Thank you for trying Sticky AMP!!

'হোয়, কালকে ঈদ!'

প্রথম আলো ফাইল ছবি

আমাদের শৈশবে ঈদের আনন্দ শুরু হতো অনেক আগে থেকে। মা বাসায় হাতে সেমাই বানানোর দিন থেকে। বা হয়তো তারও আগে থেকে। আমরা ঈদের অপেক্ষা করতাম হাতের কড়ায় দিন গুনে গুনে। আকাশে চাঁদের দিকে লক্ষ্য রাখতাম ২৭ রোজারও আগে থেকে।

তখন দেশ স্বাধীন হয়েছে মাত্র। চাঁদ দেখার জন্য কষ্ট করে কমিটি গঠন করতে হয়নি সরকারকে। পরিবেশদূষণ বলে ছিল না কিছু। নিজের চোখে আকাশে অতি সরু সোনালি একটা বাঁক খুঁজতাম সবাই মিলে। এর মধ্যে কোথাও একটা শোরগোল শুরু হতো। সেটা শুনে ‘হোয়, কালকে ঈদ!’ বলে ছোট্ট একটা লাফ দিয়ে হাত ছুড়তাম বাতাসে। এই লাফালাফিটা চলত অনেক রাত ধরে।

সাভার রেডিও কলোনিতে থাকতাম। আমার মতো আরও ছোট ছোট বাচ্চা ছিল সেখানে। একজন আরেকজনকে দেখে ‘হোয়, কালকে ঈদ!’ বলে বাতাসে হাত ছুড়ে লাফ দিতাম। অন্যজন একইভাবে তার খুশি জানাত। ‘হোয়, কালকে ঈদের দল’ তারপর সারা পাড়া দল বেঁধে ঘুরে বেড়াতাম।

কেন ঈদ এত আনন্দের, তা কি আমরা চিন্তা করতাম? করার কি বয়স বা পরিবেশ ছিল? ছিল না। কিন্তু আনন্দিত হওয়ার মতো মন ছিল। আনন্দিত হওয়ার ক্ষুধা ছিল। আমাদের বাবা–চাচারা ছিলেন স্বৈরাচারী ধরনের। ঈদের কাপড় কিনে আনতেন নিজের পছন্দে। বাসায় নিয়ে আসার পর দেখার সুযোগ হতো আমাদের। যে রং হোক, যে ডিজাইন হোক, তাতেই খুশি থাকতাম। একমাত্র টেনশন থাকত ঈদের কাপড় কেউ যেন আগে না দেখে ফেলে সেটা নিয়ে। ঈদের দিন আনকোরা নতুন একটা কিছু পরে সাইনবোর্ডের মতো হয়ে ঘুরে বেড়াতাম।

তবে ঈদের কাপড় নিয়ে কোনো বিপত্তি হয়নি তা নয়। যখন একটু বড় হয়েছি, নয়-দশ বছর বয়স, সাভার থেকে পুরান ঢাকায় এসে থাকার দিন শুরু হয়েছে। তখন ছিল লম্বায় জুতো ঢেকে ফেলা বেলবটম পরার ফ্যাশন। বেলবটমের নিচের দিক থাকত মহা ঢোলা, এখন মেয়েরা যে পালাজ্জো পরে, তার চেয়েও বেশি। বেলবটম প্যান্টওয়ালা কয়েকজন একটা রাস্তা দিয়ে হাঁটলে সেই রাস্তায় নাকি আর ঝাড় দিতে হতো না কাউকে!

আমার বাবা ফ্যাশন বুঝতেন কি না জানি না। তবে দোকানে তখন বেলবটম ছাড়া আর কিছু থাকত না বোধ হয়। আমিও তাই বেলবেটম পেলাম এক ঈদে। রোগাপটকা শরীরে প্রায় বুক থেকে পায়ের ডগা পর্যন্ত বেলবটম পরলাম। বেলবটম যথেষ্ট ঢোলা হয়েছে। মহাখুশিতে বাসা থেকে বের হলাম। গলিতে পা দেওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে আমাকে দেখে ভিড় জমে গেল। আমাদের গলির মুলুক খান, হোলা (আসল নাম বারেক), হেলালরা তো আছেই, দেখি পাশের গলিগুলো থেকে দলে দলে ছুটে আসছে মানুষ। তারা আমার প্যান্ট ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে, কেউ আবার নিচটা ধরে টানে। মুলুক খান আমাদের ফুটবল ক্যাপটেন। সে মোটা গলায় বলে, ‘লঙ্গি পিনছ, না প্যান!’ মানে লুঙ্গি পরছ নাকি প্যান্ট!

লক্ষ্য করে দেখি, আমার বেলবটম ফুলে লুঙ্গির মতো হয়ে আছে। প্যান্টের দুটো পা থাকে। যত ঢোলা হোক, পাগুলোর মাঝামাঝি ভাঁজ (আমরা বলতাম কিরিচ) থাকে বলে তা লম্বালম্বি দেখায়। আমার বেলবটমের কাপড়টা এত মোটা যে তাতে কিরিচ পড়েনি। এর যে দুটো পা, তা বোঝা যাচ্ছিল না। কাজেই ‘লুঙ্গি’ দুহাতে উঁচু করে তুলে বাসায় ছুটে এলাম। লুকিয়ে কাপড় বদলে আগের বছরের হাফপ্যান্ট পরলাম। হাফপ্যান্টে বেলবটম বা চিপাবটমের ব্যাপার নেই। কাজেই কেউ আমাকে দেখতে ছুটে এল না। কেউ পুরোনো প্যান্ট পরা নিয়ে প্রশ্ন করল না।

আমি খুশিমনে ঈদ করলাম পুরোনো কাপড়ে। আমাদের সুখবোধ ছিল এমনই। ঈদ মানে একটা কাপড়, কখনো একটা স্যান্ডেল, হাতে বানানো সেমাই, জর্দা, মুরগির মাংসের একটা টুকরো, আর বাড়ি বাড়ি গিয়ে চার আনা-আট আনা সালামি (ঈদি)। বছরে এক দিন কোকাকোলা বা ইগলু আইসক্রিম খেতাম ঈদের সালামির টাকায়। ভাবতাম বড় হলে, টাকা হলে, একদিন সারা দিন শুধু কোক খাব, শুধু কোক। এটা চিন্তা করেই মন ভরে যেত। ‘হোয়, কালকে ঈদ’-এর মতো আনন্দ লাফিয়ে উঠত বুকের ভেতর ক্ষণে ক্ষণে।

আমরা ছিলাম অতি অল্পতে খুশি। আমাদের সন্তানদের অনেক বেশিতেও এত খুশি দেখি না। ওরা হলো জিডিপি জেনারেশন। এত জিডিপি, তবু তেমন আনন্দ নেই। আর আমাদের শৈশব ছিল ভুটানের মতো ‘হ্যাপিনেস ইনডেক্স’ ঘরানার। ঈদ ছিল খুশির পাহাড়চূড়া।

সেই চূড়াটায় যদি নিতে পারতাম আমাদের শিশুদের! ঈদ এলে ওরাও যদি লাফিয়ে বলত: ‘হোয়, কালকে ঈদ!’

আসিফ নজরুল: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক