Thank you for trying Sticky AMP!!

অলংকরণ: এস এম রাকিবুর রহমান

আমার কাছে বড়দিন যে কারণে বড় দিন

সেবার বড়দিনের ছুটিতে আমরা গেলাম ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার মনসাপাড়ায়। সেখানে খালাশাশুড়ির শ্বশুরবাড়ি। তাঁরা পাহাড়ি এবং খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী।

রাস্তা মোটেও আরামদায়ক নয়। খানিকটা বাসে, খানিকটা মোটরবাইকে ভেঙে ভেঙে গিয়ে পৌঁছালাম অদ্ভুত সুন্দর সেই জায়গায়। পাহাড়ের ওপর বাড়ি। অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হয়। খাওয়ার পানি তুলতে হয় কুয়া থেকে। একটি রিজার্ভার আছে। সেখানে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হয় অন্যান্য কাজের জন্য।

ক্রিসমাস ইভে, মানে ২৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে খালুশ্বশুরের পৈতৃক বসতবাড়িতে গিয়ে আমি মুগ্ধ। সেই বাড়ির চেয়ে মনোরম সেখানকার গির্জা। সেটা পাহাড়ের ওপর। পরিষ্কার পরিপাটি প্রাঙ্গণ। কোথাও একটা শুকনা পাতা পর্যন্ত পড়ে নেই। কিন্তু আমার জন্য আরও বিস্ময় অপেক্ষা করছিল।

বড়দিন উদ্্যাপনের রীতি সেখানে স্থানীয় কমিউনিটি বেজড। একেক বছর একেক বাড়ির কর্তা বড়দিনের দায়িত্ব নেন; বাদবাকি সবাই তাঁর অতিথি। যে বাড়িতে উৎসবের দিনের ভোজ হবে, সেখানে মোটাসোটা একটি শূকর বেঁধে রাখা হয়েছে। অতিথি আপ্যায়নের জন্য ক্রিসমাসের দিন সেটিকে মারা হবে।

আগের দিন সন্ধ্যা থেকেই গানবাজনা আর নাচ চলছে। গানগুলো সবই মানদাই ভাষার। একটি বর্ণও বুঝলাম না। কিন্তু জানলাম, এগুলো সব যিশুর মহিমাকীর্তন। গানের সঙ্গে নাচ, সেটাতেও অংশ নিচ্ছেন ছেলে-বুড়ো সবাই।

পরদিন সকালে গেলাম গির্জায়। সেখানে পাদরি কথা বলছিলেন বাংলায়ই। বললেন, পৃথিবীতে ডিসেম্বর মাসে দিন থাকে ছোট, তবু কেন ক্রিসমাসকে বড়দিন বলা হয়...। ভৌগোলিক হিসাবেও এই সময় থেকে দিন বড় হতে শুরু করে আর রাত হয় ছোট।

যিশুর জন্মের মাধ্যমে পৃথিবীতে সুদিন আসার প্রতীক তাঁর এই জন্মদিন। পাহাড়ের বড়দিন উদ্যাপন বেশি ভালো লাগার কারণ, সেটি একেবারেই তাঁদের নিজস্ব কায়দায় উদ্যাপন করা উৎসব। কোনো রকম ইউরোপিয়ান রিচুয়াল চোখে পড়ল না। আলো দিয়ে ক্রিসমাস ট্রি সাজানো কিংবা লাল পোশাকের ভুঁড়িওয়ালা নকল দাড়ি ও পরচুলা পরা সান্তা ক্লজ কোথাও ছিল না।

আরেকবার ক্রিসমাস ইভে আমি ছিলাম কলকাতায়। সেখানে বড়দিন পুরোটাই ইউরোপীয় রীতিতে উদ্্যাপিত হয়। পার্ক স্ট্রিটে গিয়ে দেখি, দুনিয়ার মানুষ গিজগিজ করছে। সবাই কোথায় যেন যাচ্ছে।

পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে যেমন অবস্থা হয়, অনেকটা তেমন। কলকাতা আদতেই একটি কসমোপলিটন সিটি। সেখানে নানা ভাষার মানুষের বাস, কিন্তু বড়দিন যাঁরা উদ্যাপন করছেন, তাঁদের অধিকাংশই খ্রিষ্টধর্মাবলম্বী নন। যাঁদের সঙ্গে গিয়েছিলাম, তাঁরা নিয়ে গেলেন বউবাজার নামের এক জায়গায়। সেখানে জরথুস্ত্র সম্প্রদায়ের কিছু মানুষ বাস করেন। বাসায় বানানো রেড ওয়াইন বিক্রি করেন তাঁরা, বড়দিন উপলক্ষেই।

আমার দেখা বড়দিনের এ দুই উদ্্যাপনে বিশাল ফারাক। প্রথমটি খুব সাদামাটা আন্তরিক আর একটি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সম্পূর্ণ নিজস্ব রীতিতে ধর্মীয় উৎসব উদ্্যাপনের আয়োজন। আর পরেরটি খুব জাঁকজমকপূর্ণ, ঝাঁ-চকচকে শহরের আলোকোজ্জ্বল। অনেকটা যেন গ্লোবাল উৎসব।

প্রথমটিতে প্রত্যেক মানুষ ব্যক্তিগতভাবে যুক্ত আর পরেরটিতে একদল লোক কেউ কাউকে চেনে না, কিন্তু জড়ো হয়েছে আনন্দ করতে। দুই উৎসবের সৌন্দর্য দুই রকমের। কলকাতার এক রাস্তায় যানবাহন চলাচল বন্ধ করে প্রচুর আলো জ্বেলে বড় বড় স্পিকারে ইংরেজি ও হিন্দি গান বাজিয়ে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের নাচ দেখতেও ভালো লাগছিল। যারা নাচছে একসঙ্গে, তারাও নিজেদের মধ্যে পরিচিত নয় সবাই।

আমার সঙ্গের বাংলাদেশি মেয়েটি তার প্রেমিককে আমার পাশে দাঁড় করিয়ে একদফা নেচে নিল। তারপর আবার দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে হাঁটতে থাকল আরেক রাস্তার দিকে। যাঁরা কনকনে ঠান্ডা অগ্রাহ্য করে পথে বের হয়েছেন, তাঁদের দেখে মনে হলো, বড়দিন যেন সব ধর্ম, বর্ণ, জাতীয়তা আর ভাষার বিভেদ ভুলিয়ে দিয়েছে। জগতের সব মানুষকে আনন্দ করার একটা উপলক্ষ এনে দিয়েছে। বড়দিনের বড় সাফল্য এটাই।

এসবের তুলনায় আমার মফস্‌সল শহরের বড়দিন শুধুই একটি সরকারি ছুটির দিন ছাড়া তেমন কিছুই নয়। শুধু খিষ্টধর্মাবলম্বী বাদে কারোই মনে হয় আগ্রহ নেই এই দিন নিয়ে। এই জাতিগত হানাহানি ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে দমবন্ধ সময়ে অনুভব করি, কলকাতার বড়দিনের মতো একটা বৃহৎ উদ্্যাপন সুযোগ থাকলে মন্দ হতো না।

  • উম্মে ফারহানা লেখক ও িশক্ষক