাচন কমিশন সচিব বলেন, সরকার যেহেতু প্রকল্প পাস করেছে, টাকার সংস্থান হবেই। অর্থ মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনকে যেভাবে বলে দিয়েছে, সেভাবেই হবে টাকার সংস্থান। যেসব প্রকল্প ধীরগতির বা কম গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলো থেকে টাকা আনা হবে।

আবার এই ইভিএমও কেনা হচ্ছে প্রতিবেশী ভারতের চেয়ে ১১ গুণ বেশি দামে। নির্বাচন কমিশন একটি ইভিএম কিনতে খরচ করবে ২ লাখ ৩৪ হাজার ৩৭৩ টাকা। ভারতের নির্বাচন কমিশন ওই দেশের লোকসভা, রাজ্যসভাসহ বিভিন্ন নির্বাচনে ব্যবহারের জন্য যে ইভিএম ব্যবহার করেছে, তার দাম ১৭ হাজার রুপি। প্রতি রুপি ১ টাকা ২৫ পয়সা হিসাবে ধরে বাংলাদেশি টাকায় ভারতের ইভিএমের দাম পড়ে ২১ হাজার ২৫০ টাকা। দামের এত পার্থক্য থাকলেও বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের ইভিএমের পার্থক্য খুব বেশি নেই বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন। বাংলাদেশ যে ইভিএম কিনছে তাতে ভোটার ভেরিয়েবল পেপার অডিট ট্রেইল বা ভিভিপিএটি (যন্ত্রে ভোট দেওয়ার পর তা একটি কাগজে ছাপা হয়ে বের হবে) সুবিধা নেই। এতে ভোট পুনর্গণনার বিষয় এলে ইসিকে সমস্যার মুখে পড়তে হতে পারে।

এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন ২০১১ সালে প্রথম স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার শুরু করে। পরে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার হয়ে এলে নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।

গত বছর কে এম নুরুল হুদা প্রধান নির্বাচন কমিশনার হওয়ার পর প্রথমে এ নিয়ে আলোচনা তেমন না থাকলেও হঠাৎ করে ইভিএম ব্যবহারের উদ্যোগ শুরু হয়। সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের বৈধতা আনতে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এ সংশোধনী আনা হয়েছে। ৪ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচন কমিশনের ৩৮ তম মুলতবি সভায় চূড়ান্ত করা হয় ইভিএম বিধিমালা।