Thank you for trying Sticky AMP!!

জামাইষষ্ঠীর আনন্দকামী ব্রত

হিন্দুধর্মবিশ্বাসে দেবতার চেয়ে দেবীর পূজাই বেশি। সেসব পূজা থেকে যেসব সামাজিক সংস্কারের প্রচলন, তার অনেকই নারীকেন্দ্রিক। অথচ সেই জাঁকজমকের ভরকেন্দ্রে থাকে পুরুষ। এমনই এক অনুষ্ঠানের নাম জামাইষষ্ঠী।

আদরের মেয়ের সুখী দাম্পত্য জীবন কামনায় পালনীয় ব্রতই জামাইষষ্ঠী। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে ষষ্ঠী দেবীর পূজার মধ্য দিয়ে এই ব্রত পালন করা হয়। মেয়ে ও জামাইকে নিমন্ত্রণ করে আপ্যায়ন করা এই ব্রতের রীতি। এদিন শাশুড়ি মেয়েজামাইয়ের কপালে মা ষষ্ঠীর আশীর্বাদী ফোঁটা এবং হাতে হলুদ মাখানো সুতা বেঁধে তার কল্যাণ কামনা করেন।

Also Read: বাঙালির চৈত্র সংক্রান্তি উৎসব

ষষ্ঠী দেবীর সঙ্গে জামাই যে কীভাবে জুড়ে গেল, এর খুব একটা প্রাচীন পূর্বসূত্র পাওয়া যায় না। পুরাণে এই দুটি শব্দের মধ্যে কোনো যোগ পাওয়া যায়নি। জামাইষষ্ঠী, ভেঙে বলা যায়, জামাইয়ের জন্য ষষ্ঠী। মধ্যযুগ মঙ্গলকাব্যের রচনাকাল। সে সময় থেকেই বাংলায় এই রীতির প্রচলন বলে মনে করা হয়।

ভারতবর্ষে একসময় সংস্কার ছিল, মেয়ে যত দিন না সন্তানসম্ভবা হয়, তত দিন তার মা-বাবা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না। এ ব্যবস্থায় সমস্যা দেখা দিল—সন্তান ধারণে সমস্যা বা সন্তানের মৃত্যুর (শিশুমৃত্যু) কারণে মেয়ের মা-বাবাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হতো তার বাড়ি যাওয়ার জন্য। সে ক্ষেত্রে বিবাহিত মেয়ের মুখদর্শন কীভাবে ঘটে? তাই সমাজের বিধানদাতারা জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিকে বেছে নিলেন জামাইষষ্ঠী হিসেবে। যেখানে মেয়েজামাইকে নিমন্ত্রণ করে সমাদর করা হবে এবং মেয়ের মুখ দর্শন করা যাবে। সেই সঙ্গে মা ষষ্ঠীর পূজা করে তাঁকে খুশি করা, যাতে মেয়ে শিগগির সন্তানের মুখ দর্শন করতে পারে।

আধুনিক শহুরে জীবনে অবশ্য এই সংস্কার বিশেষ গুরুত্ব পায় না। সংস্কার যা-ই হোক না কেন, মেয়েজামাইকে ডেকে এনে সমাদর করা ও সেই সঙ্গে মেয়ে যাতে সন্তানবতী হয়, সেই লক্ষ্যে ‘মা ষষ্ঠীকে’ জুড়ে দিয়ে উৎসবের নামকরণ হলো ‘জামাইষষ্ঠী’। ষষ্ঠী পালন সাধারণত করে থাকে মেয়েরা। তাদের কাছে এর তাৎপর্য অন্য রকম।

কথিত আছে, এক পরিবারে দুটি বউ ছিল। ছোট বউ ছিল খুব লোভী। বাড়ির মাছ বা অন্যান্য ভালো খাবার রান্না হলেই সে লুকিয়ে লুকিয়ে খেয়ে নিত আর শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত, ‘সব কালো বিড়ালে খেয়ে নিয়েছে।’ বিড়াল মা ষষ্ঠীর বাহন। তাই বিড়াল মা ষষ্ঠীর কাছে অভিযোগ জানাল। মা ষষ্ঠী রেগে গেলেন। এর জেরে ছোট বউয়ের একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন। এভাবে ছোট বউয়ের সাত ছেলে ও এক মেয়েকে মা ষষ্ঠী ফিরিয়ে নেন। এ কারণে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যরা মিলে তাকে ‘অলক্ষুনে’ বলে গালিগালাজ করে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেয়। অথচ বড় বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে সুখে-শান্তিতে সংসার করতে থাকে।

ছোট বউ মনের দুঃখে বনে চলে যায় এবং একাকী কাঁদতে থাকে। শেষে মা ষষ্ঠী বৃদ্ধার ছদ্মবেশে তার কাছে এসে কান্নার কারণ জানতে চান। সে তার দুঃখের কথা বলে। তখন মা ষষ্ঠী তার আগের অন্যায় আচরণের কথা বললে সে মাফ চায়। ষষ্ঠী তাকে ক্ষমা করেন। এরপর বলেন, ভক্তিভরে ষষ্ঠীর পূজা করলে সাত ছেলে ও এক মেয়ের জীবন ফিরে পাবে। তখন ছোট বউ সংসারে ফিরে এসে ঘটা করে মা ষষ্ঠীর পূজা করে এবং ক্রমে ক্রমে তার ছেলেমেয়েকে ফিরে পায়। এর থেকে দিকে দিকে ষষ্ঠীপূজার মাহাত্ম্য ছড়িয়ে পড়ে। এটাই জামাইষষ্ঠীর মূল ব্রতকথা।

Also Read: বাসন্তীপূজায় জেগে আছে আদি দুর্গাপূজার স্মৃতি

যে সময় জামাইষষ্ঠী পালন করা হয়, অর্থাৎ জ্যৈষ্ঠ মাসে, তখন প্রকৃতিতে আম-জাম-কাঁঠাল ইত্যাদি ফলের সমারোহ। তাই খুব ঘটা করে এদিন শাশুড়িরা ষষ্ঠীপূজা করেন। তারপর নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা জামাইকে আসনে বসিয়ে প্রথমে কপালে দইয়ের ফোঁটা দিয়ে আশীর্বাদ করেন এবং দীর্ঘ জীবন কামনায় মা ষষ্ঠীর স্মারক তেল-হলুদ মাখানো সুতা কবজিতে বেঁধে দেন। আশীর্বাদী বস্ত্রাদি জামাইয়ের হাতে তুলে দেন। বিভিন্ন মিষ্টান্নসহ নানা ফল খেতে দেন। অবশ্য জামাই বাবাজিও শ্বশুরবাড়ি ঢোকার সময় যেমন দই-মিষ্টি আনতে ভোলে না, তেমনি আশীর্বাদের পর প্রণামি হিসেবে শাশুড়িকে বস্ত্র দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, শুধুই জামাই নয়, মেয়েও কিন্তু বস্ত্রাদি উপহার হিসেবে পেয়ে থাকে।

অতীতে নারীরা ছিল অন্তঃপুরচারিণী। জীবন কাটত স্বামীদের উপার্জনে, তাদের ভরসায়। তাই জামাইষষ্ঠীতে মেয়ের স্বামীকে তুষ্ট রাখার বাড়তি তাগিদ থাকত মায়েদের। কিন্তু এখনকার শিক্ষিত বৃত্তে বউমারাও আয়–রোজগারে, প্রতিষ্ঠিত। স্বামী-স্ত্রীর রসায়নও অনেকটাই বদলেছে। তাই বহু দিন ধরেই রব উঠছে, জামাইষষ্ঠীর মতো বউমাষষ্ঠীও চালু করা হোক। শাশুড়ি মায়েরা বাড়ির বউটিকেও একইভাবে স্নেহ-আদরে ভালো রাখলে আখেরে ছেলের জীবনটাই তো আরও মধুর এবং সংসার শান্তিময় হবে।

Also Read: ‘যত মত তত পথ’: রামকৃষ্ণ