Thank you for trying Sticky AMP!!

হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম একটি ধর্মীয় উৎসব দোল পূর্ণিমা। এটি হোলি উৎসব নামেও পরিচিত। গালেমুখে আবিরের রং। মেখেছে সারা গায়েও।

ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল

দোলপূর্ণিমা বা দোলযাত্রা সনাতন ধর্মানুসারীদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। রঙের উত্সব দোল ও হোলি যতটা ধর্মীয়, ততটাই সাংস্কৃতিক ও সামাজিক উত্সব। দোল ভ্রাতৃত্ব ও প্রেমের উত্সব।

সাধারণত ফাল্গুন-চৈত্র মাসেই হয় দোল উৎসব। এই উপলক্ষে বিভিন্ন জায়গায় পূজাও হয়। দোলপূর্ণিমা হিন্দুধর্মের জন্য খুব শুভ বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশে উৎসবটি ‘দোলযাত্রা’, ‘দোলপূর্ণিমা’ নামেও পরিচিত। দোলযাত্রা ও দোলপূর্ণিমায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে বিভিন্ন মন্দিরে পূজা, হোমযজ্ঞ, প্রসাদ বিতরণসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

দোলযাত্রা হিন্দু বৈষ্ণবদের উৎসব। বৈষ্ণব বিশ্বাস অনুযায়ী, এদিন শ্রীকৃষ্ণ বৃন্দাবনে রাধিকা ও তাঁর সখীদের সঙ্গে আবির খেলেছিলেন। সেই ঘটনা থেকেই দোল খেলার উৎপত্তি। এ কারণে দোলযাত্রার দিন এ মতের বিশ্বাসীরা রাধা-কৃষ্ণের বিগ্রহ আবিরে রাঙিয়ে দোলায় চড়িয়ে নগরকীর্তনে বের হন। এ সময় তারা রং খেলার আনন্দে মেতে ওঠেন। পুষ্পরেণু ছিটিয়ে রাধা-কৃষ্ণ দোল উৎসব করতেন। সময়ের বিবর্তনে পুষ্পরেণুর জায়গায় এসেছে রং বা ‘আবির’।

দোল বা হোলির অর্থ এক হলেও দুটি ভিন্ন অনুষ্ঠান। দোল ও হোলি কখনোই একদিনে পড়ে না। দোলযাত্রা বা বসন্তোত্সব একান্তই বাঙালির রঙিন উত্সব। আর হোলি হলো অবাঙালিদের উৎসব। মূলত উত্তর, পশ্চিম ও মধ্য ভারত এবং নেপালে এই উৎসব ‘হোলি’ নামে পরিচিত। বাঙালিদের মধ্যে দোলযাত্রাকে বসন্তের আগমনী বার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বসন্ত উৎসব চালু করেছিলেন। তাই রঙিন এই উৎসবের দিকে মুখিয়ে থাকেন অনেকেই।

হোলির সঙ্গে নানান পৌরাণিক কাহিনির উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রহ্লাদের ভক্তি, হিরণ্যকশিপু বধের কাহিনি, আবার রাধা-কৃষ্ণের রাসলীলার সুবাস রয়েছে এই উৎসবে। শুধু কি তা-ই? এই উৎসবকে কামদেবের তপস্যার সাক্ষীও মনে করেন অনেকে।

হোলির সঙ্গে সম্পৃক্ত পৌরাণিক কাহিনিগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা যাক।

পৌরাণিক কাহিনি অনুযায়ী ‘হোলিকা দহন’ থেকে এসেছে হোলি, যা অসত্য ও অধর্মের বিরুদ্ধে সত্য ও ধর্মের জয়ের প্রতীক। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে রাক্ষসকুলে জন্মানো প্রহ্লাদের কাহিনি। রাক্ষস বংশের সন্তান হওয়া সত্ত্বেও নারায়ণের অনন্য ভক্ত ছিলেন প্রহ্লাদ। কিন্তু তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপু সন্তানের ঈশ্বরভক্তিতে ক্ষুব্ধ ছিল। এ কারণে প্রহ্লাদকে নানা ধরনের কষ্ট দিতে হাত কাঁপেনি তার।

শেষে বোন হোলিকার সঙ্গে মিলে প্রহ্লাদকে পুড়িয়ে মারার ষড়যন্ত্র করে হিরণ্যকশিপু। কঠোর তপস্যার পর আশীর্বাদস্বরূপ হিসেবে পাওয়া একটি চাদর গায়ে দিয়ে প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে জ্বলন্ত কাঠের ওপর বসে হোলিকা। এই চাদর গায়ে থাকলে কোনো আগুন পোড়াতে পারবে না তাকে। এদিকে বিষ্ণুর নাম জপ করতে করতে প্রহ্লাদ পিসির কোলে বসে পড়ে। নারায়ণের কৃপায় সেই চাদর উড়ে প্রহ্লাদের শরীর ঢেকে দেয় এবং আগুনে পুড়ে যায় হোলিকা। সেই থেকেই হোলিকা দহনের প্রথা পালিত হতে শুরু করে। সত্যের জয়ের প্রতীক এটি।

Also Read: জীবের দুর্গতি নাশ করেন দুর্গা

আবার রাধা-কৃষ্ণের পবিত্র প্রেমের সঙ্গে হোলি জড়িত। লোককাহিনি মতে, দিনটা ছিল বসন্তপঞ্চমীর। আচমকাই শ্রীমতী রাধা খেয়াল করলেন, তাঁদের ওপর কিছু ফুলের পাপড়ি ঝরে পড়ল। ব্যাপার কী? কৃষ্ণ যোগবলে জানলেন, দেবতারা স্বর্গে রঙের উৎসব উদ্‌যাপন করছেন। শ্রীমতীও বায়না ধরলেন রং খেলার জন্য। কৃষ্ণ জানালেন, সেদিনটা দেবতাদের জন্যই থাক, অন্য একদিন রঙে রেঙে ওঠা যাবে। শ্রীমতীর সে আবদারই পূরণ হলো ফাল্গুনি পূর্ণিমায়। আবার অনেকে বলেন, ছোট্ট কৃষ্ণ পুতনার বিষ স্তন পান করার পর থেকেই কালো বরণ। এদিকে রাধা ও তাঁর সখীরা সবাই গৌরবরণী। তাই দেখে মা যশোদার কাছে অনুযোগ করলেন কৃষ্ণ। মা তাঁকে জানালেন, কোনো একদিন গিয়ে কৃষ্ণও যেন গোপীদের রঙে রাঙিয়ে দেন। তাহলেই সব এক। সেই থেকেই রঙের উৎসবের সূচনা। কৃষ্ণ আর তাঁর দলবল গিয়ে রাধাকে রং মাখিয়ে এসেছিলেন বরষাণায়। প্রত্যুত্তরে গোপীরা লাঠি হাতে তেড়ে এসেছিলেন নন্দগাঁওয়ে। আর আত্মরক্ষা করেছিলেন কৃষ্ণের সখারা। এই হলো লাঠমার হোলি।

Also Read: দীপাবলি আলোর উৎসবের দিন, প্রদীপ জ্বালানোর দিন

শিব-পুরাণমতে, হিমালয়-কন্যা পার্বতী শিবকে স্বামীরূপে পাওয়ার জন্য কঠোর তপস্যা করছিলেন। অন্যদিকে বৈরাগী শিব কঠোর তপস্যায় মগ্ন ছিলেন। দেবতারা জানতেন যে সৃষ্টির কল্যাণের জন্য শিব-পার্বতীর বিয়ে জরুরি। এ কারণে দেবতাদের পরামর্শে কামদেব শিবের তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য তাঁর ওপর পুষ্পবাণ নিক্ষেপ করেন।

এই বাণ মহাদেবের মধ্যে প্রেম ও কাম ভাবনা উৎপন্ন করায় তাঁর তপস্যা ভঙ্গ হয়। ক্ষুব্ধ শিবের তৃতীয় নেত্রের আগুনে ভস্ম হয়ে যান কামদেব। তাঁর স্ত্রী রতির আকুল মিনতিতে সাড়া দিয়ে কামদেবকে পুনর্জীবন প্রদান করেন মহাদেব। অন্যদিকে দেবতাদের নিবেদনে পার্বতীকে বিয়ে করতে সম্মত হন শিব। তিথিটিই ছিল ফাল্গুন পূর্ণিমা, যাকে উৎসবের মতো উদ্‌যাপন করেছিলেন দেবতারা।

Also Read: কালীপূজার উৎপত্তি

এমন নানা গল্প-কাহিনিতে মোড়ানো দোল বা হোলি উৎসব। তবে বাঙালির কাছে দোলকে জনপ্রিয় করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি শান্তিনিকেতনে দোলপূর্ণিমায় বসন্তোৎসব পালন করেছিলেন। লিখেছিলেন অমর গীতি ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল, লাগল যে দোল!’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গান গুনগুন করতে করতেই এখন আমাদের মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবনে দোল আসে, বসন্তোৎসব আসে।

বসন্তের ছোঁয়ায় যখন মন রঙিন, তখন হোলির রঙে নিজেকে মাখিয়ে নতুনের সন্ধানে বেরিয়ে পড়াই এই উৎসবের সৌন্দর্য। পুরোনো দুঃখ-কষ্ট, শত্রুতা ভুলে নতুনভাবে পথ চলতে শেখায় দোল বা হোলি। কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য—এই ছয় রিপুকে জয় করার উৎসবই দোল।

এটি ভারতবর্ষের অন্যতম প্রাচীন উৎসব।

Also Read: শুক্লা তিথির দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা উদ্‌যাপিত হয়