Thank you for trying Sticky AMP!!

অন্তরে আঘাত করুক অহিংস বাণী

বুদ্ধবর্ষ গণনাকাল শুরু হয় গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের পর থেকে। খ্রিষ্টপূর্ব ৫৪৪ অব্দে গৌতম বুদ্ধ মহাপরিনির্বাণপ্রাপ্ত হন। সে হিসাবে বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ লাভের (৫৪৪+২০১৯) ২৫৬৩ বছর পূর্ণ হলো। ভারতবর্ষের প্রাচীন এ ধর্ম ভারতে বেশি দিন সীমাবদ্ধ ছিল না। অল্প সময়ের মধ্যে পৃথিবীর দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। এতে হানাহানি কিংবা কোনো রক্তপাতেরও প্রয়োজন হয়নি। এর অনেক কারণও আছে।

কবিগুরুর মতে, ‘আধুনিক কালের পৃথিবীর ভৌগোলিক সীমা ভেঙে গেছে, মানুষ পরস্পরের নিকটতর হয়েছে। এই সত্যকে আমাদের গ্রহণ করতে হবে। মানুষের এই মিলনের ভিত্তি হবে প্রেম, বিদ্বেষ নয়। মানুষ বিষয়-ব্যবহারে পরস্পরকে আজ পীড়ন করছে, বঞ্চিত করছে, এ কথা আমি অস্বীকার করছি না। কিন্তু সত্য সাধনায় পূর্ব-পশ্চিম নেই। বুদ্ধের শিক্ষা ভারতবর্ষের মাটিতে উদ্ধৃত হয়ে চীন দেশে গিয়ে মানবচিত্তকে আঘাত করল এবং ক্রমে সমস্ত এশিয়াকে অধিকার করল। চিরন্তন সত্যের মধ্যে পূর্ব-পশ্চিমের ভেদ নেই।’ [বিশ্বভারতী-৪]

ওষুধের কাজ হলো রোগের উপশম কিংবা প্রতিকার করা এবং এই উপশম কিংবা প্রতিকার কোনো দেশ, কাল এবং জাতের বিচারে হয় না। বুদ্ধের অমোঘ বাণীও ঠিক তা–ই। বুদ্ধের অসীম ত্যাগ এবং সাধনা কেবল নিজ কিংবা নির্দিষ্ট কোনো জাতিগোষ্ঠীর জন্য ছিল না, এ ত্যাগ, এ সাধনা ছিল সবার হিতের জন্য। বুদ্ধের সুখ কামনাটাও ছিল সবার জন্য। সবার সুখে সুখী হওয়ার মন্ত্রণা দিয়েছেন বুদ্ধ।

যে অহিংস বাণী একসময় সমগ্র ভারতবর্ষকে মৈত্রী আর করুণার প্রবল ধারায় ভাসিয়েছে, সেই একই সময়ের একই ধর্মপ্রবর্তকের বাণী, তথা একই বুদ্ধের বাণী আজ আমাদের মধ্যে অতটা মৈত্রী, ক্ষমা, দয়াভাব, সহনশীলতা জাগাতে পারছে না কেন। তিনিই তো প্রথম বলেছিলেন, ‘আমাদের সমস্যার সমাধান ঘৃণা, বিদ্বেষ কিংবা যুদ্ধ দ্বারা হয় না, আমাদের সমস্যার সমাধান হয় মমতা, বিনয় আর আনন্দ দ্বারা।’ তাহলে গলদটা কোথায়? নিশ্চয় ধর্মে নয়। এসব নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। অন্যথায় উগ্রতা আর অসহিষ্ণুতা আমাদের গোটা সমাজ এবং তরুণ প্রজন্মকে গ্রাস করে নেবে।

আমাদের হৃদয়জুড়ে যদি বুদ্ধের জন্য এতটুকু জায়গা না হয়; সবটুকু জায়গা যদি ঘৃণা, বিদ্বেষ, উগ্রতা এবং লোভে ঢেকে যায়, তাহলে চার দেয়ালে ঘেরা পাষাণবেদিতে বসা বুদ্ধমূর্তি আমাদের কতটা অহিংস এবং আলোকিত করতে পারবে, তা আমাদের অন্তর দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে। বুদ্ধ তো স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, বুদ্ধ কারও মুক্তিদাতা নন, তিনি কেবল পথপ্রদর্শক। তাহলে বুদ্ধের উদ্দেশে সমর্পিত এত পূজা, বন্দনা কি বৃথা যাবে? না, তাতে পুণ্য হবে মাত্র। কিন্তু ধর্ম আর পুণ্য এক কথা নয়। যদিওবা ধর্ম পালনেও পুণ্য হয়।

বুদ্ধ বলেন, আমাদের প্রাণী হত্যা, চুরি, ব্যভিচার, মিথ্যাচার এবং মাদক সেবন থেকে বিরত থাকতে হবে। এই নীতিগুলো মানলে পরে ধর্ম পালন হবে। জীবনে বেঁচে থাকার তাগিদে জীবিকা অর্জনের আবশ্যকতা আছে। কিন্তু অস্ত্র, বিষ, প্রাণী, মাংস এবং মাদক–বাণিজ্য সম্পূর্ণরূপে পরিহার করতে হবে। পাপে বিরতি থাকলেই ধর্মের প্রতিপালন হবে। বস্তুত, এখন আমরা অনেকে এসব ধর্ম পালনে আছি কি?

বুদ্ধ বলেছেন, জীবনের মানে খুঁজে পেতে হলে জগতে দুঃখ আছে, এসব দুঃখের কারণ আছে, কারণযুক্ত এসব দুঃখের নিরোধ আছে এবং দুঃখ নিরোধের উপায়ও আছে—আমাদের এই চার আর্য সত্যকে জানতে হবে, হৃদয়াঙ্গম করতে হবে। এই শ্রেষ্ঠ সত্যসমূহ যদি উপলব্ধিতে না আসে, তাহলে জীবন তো পথভ্রষ্ট এবং লক্ষ্যচ্যুত হবেই। অস্থিরতা, অসহিষ্ণুতা, হিংসা, বিদ্বেষ, লোভ, পরশ্রীকাতরতার মতো ইত্যাদি বিকার আমাদের মানবিক গুণাবলিকে বিকশিত হতে দেবে না। মানবিকতা বিকশিত হতে না পারলে ভেতরের পাশবিক দিকটা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। কেউ চার আর্যসত্য বুঝতে পেলে আর্য–অষ্টাঙ্গিক মার্গ হবে তার বাঁচার একমাত্র অবলম্বন। জীবন যদি একবার আর্য–অষ্টাঙ্গিক মার্গের পথিক হতে পারে, তাহলে আর কোনো রিপু এবং পাপ ব্যক্তিকে ছুঁতে পারবে না। তখন আসবে দেহ-মনের বিশুদ্ধতা। চার আর্যসত্য এবং আর্য–অষ্টাঙ্গিক মার্গকে জীবন থেকে বাদ দিয়ে আমরা কোন ধর্মের কথা বলছি, কোন ধর্মের পথে চলছি!

বুদ্ধ বলেছেন, ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক জীবন, সামাজিক জীবন, তথা আমাদের চারপাশটাকে শান্তিপূর্ণ করে তুলতে জীবনে ‘ব্রহ্মবিহার’ চর্চা করার প্রয়োজন আছে। এই ব্রহ্মবিহার হলো মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা করার মতো মানসিক সামর্থ্য অর্জন করা। মূলত সর্বলোকের এবং সর্বপ্রাণীর প্রতি দয়াভাব পোষণ, সবাইকে ভালোবাসা, সহিষ্ণু হওয়া এবং সবার মঙ্গল চিন্তা করাই ‘ব্রহ্মবিহার’ ভাবনা। এই ব্রহ্মবিহার চর্চাকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘অপরিমিত মানসকে প্রীতিভাবে, মৈত্রীভাবে বিশ্বলোকে ভাবিত করে তোলাকে ব্রহ্মবিহার বলে। সে প্রীতি সামান্য প্রীতি নয়, মা তাঁর একটিমাত্র পুত্রকে যে রকম ভালোবাসেন, সেই রকম ভালোবাসা’। [্ব্রহ্মবিহার, বুদ্ধদেব, পৃষ্ঠা, ২০-২১]

তাহলে আমাদের দ্বারা কেউ কোথাও ক্ষতিগ্রস্ত, নিপীড়িত এবং নির্যাতিত হওয়ার সুযোগ কোথায়! মিয়ানমারে ঠিক তেমনটাই তো হলো। আসলে গলদটা আমাদের মধ্যে। কারণ, ধর্ম এমন এক বিষয়, যার থেকে উপকার পেতে হলে কেবল ভাষণ করে, পাঠ করে কিংবা শ্রবণ করে ধার্মিক বনে গেলে হবে না। ধর্মকে যদি নিজের জীবনে সচেতনভাবে প্রয়োগ করা না যায়, তাহলে ধর্ম আমার মধ্যে কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না। ধর্মের ব্যবহারিক দিকটার চেয়ে আচার-আনুষ্ঠানিকতার দিকটা যেন আমাদের জীবনে মুখ্য হয়ে না যায়। এখন আমরা বোধ হয় সেটাই বেশি করছি। আমাদের ভেতরে ঠেসে থাকা লোভ, দ্বেষ, মোহ, ক্রোধ, তৃষ্ণা, ক্ষয় এবং জয়কারী এই বাণী যেন আমাদের অন্তর্জগতে প্রবেশ করে আমাদের অন্তরে আঘাত করতে পারে। তাতেই আসবে শান্তি, তাতেই আসবে দুঃখমুক্তি। আর দুঃখমুক্তি মিললে পরে আসবে আত্মমুক্তি। তথাগত বুদ্ধ স্বয়ং এমনটা চেয়েছিলেন।

প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সহকারী পরিচালক এবং কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি

progyananda@gmail.com