Thank you for trying Sticky AMP!!

জামায়াতে সেক্রেটারি জেনারেল পদ নিয়ে টানাপোড়েন

‘আমির’ নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক ওঠার পর এবার সেক্রেটারি জেনারেল পদে মনোনয়ন নিয়েও টানাপোড়েন চলছে জামায়াতে ইসলামীতে। এরই মধ্যে সেক্রেটারি জেনারেল পদে মনোনয়ন ঘিরে একাধিক পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। সেক্রেটারি জেনারেল পদে মনোনয়ন ঘিরে নতুন আমির শফিকুর রহমানের ওপর এই পক্ষগুলো অসন্তুষ্ট। তিনি দলে নিজস্ব প্রভাব-বলয়ের সৃষ্টি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।

শফিকুর রহমান সম্প্রতি জামায়াতের আমির নির্বাচিত হন। এখনো তাঁর শপথ হয়নি। দলটির দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আমিরের পর জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার নির্বাচন শেষ হয়েছে। শিগগির মজলিশে শূরার অধিবেশন ডাকা হবে অথবা, নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে নতুন আমির শপথ নেবেন। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, জামায়াতের আমির সেক্রেটারি জেনারেল পদে মনোনয়ন দেন। আমির পদে শপথের পর তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্য থেকে একজনকে সেক্রেটারি মনোনীত করবেন। তা নিয়েই দলে অস্থিরতা দেখা দিয়েছে।

জামায়াতের সূত্র জানায়, শফিকুর রহমান আমির নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে দলের সেক্রেটারি জেনারেল পদ নিয়ে সম্ভাব্যদের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। কারণ নতুন আমির দলে নিজস্ব প্রভাব-বলয়ের সৃষ্টি করছেন বলে তাদের অভিযোগ। যদিও জামায়াতে নেতৃত্বের জন্য কারও প্রার্থী হওয়ার প্রথা নেই এবং তা গঠনতান্ত্রিকভাবে নিষিদ্ধ। এরপরও ঐতিহ্য ভেঙে এই প্রথম দলের সম্ভাব্য সেক্রেটারি জেনারেল কে হচ্ছেন, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে টানাপোড়েনের সৃষ্টি করেছে। যার প্রভাব পড়েছে কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে। আর তার প্রকাশ ঘটছে সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমে।

কথা বলে জানা গেছে, সেক্রেটারি পদে এখন পর্যন্ত ছয়জন নেতার নাম আলোচিত হচ্ছে। তারা হলেন: কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির (সহ সভাপতি) মিয়া গোলাম পরওয়ার, নির্বাহী পরিষদের সদস্য এ টি এম মাছুম, সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আজাদ, কেন্দ্রীয় প্রচার সেক্রেটারি তাসনীম আলম।

নেতা-কর্মীরা বলছেন, দলে জানাশোনা এবং জনপ্রিয়তার দিক থেকে সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের এগিয়ে। কিন্তু সংস্কারবাদী সন্দেহে তিনি দীর্ঘদিন থেকে দলে কোণঠাসা। তাহের ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। অন্যদের মধ্যে তাসনীম আলম শারীরিকভাবে অসুস্থ এবং কর্মকাণ্ডে কম সক্রিয়। হামিদুর রহমানকে নিয়ে তাঁর নিজ এলাকা কক্সবাজারে বিতর্ক আছে। হামিদুরের বিরুদ্ধে তাঁর এক ব্যবসায়িক অংশীদার জামায়াতের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে অভিযোগ করেন। বিষয়টি এখন তদন্তাধীন।

এর বাইরে সেক্রেটারি জেনারেল পদে আলোচনার শীর্ষে আছেন গোলাম পরওয়ার, এ টি এম মাছুম ও রফিকুল ইসলাম খানের নাম। মাছুম এবার জামায়াতের আমির নির্বাচনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ছিলেন। আমির পদে নির্বাচনের শুরু থেকে শফিকুর রহমানের প্রভাব বিস্তার নিয়ে নেতা-কর্মীর মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। এ অবস্থায় নির্বাচন কমিশনারের দায়িত্ব পালনকারী নেতাকে সেক্রেটারি করা সমালোচনা হতে পারে বলে মনে করছেন নেতা-কর্মী অনেকে। মাছুমের মালয়েশিয়া পড়ুয়া ছেলে তারিকুল ইসলাম বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের ব্যাপারে ফেসবুকে নেতিবাচক পোস্ট দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ছেলেকে নিয়ে তিনি ‘বিব্রত’ অবস্থায় আছেন।

জানা গেছে, সেক্রেটারি পদে বেশি আলোচিত রফিকুল ইসলাম খান। কিন্তু তাঁর সঙ্গে নতুন আমির শফিকুর রহমানের সম্পর্কে ভালো যাচ্ছে না। বিষয়টি এখন দলের দায়িত্বশীল পর্যায়ে অনেকটা প্রকাশ্য। রফিকুল ইসলাম দলের প্রভাবশালীদের একজন। এক সময় ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। পরে জামায়াতের ঢাকা মহানগর আমির হন। নিজামী-মুজাহিদদের গ্রেপ্তারের পর এক সময় ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারির দায়িত্বও পালন করেন। এ সময় তিনি প্রভাব খাঁটিয়ে পছন্দের কয়েকজনকে নির্বাহী পরিষদের সদস্য করাসহ অনেক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।

দলীয় সূত্র জানায়, নায়েবে আমির মিয়া গোলাম পরওয়ারকে সেক্রেটারি করা হতে পারে। তিনি এবার তিন সদস্যের আমিরের প্যানেলেও ছিলেন। তবে নেতা-কর্মীদের অনেকে বলছেন, নায়েবে আমির পদে থাকা পরওয়ারকে সেক্রেটারি করা হলে তা হবে ঐতিহ্যের খেলাপ এবং পদাবনতি। সে ক্ষেত্রে সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল পদের নেতাদের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হতে পারে।
অবশ্য মিয়া গোলাম পরওয়ার জানান, তাঁকে সেক্রেটারি জেনারেল করা হচ্ছে এমন কথা তিনি শোনেননি। এটা অসত্য। তিনি শ্লেষ প্রকাশ করে প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামায়াতকে নিয়ে কত কথাই তো লেখা হয়। আমাদের কিছু ভাই আছেন, তারাও বলেন। সাংবাদিকেরাও অনেক কথা লিখেন, তারা লিখে আরাম পায়, এনজয় করে।’

নতুন আমিরকে নিয়ে কথা
দলের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, নতুন আমির শফিকুর রহমান চাইছেন না ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতিদের কেউ সেক্রেটারি জেনারেল পদে আসুক। কারণ তিনি নিজে কখনো ছাত্রশিবিরের শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন না, যাদের তিনি সেক্রেটারি করতে তৎপর, তারাও ছিলেন না। শফিকুর রহমান সিলেট মহানগর ছাত্রশিবিরের সভাপতি ছিলেন। মিয়া গোলাম পরওয়ার শিবিরের কেন্দ্রীয় সদস্য ও খুলনা মহানগর সভাপতি ছিলেন। হামিদুর রহমান আজাদ শিবিরের কেন্দ্রীয় সহ সভাপতি, আর এ টি এম মাছুম কেন্দ্রীয় বায়তুল মাল সম্পাদক (কোষাধ্যক্ষ) ছিলেন। অন্যদিকে আবদুল্লাহ মো. তাহের, রফিকুল ইসলাম খান ও তাসনীম আলম কেন্দ্রীয় সভাপতি ছিলেন।

জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও মজলিশে শূরায় সিদ্ধান্ত হয় জামায়াতে ইসলামীর বিকল্প নতুন নামে একটি দল গঠনের। এ লক্ষ্যে নতুন দলের নাম, গঠনতন্ত্র ও এর কাঠামো নির্ধারণের জন্য জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল শফিকুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের কমিটি করা হয়। প্রায় ৯ মাস অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও বাস্তবে কিছুই হয়নি। দলের নেতা-কর্মীদের অনেকের ধারণা, শফিকুর রহমান ও হামিদুর রহমান আজাদের অনাগ্রহে কমিটির কাজ থেমে আছে। দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সদস্য হামিদুর রহমানও এ কমিটির সদস্য।

দলের বিশ্বস্ত একটি সূত্র জানায়, শফিকুর রহমান বিএনপির সঙ্গে ২০-দলীয় জোটে থাকতে ইচ্ছুক নন। তিনি সেখান থেকে বেরিয়ে অলি আহমদের নেতৃত্বে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ সক্রিয় হতে চান। এ নিয়ে দলের নেতা-কর্মীদের একটি অংশে নানা কানাঘুষা আছে। বর্তমান আমির মকবুল আহমাদ নিষ্ক্রিয় থাকায় দলে একচ্ছত্র প্রভাব বিস্তার করেন শফিকুর রহমান। সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপির বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়া, প্রস্তুতি ও জনসমর্থন না থাকা সত্ত্বেও রাজধানীর মিরপুর থেকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্তে নেতা-কর্মীদের অনেকে বিরক্ত।

জানা গেছে, জামায়াতের বর্তমান আমির মকবুল আহমদ ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খানসহ বেশ কিছু নেতার দেশের বাইরে যাওয়ার ব্যাপারে সরকারি বিধিনিষেধ রয়েছে। কিন্তু শফিকুর রহমানের ক্ষেত্রে তা নেই। ইতিমধ্যে তিনি যুক্তরাজ্য, মালয়েশিয়া ও সৌদি আরব সফর করেছেন। সরকার তাঁকে বিদেশে যেতে বাধা দেয়নি। দীর্ঘদিন আড়ালে থাকার পর চলতি ডিসেম্বর মাসে মকবুল আহমদ পবিত্র ওমরাহ পালনে সৌদি আরব যান। তা-ও আমির পদ থেকে মকবুলের বিদায়ের ঘোষণার পর।

জামায়াতে ইসলামীতে শফিকুর রহমান ও রফিকুল ইসলাম খানের বিরোধ চলছে। বিষয়টি এখন নেতা-কর্মীদের আলোচনার বিষয়। দলের জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির মজিবুর রহমান ভারপ্রাপ্ত আমির থাকাকালীন গ্রেপ্তার হলে শামসুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত আমির করা হয়। পরে মজিবুর রহমান জামিনে মুক্তি পেলেও শামসুল ইসলাম দায়িত্ব চালিয়ে যান। এর পেছনে শফিকুর রহমানের কারসাজি ছিল বলে তখন আলোচনা ছিল।

এ সব অভিযোগের বিষয়ে কথা বলার জন্য জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের চারজন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে প্রতিবেদক যোগাযোগ করেন। কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।

‘নতুন আমির নিয়ে জামায়াতে নানা প্রশ্ন’ সংবাদের প্রতিবাদ
‘নতুন আমির নিয়ে জামায়াতে নানা প্রশ্ন’ শিরোনামে গত ১৯ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইন সংস্করণে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। প্রতিবেদনে তাতে বলা হয়, জামায়াতের নেতা-কর্মীদের একটি অংশ বলেছেন, এবার আমির পদে তিন সদস্যের প্যানেল নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক উঠেছে। বর্তমান আমির মকবুল আহমাদকে প্যানেল থেকে কৌশলে বাদ দেওয়া হয়। তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ বলে নির্বাচনের আগে থেকেই দলের ভেতরে একধরনের প্রচার চালানো হয়। মকবুল আহমাদের অনুপস্থিতিতে শফিকুর রহমানকে আমির ঘোষণা করা হয়।

জামায়াতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার এটিএম মাছুম এর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, এখানে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার কোনো সুযোগ নেই। মকবুল আহমাদ বার্ধক্যজনিত কারণে সংগঠনের দায়িত্ব থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য আবেদন করেন এবং আমিরের প্যানেল নির্ধারণের সময় তাঁকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানান। মকবুল আহমাদকে কৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে এ কথা সম্পূর্ণ মিথ্যা। নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে এ ধরনের এ প্রতিবেদন করা হয়েছে।

প্রতিবেদকের বক্তব্য
ওই প্রতিবেদন তৈরির আগের পরে জামায়াতের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা প্রশ্ন তুলেছেন যে, মকবুল আহমাদ কি লিখিতভাবে আবেদন করেছেন? না কি তাঁকে সেটি বলার জন্য সে রকম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে। আর যদি তিনি স্বেচ্ছায় এমন আবেদন করেন, সেটি কোথায়। দলের সব রুকন বা মজলিশে শূরার সদস্যদের কাছে তা পাঠানো হয়েছে?

নেতা-কর্মীরা বলছেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামীতে কেউ প্রার্থী হওয়ার বা ভোট চাওয়ার বিধান নেই। এখানে সবাই ভোটার, সবাই প্রার্থী। তাই কেউ বার্ধক্যজনিত বা অন্য কোনো কারণে তাঁকে ভোট না দেওয়ার আহ্বান জানানোর কোনো বিধান কি গঠনতন্ত্রে আছে? অতীতে এমন আবেদন কি করে করেছেন? মকবুল আহমাদ এতই অসুস্থ হলে তিনি ওমরাহ পালনে সৌদি আরব গেলে কীভাবে। কারণ ওমরাহ পালনের জন্য তো শারীরিক সামর্থ্য থাকা জরুরি।