Thank you for trying Sticky AMP!!

ঈদের উৎসব চলত তিন-চার দিন

>

ঈদ হলো আনন্দের ভেলায় চেপে হাসিখুশিভরা বর্ণিল জগতে হারিয়ে যাওয়া। বিনোদনজগতের এই তারকা ফিরে তাকিয়েছেন তাঁর ফেলে আসা ঈদের প্রান্তরে।

মৌসুমী

আমার মায়েরা ছয় বোন আর দুই ভাই। আর বাবারা আরও এক ডিগ্রি ওপরে—ছয় বোন আর চার ভাই। তাই ছোট, বড়, মাঝারি—সব বয়সের, সব আকৃতির, সব ধরনের ভাইবোন ছিল আমাদের। যে কারণে ঈদের দিন শোরগোলের অভাব ছিল না। শৈশবের ঈদ মানে খুলনা শহরের বর্ণময় নানান স্মৃতি!

আমার ঈদের জামা যে কত জমত, তার কোনো হিসাব নেই। আব্বু, আম্মু, খালা, ফুফু, চাচা, মামা, বড় কাজিনরা—সবাই কমবেশি দিতেন। ছয়–সাতটা জামা তো হতোই। মাঝেমধ্যে ১০-১২টাও হতো। আর ভুল করেও আম্মু যদি মুখ ফসকে বলে ফেলতেন, আমার কয়টা জামা হয়েছে, তাহলে আমি খুবই রেগে যেতাম। আর জামা লুকিয়ে রাখা তো ছিল খুবই স্বাভাবিক বিষয়। আমার ঈদের জামা, আমি কেন দেখাব? দেখালেই পুরোনো হয়ে যাবে না! তাই আলমারির একেবারে গোপন প্রকোষ্ঠে তুলে রাখা হতো জামা। এরপর ঈদের দিন শুরু হতো অন্য এক প্রতিযোগিতা—ঈদের দিন কে কতবার জামা বদলে নতুন নতুন জামা পরতে পারে, তার একটা প্রতিযোগিতা লেগে যেত আমাদের মধ্যে। আর সেই প্রতিযোগিতায় যে আমিই জিততাম, তা কি আর বলে দিতে হবে।

ছোটবেলায় আমার ঈদ কাটত দাদিবাড়ি, নানিবাড়ি এবং অন্য সব আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ঘুরে ঘুরে। আমার দাদিবাড়ি খুলনার খালিশপুর, আর নানিবাড়ি সোনাডাঙ্গা। এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ির দূরত্ব ছিল ১০ মিনিটের। তা ছাড়া এর আশপাশেই ছিল আত্মীয়স্বজনের বাড়ি। আমরা দল বেঁধে ঘুরতাম, দিনভর বেড়াতে বেড়াতেই আমাদের ‘খবর’ হয়ে যেত। বড় পরিবার হওয়ায় ঈদে আমরা দারুণ একটা সুবিধা পেতাম। তা হলো, বিভিন্নজনের কাছ থেকে ঈদ সালামি পেতাম। ফলে সালামি হতো অনেক টাকা।

তবে সালামির সেসব টাকা কীভাবে কীভাবে যেন খরচও হয়ে যেত। এখানে–সেখানে যাচ্ছি, এটা–সেটা খাচ্ছি, কিনছি, ঘুরছি—এতেই আমাদের পকেট ফুটো। ঈদ তো মাত্র এক দিনের। কিন্তু এই এক দিনে কি আর বেড়ানো শেষ হয়? ফলে আমাদের ঈদ উৎসব চলত কমপক্ষে তিন দিন বা চার দিন। নিজের বন্ধুবান্ধব তো বটেই, এমনকি আম্মুর বান্ধবী, আব্বুর বন্ধুদের বাসায়ও ঘুরতাম। ঈদ উপলক্ষে স্কুলের বন্ধু সবাই মিলে বের হতাম আইসক্রিম খেতে। 

আমার আম্মু সেমাই, জর্দা, ফিরনি রান্না করতেন ঈদের দিন। মায়ের হাতের সেই জর্দা আমার খুব পছন্দ ছিল। আর পছন্দ ছিল বড় মাছ আর মুরগির কোরমা। আম্মু আবার ডিম সেদ্ধ করে ভেজে সেটা মাংসের কোরমার মধ্যে দিয়ে দিতেন। এটা যে কী মজার রান্না, মনে করতেই জিবে পানি এসে যাচ্ছে! আমার ছেলেমেয়েরাও আম্মুর এই রেসিপিটা খুব পছন্দ করে। মাঝেমধ্যেই আমার কাছে এই খাবারের আবদার করে স্বাধীন ও ফাইজা। আনন্দচিত্তেই তখন ওদের রান্না করে দিই পদটি। সে সময় কি আম্মুর এই ঈদ–রান্নার কথা মনে পড়ে না আমার? পড়ে। ঈদ এলে আরও মনে পড়ে, ঈদের মৌসুমে পিঠা বানানো হতো খালাদের বাসায়। এখন তো ঈদের দিন পিঠা বানানোর চল নেই বললেই চলে। সব মিলিয়ে খুবই জমজমাট খাওয়াদাওয়া হতো ঈদে। যখন যে বাসায় যেতাম, দল ধরে সবাই একসঙ্গে যেতাম। 

এখন যেমন সবার ঈদের দিনের অনেকটা সময় চলে যায় ছবি তুলতে তুলতে, ছোটবেলায় আমরাও কিন্তু ঈদের দিন দল বেঁধে ছবি তুলতাম। একটা ক্যামেরা দিয়ে ৩০টা ছবি তোলা যেত। মজার ব্যাপার হলো, আমাদের ছবি তুলতে তিন–চারটা ক্যামেরা লাগত। হয়তো আমরা একটা ক্যামেরা আনলাম, আবার খালামণিরাও আনলেন—অধিকাংশ সময় এমনই ঘটত। তারপর পুরো পরিবার রীতিমতো পোজ দিয়ে দিয়ে ছবি তুলতাম। কারণ এখনকার মতো ছবি নষ্ট করার তো সুযোগ নেই। আর সবার অন্তত দুটো ছবি তো লাগবেই। কিন্তু আমার দুটোতে চলত না, তাই বেশি তুলতাম। পরে সেসব ছবি স্টুডিও থেকে প্রিন্ট করে আনা হতো। এরপর দল বেঁধে বসতাম সেই ছবি দেখতে। যত্ন করে সংরক্ষণ করা হতো সেইসব ছবি। 

এখন তো বাসায় ছবিই তোলা হয় না। বাইরে বের হলে সবাই এত ছবি তোলে, মনে হয়, সবার কাছে তো আমার ছবি আছেই! তবে এখন আর সে রকমভাবে ঘুরতে যাওয়ার উপায় নেই। আব্বু মারা যাওয়ার পর আর খুলনাতেই যাওয়া হয় না। ঈদের দিন বাসা থেকে বেরও হওয়া হয় না। ফুরসতই মেলে না আসলে। তবে ফাইজা, স্বাধীন—ওরা ঘোরে। দল বেঁধে আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে যায়।

আজকাল ঈদের সময় আমার মনে হয়, একজীবনে একজন মানুষের ঈদ কতভাবেই না বদলে যায়! তবু সবার কাছেই অমলিন থাকে শৈশবের উজ্জ্বল ঈদের স্মৃতি।

মৌসুমী: অভিনয়শিল্পী।