Thank you for trying Sticky AMP!!

আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। তাঁর পাশে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম ও ওবায়দুল কাদের। ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে

আওয়ামী লীগ কি সেই ‘অনুভূতির’ জায়গায় আছে

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম নিজের শেষ বক্তব্য দিয়েছিলেন ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর। দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া ওই বক্তব্যে তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি অনুভূতি।’

ছয় বছর আগে আওয়ামী লীগকে নিয়ে নিজের ব্যক্তিগত যে অনুভূতির কথা বলেছিলেন সৈয়দ আশরাফ, তার মধ্যে আবেগের প্রকাশই বেশি ছিল।

আবেগ দিয়ে রাজনীতি না চললেও আবেগের মূল্য আছে রাজনীতিতে। যে কারণে সৈয়দ আশরাফের ‘আবেগঘন’ বক্তব্য ওই সময় বেশ প্রশংসিত হয়েছিল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের কাছে। সেদিন তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু আওয়ামী লীগকে কোনো দিনই দল হিসেবে ভাবিনি, আওয়ামী লীগকে ভেবেছি একটা অনুভূতি।’

Also Read: তাহলে ‘কেউ’ আওয়ামী লীগের হয় কীভাবে

সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম

সেই ‘অনুভূতি’ এখন কতটা লালন করেন আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। দলের প্রতি ওই ‘আবেগ’ নেতা-কর্মীদের মধ্যে কতটা রয়েছে, সেটি সৈয়দ আশরাফের (মারা গেছেন ২০১৯ সালের ৩ জানুয়ারি) পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পাওয়া ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যেই স্পষ্ট। ২০২০ সালের মার্চে রাজশাহীর মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে মনে হয় যে আওয়ামী লীগে কর্মী কমে যাচ্ছে, নেতার সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের এত নেতার দরকার নাই। আমাদের দরকার সত্যিকারের সাচ্চা কর্মী।’

আমি কিন্তু আওয়ামী লীগকে কোনো দিনই দল হিসেবে ভাবিনি, আওয়ামী লীগকে ভেবেছি একটা অনুভূতি।
সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক

টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগে কর্মী কমে নেতার সংখ্যা কতটা বেড়েছে, সেটিও ওবায়দুল কাদেরের সাম্প্রতিক এক বক্তব্যেই বেশ পরিষ্কার। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সাভারে আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় তিনি বলেন, ‘আজ এই সমাবেশ মঞ্চ থেকে তাকিয়ে দেখছি, নেতা আর নেতা। সিকি নেতা, আধুলি নেতা, পাতি নেতা—সব নেতা। কর্মী কোথায়?’

গত এক দশকে বেশ কিছু শব্দ রাজনৈতিক অঙ্গনে জনপ্রিয় করেছেন ওবায়দুল কাদের। এর একটি ‘হাইব্রিড নেতা’, অন্যটি ‘অতিথি পাখি’। আবার উড়ে এসে হঠাৎ নেতা হয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের তিনি বলেছেন ‘বসন্তের কোকিল’। একইভাবে তৃণমূলে দলের ভেতরে বিভক্তির বিষয়টিকে তিনি পরিচয় করিয়েছেন এভাবে, ‘মশারির ভেতর মশারি’ বা ‘ঘরের ভেতরে ঘর বানানো’। ২০১৬ সালের অক্টোবরে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসার আগে থেকেই দলে হাইব্রিড নেতাদের ভিড় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন তিনি। ২০১৩ সালের জুন মাসে নোয়াখালীর সেনবাগে এক অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘খেতের ফসল মার খেলেও নেতার বাম্পার ফলন। এরা হাইব্রিড নেতা। এসব হাইব্রিড নেতার ডিজিটাল চেহারায় বাংলাদেশের সবুজ মাঠ, ফসল, নদী, পাহাড় দেখা যায় না। এই ডিজিটাল ও হাইব্রিড নেতাদের চেহারা দেখে মানুষ বিরক্ত।’

আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের

নোয়াখালীর ওই অনুষ্ঠানে ওবায়দুল কাদের আরও বলেছিলেন, ‘দেশে এখন নেতার ভিড়ে কর্মী খুঁজে পাওয়া যায় না। মনে হচ্ছে, দেশ নেতার কারখানা; সবাই নেতা।’

যদিও দেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের বড় পরিচয় ছিল কর্মীনির্ভর দল। যাঁরা কিছু পাওয়ার আশা না করে দলের জন্য নিবেদিত থাকতেন, যা সৈয়দ আশরাফের ভাষায়, ‘আওয়ামী লীগকে ভেবেছি একটা অনুভূতির’ মতো। তবে দিন পাল্টেছে, ক্ষমতার ভাগ পাওয়া নিয়ে ‘কাড়াকাড়ির’ এই সময়ে নেতা হওয়ার প্রতিযোগিতা বেড়ে গেছে।

‘নেতা’ হওয়ার এই প্রতিযোগিতা শুধু মূল দল আওয়ামী লীগেই নয়, সহযোগী ও ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনগুলোতেও একই অবস্থা। ২ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ ছাত্রলীগের সম্মেলনে ছাত্রলীগের আচরণ ও সমাবেশ মঞ্চে নেতাদের ভিড় দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘এটাই কি ছাত্রলীগ? কোনো শৃঙ্খলা নেই। লেখক (ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য), জয় (ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আল নাহিয়ান খান)—এটাই কি ছাত্রলীগ? পোস্টার নামাতে বললাম। তারপরও নামায় না। সব নেতা (ছাত্রলীগে)? কর্মী কোথায়? এত নেতা স্টেজে (মঞ্চে), কর্মী কোথায়? এই ছাত্রলীগ চাই না।’

Also Read: আওয়ামী লীগে কাদেরের ‘হ্যাটট্রিক’, না অন্য কেউ

আওয়ামী লীগের ২২ তম জাতীয় সম্মেলনের মঞ্চ

কোনো দল পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলেই নেতা হওয়ার দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়। টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকলে সেই লাইনের শেষ কোথায়, সেটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে যায়। আগে আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ নেতারা বড় পদে থাকলেও নিজেকে কর্মী হিসেবে পরিচয় দিতেন, এখনো অনেকে দেন। এতে বিনয়-সৌজন্যতার পাশাপাশি দলের প্রতি সেই ‘অনুভূতি’ কাজ করত। আর এখন মূল দলের ভ্রাতৃপ্রতিম কোনো সংগঠনের ওয়ার্ড কমিটির ছোটখাটো পদে থাকা ব্যক্তিটিও নিজের ‘ভিজিটিং কার্ডে’ সেই পরিচয় লিখে রাখেন তিনি ‘কতটা বড়’, সেটি বোঝাতে।

ক্ষমতার ভাগ পেতে নেতা হওয়ার এই প্রতিযোগিতা আওয়ামী লীগের জন্য কী পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং ‘নেতা-বাণিজ্য’ কোন পর্যায়ে গেছে, সেটিও বলে দিয়েছেন টানা দুই মেয়াদে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকা ওবায়দুল কাদের।

গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর খিলগাঁওয়ে দলের এক অনুষ্ঠানে নেতা-কর্মীদের উদ্দেশে ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আপনারা দলটাকে বাঁচান। টাকাপয়সার লেনদেন—এগুলো বন্ধ করেন। কমিটি করতে টাকা লাগবে, এটা বিএনপির হতে পারে, আওয়ামী লীগ এ চর্চা করতে পারে না। টাকাপয়সা নিয়ে মনোনয়ন—এ চর্চা চিরতরে বন্ধ করতে হবে।’

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি

‘অনুভূতি’ ছাড়া নেতা বা কর্মী তৈরি হলে এর পরিণতি কী, সেটি বলে দিয়েছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। ১৭ ডিসেম্বর রংপুরে এক অনুষ্ঠানে দুঃখ প্রকাশ করে তিনি বলেছিলেন, ‘রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে কর্মীদের মাঠে নামাতে ৩০০ টাকা করে জনপ্রতি দিতে হয়। আমরা এ রকম আওয়ামী লীগ চাই নাই। এটা কখনো হতে পারে না।’


ইমাম হোসেন সাঈদ, ডেপুটি হেড অব রিপোর্টিং, প্রথম আলো