Thank you for trying Sticky AMP!!

ইতিবাচক পদক্ষেপ চান ট্রান্সজেন্ডাররা

ট্রান্সজেন্ডারসহ লিঙ্গবৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করতে হবে সমন্বিতভাবে। চাকরিতে নিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে শিথিল করতে হবে শর্ত।

নাছিমা বেগম, আরমা দত্ত, শামীম হায়দার পাটোয়ারী ও মোকতার হোসেন

শিশু বয়স থেকেই ট্রান্সজেন্ডারসহ লিঙ্গবৈচিত্র্যপূর্ণ ব্যক্তিরা পরিবারে বড় হতে পারলে, তাঁদের প্রতি বিদ্যমান বৈষম্য অনেকটাই কমে যাবে। শিক্ষা, চাকরি, সম্পত্তির অধিকারসহ বিভিন্ন অধিকার পাওয়ার পথটি সহজ হবে। এ জনগোষ্ঠী যাতে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে পারে, তার জন্য যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নজর বাড়াতে হবে। আর এসব কাজ সরকারি ও বেসরকারি সংগঠনকে সমন্বিতভাবে করতে হবে।

গতকাল সোমবার ‘হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর প্রতি বৈষম্য রোধ এবং যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকের আলোচকেরা এসব কথা বলেন। বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটি ও প্রথম আলো যৌথভাবে এ গোলটেবিল বৈঠকের আয়োজন করে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। সম্পত্তির ভাগ পাওয়াসহ বিভিন্ন অধিকার আদায়ে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে।
মোকতার হোসেন, পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা), সমাজসেবা অধিদপ্তর

গোলটেবিল বৈঠকে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান নাছিমা বেগম বলেন, হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার বা যে নামেই ডাকা হোক, তাঁদের অধিকারের বিষয়টি মানবাধিকারের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে হবে। এ ধরনের সন্তান জন্ম নিলে বাবা-মা কেন ফেলে দেবেন? ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের অধিকার সুরক্ষায় আইনের খসড়া প্রস্তুত হচ্ছে, এ আইনে ট্রান্সজেন্ডার সন্তানকে বাড়ি থেকে বের করে দিলে ওই বাবা-মাকে আইনের আওতায় আনতে হবে।

নাছিমা বেগম ট্রান্সজেন্ডার হিসেবে শনাক্তকরণে শারীরিক পরীক্ষার বিষয়টিকে ‘যৌন হয়রানির শামিল হওয়া’ বলে উল্লেখ করেন। তিনি ট্রান্সজেন্ডারদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে কর্মক্ষেত্রে নিয়োগের সুপারিশ করেন।

আলোচনায় সংসদ সদস্য আরমা দত্ত তিন দিন আগে পাশের দেশ থেকে তাঁর ফেরার অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেন, সেখানে কিছু ট্রাফিক সিগন্যালে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, এই জনগোষ্ঠীর মানুষদের সমাজের মূলধারায় সম্পৃক্ত করতে মনমানসিকতার পরিবর্তন জরুরি। আইনের খসড়াটি যাতে দ্রুত জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা যায়, সে বিষয়েও সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আরমা দত্ত বলেন, বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হচ্ছে বলে শিক্ষাসহ সবকিছু থেকে তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। এসব মানুষকে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষমতায়িত করতে হবে।

আইন মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, হিজড়া, ট্রান্সজেন্ডার—এই বিষয়গুলোর সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা থাকতে হবে। জন্মের পর থেকেই এসব ব্যক্তি বিভিন্ন বৈষম্যের শিকার হতে থাকেন। এসব ব্যক্তির চাকরিতে নিয়োগে বিভিন্ন শর্ত শিথিল করতে হবে।

আলোচনায় সমাজসেবা অধিদপ্তরের পরিচালক (সামাজিক নিরাপত্তা) মোকতার হোসেন বলেন, ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিদের জীবনমান উন্নয়নে জীবিকার ব্যবস্থা করতে হবে। সম্পত্তির ভাগ পাওয়াসহ বিভিন্ন অধিকার আদায়ে সামাজিক সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। পাঠ্যপুস্তকে এই জনগোষ্ঠীর অধিকারের বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

তাঁদের কথা

গোলটেবিল বৈঠকে ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিরা তাঁদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। ‘সম্পর্কের নয়া সেতু’র সভাপতি জয়া সিকদার বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের সুরক্ষায় একটি আইনের খসড়া তৈরি করা হচ্ছে, তবে সে প্রক্রিয়ায় ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের কোনো প্রতিনিধিকে রাখা হয়নি। এই জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইলে সবার আগে তাঁদের জন্য ট্রান্সজেন্ডারবান্ধব পরিবেশ লাগবে।

আসল ও নকল হিজড়া চিহ্নিতকরণে শারীরিক পরীক্ষার বিষয় নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে জয়া সিকদার বলেন, কেউ নারীর শরীরে নিজেকে পুরুষ ভাবতে চান, আবার কেউ পুরুষের শরীরে নিজেকে নারী ভাবতে চান। এটা প্রমাণ দেবে কী করে?

সাদাকালোর প্রেসিডেন্ট অনন্যা বণিক বলেন, এখন অনেকেই রাস্তায় ভিক্ষাবৃত্তি বা চাঁদাবাজি করতে চান না। তাঁদের জন্য কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। কাজের সহনশীল পরিবেশ থাকলে বৈষম্যও কমে আসবে।

সম্প্রতি বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় অনন্যা বণিক বলেন, সেখানে বাংলাদেশের অনেক ট্রান্সজেন্ডার মানুষ যৌন পেশায় কাজ করছেন। অনিরাপদ যৌনকাজ করতে হচ্ছে তাঁদের। এইচআইভি/এইডসের ঝুঁকিতে আছেন তাঁরা। ওই ব্যক্তিরা যখন দেশে ফিরবেন, তখন তাঁরা দেশকেও ঝুঁকিতে ফেলবেন।

বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)–এর জুনিয়র অ্যাডভোকেসি অফিসার শোভা সরকার বলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা আমাকে এভাবে বানিয়েছেন। আপনারা আমার আচরণকে স্বাভাবিকভাবে নিচ্ছেন না কেন? এ কারণেই আমরা পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারি না, আর বৈষম্যের শুরুটা হয় তখন থেকেই। রাস্তাঘাটে হিজড়া সংস্কৃতির মানুষেরা চাঁদাবাজি কেন করছেন, তা চিন্তা করতে হবে।’

গোলটেবিল বৈঠকে সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বেদে, অনগ্রসর ও হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কার্যক্রম) মো. শাহজাহান বলেন, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর জনশুমারি বলছে, দেশে হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর মোট সংখ্যা ১২ হাজার ৬২৯। এই জনগোষ্ঠীর জন্য তথ্যভান্ডার তৈরি করা হবে। তিনি এই জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতা ও উপবৃত্তিসহ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ তুলে ধরেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাসলিমা ইয়াসমীন ট্রান্সজেন্ডারসহ লিঙ্গবৈচিত্র্যপূর্ণ মানুষদের জন্য আইনি কাঠামোতে কতটুকু সুরক্ষার ব্যবস্থা আছে তা তুলে ধরেন। তাসলিমা ইয়াসমীন বলেন, হিজড়া একটি সংস্কৃতি, এটি কারও পরিচয় হতে পারে না। ধর্ষণসহ বিভিন্ন অপরাধে ধরেই নেওয়া হয় ভুক্তভোগী হবেন নারী। অথচ ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা যৌন হয়রানির ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে থাকেন, কিন্তু তাঁদের আইনি সুরক্ষা নেই। ফলে সেবা পেতেও ভোগান্তি পোহাতে হয় তাঁদের।

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির চেয়ারপারসন আনিসুল ইসলাম হিরু বলেন, হিজড়া ও ট্রান্সজেন্ডার—এই জনগোষ্ঠীর জন্য তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করা হয়। এটিও ভাবার বিষয়। আনিসুল ইসলাম জানান, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকের একটি শাখায় একজন ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ট্রান্সজেন্ডার পরিচয়েই একজন নৃত্যশিল্পী বাংলাদেশ টেলিভিশনে তালিকাভুক্ত হয়েছেন। এভাবে আস্তে আস্তে পরিবর্তন আসছে।

বন্ধু সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার সোসাইটির পরিচালক উম্মে ফারহানা জেরীফ বলেন, তাঁদের সংগঠনটি ২৫ বছর ধরে কাজ করছে। ট্রান্সজেন্ডারসহ এ ধরনের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কত, তা নিয়ে বিভ্রান্তি ছিল। বিবিএস একটি সংখ্যা জানিয়েছে, যদিও তা নিয়ে সংশয় আছে, তারপরও সংখ্যাটিকে ধরে এখন কার্যক্রম বা প্রকল্প হাতে নেওয়া সহজ হবে।

গোলটেবিল বৈঠকে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম সূচনা বক্তব্য দেন। এতে সঞ্চালকের দায়িত্ব পালন করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী।