Thank you for trying Sticky AMP!!

ওলগা মিশে গেছেন এই বাংলায়

ওলগা রায়ের জন্ম রাশিয়ায়। তরুণ বয়সটা কেটেছে সেখানেই। ১৯৮০ সাল থেকে জীবন কাটছে বাংলাদেশে। এখন ঝটপট শাড়ি পরতে পারেন। কোরানো নারকেল দিয়ে পায়েস রান্না করেন। বাংলায় কথা বলেন। বাংলা গানও গাইতে পারেন। এ দেশে বন্ধুবান্ধব নেহাত কম নয়। কর্মস্থলের ব্যস্ততা আর ঘরকন্নার বাইরে সময় পেলেই বসে যান তাঁদের সঙ্গে আড্ডায়। বাঙালি কায়দায় জমিয়ে তোলেন খোশগল্পের আসর। এভাবেই তিনি মিশে গেছেন এই বাংলায়। 

১৯৭৬ সালে মণীন্দ্র কুমার রায় পিএইচডি করতে রাশিয়া গিয়েছিলেন। একই হোস্টেলে ওলগার সঙ্গে দেখা। তারপর প্রেম। দেড় বছরের মাথায় তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন বিয়ে করার। বাংলাদেশে মণীন্দ্র কুমার রায়ের মা–বাবা ধাক্কা খেয়েছিলেন ছেলের এমন সিদ্ধান্তে। তবে বাধা দেননি। তাই বিয়ের জন্য শাখা-সিঁদুর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। বিয়ের পর একে একে কেটে গেছে বহু বছর।

ওলগা রায়ের ঠিকানা এখন রাজধানী ঢাকা। আফতাব নগরে ওলগা রায়ের বাসা সাজানো হয়েছে দেশীয় ঢঙে। নাতনির পুতুল সাজিয়ে রেখেছেন যত্ন করে। অথচ মণীন্দ্র রায়ের সঙ্গে পরিচয়ের আগে ওলগা বাংলাদেশের নামও শুনেননি।

ওলগা-মণীন্দ্র দম্পতির দুই ছেলে। তাঁরা মায়ের ফরসা রং পেয়েছেন। ছেলেরা পুরোপুরি বাঙালি। দুই ছেলেই বিয়ে করেছেন বাংলাদেশি মেয়ে। এক ছেলে কানাডা, আরেক ছেলে বাংলাদেশে থাকেন।

মণীন্দ্র কুমার রায় ও ওলগা রায়। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

ওলগা রায় হাসতে হাসতে বললেন, ‘আমাদের পরিবারে যে যাঁর মতো করে ধর্মকর্ম করে। আমি নিজে খ্রিষ্টানধর্মে বিশ্বাসী। স্বামী ও দুই ছেলে হিন্দুধর্ম পালন করে। এক ছেলের বউ মুসলিম, আরেক ছেলের বউ হিন্দু। এ নিয়ে আমাদের কোনো মতবিরোধ নেই।’

ওলগা বর্তমানে মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে শিক্ষার্থীদের রুশ ভাষা শেখাচ্ছেন। এ ছাড়া হলি ক্রিসেন্ট ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষকতা করছেন। মণীন্দ্র কুমার রায় নারায়ণগঞ্জে রনদা প্রসাদ সাহা ইউনিভার্সিটিতে উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এই দম্পতির নাতি-নাতনির সংখ্যা তিনজন। তবে কাছে থাকে না কেউ। তাই সপ্তাহের বেশির ভাগ সময় ওলগার সময় কাটে একাকী। অবসর কাটে বাংলাদেশি বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায়। এ ছাড়া ভিডিও কলে রাশিয়ায় একমাত্র ভাইয়ের পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলে সময় কাটান।

রাশিয়ায় ওলগার বাবা ছিলেন সেনাচিকিৎসক। বাবা অনেক আগেই মারা গেছেন। ওলগার কাছে বাবার তেমন কোনো স্মৃতি নেই। মা একটি রেস্তোরাঁর পরিচালক হিসেবে কাজ করতেন। তিনিই ওলগার লালনপালন করেন। তিনিও বেঁচে নেই। ভাইও মারা গেছেন। পারিবারিক অ্যালবামে সেই ছোটবেলার সাদাকালো ছবি, মা–বাবা, ভাই ও অন্যদের সঙ্গে ছোট ওলগা বা নাতি-নাতনিদের জন্মদিন পালন বা অন্য কোনো রঙিন ছবি দেখেই চলে স্মৃতিচারণা।

ভিন্ন দেশ-সংস্কৃতির এক ছেলেকে ভালোবেসে তাঁর সঙ্গে দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রসঙ্গে ছোট করে ওলগা বললেন, ‘ওকে (মণীন্দ্র) দেখে মনে হয়েছিল ভালো মানুষ। তাই আর দ্বিধা করিনি।’

সেই সময়ের ভালো মানুষটি এখনো তেমনই আছেন কি না, জানতে চাইলে হেসে মাথা নেড়ে সায় দিলেন ওলগা। প্রথম কে কাকে ভালোবেসেছিলেন, জানতে চাইলে মণীন্দ্র কুমার রায় বললেন, ‘ভালোবাসার কথা আবার বলতে হবে কেন? সে তো অনুভবের বিষয়। যাদের মধ্যে ভালোবাসার ঘাটতি আছে, তারাই মুখে ভালোবাসার কথা বলে।’

ওলগা নীল শাড়ি পরেছিলেন। প্রথম আলোতে প্রতিবেদনের জন্য ছবি তুলতে চাইলে মণীন্দ্র কুমার ওলগার দিকে তাকিয়ে জানালেন, এই শাড়িতেই তাঁকে ভালো লাগছে। খুনসুটি করে বললেন, তবে আগে আরও সুন্দর ছিল। ওলগাও হেসে বললেন, তুমিও তো আর আগের মতো নেই। তাঁরা বাংলা, ইংরেজি এবং রাশান যখন যেটা ভালো লাগে সেই ভাষাতেই কথা বলেন।

নিজেদের ফ্ল্যাটে বসে প্রায় সন্ধ্যার আগে আগে প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ওলগা এবং মণীন্দ্র দম্পতির সাংসারিক কথাবার্তাও চলতে থাকে।

মণীন্দ্র কুমার রায় ও ওলগা রায়। ছবি: সাবিনা ইয়াসমিন

অন্য সংস্কৃতি থেকে এসে বাঙালি বউয়ের ভূমিকায় নিজেকে মানিয়ে নিতে ওলগাকে সংগ্রাম করতে হয়েছে। তবে সবার সহযোগিতা পেয়েছেন বলে সংগ্রামের মাত্রাটা বেশি ছিল না বলেই জানালেন তিনি। বললেন, ‘রাশিয়ায় আমার খাদ্যতালিকায় ছিল গাজর, মেয়নিজের মতো খাবার। কিন্তু আমি যখন বাংলাদেশে আসি, তখন এ দেশে এই খাবারগুলোর তেমন চল ছিল না। আমি রাশিয়ায় রুটি খেতাম। কিন্তু বাংলাদেশে এসে দেখলাম, ননদ-দেবরদের ভাত না দিলে চলে না। এখন আমিও ভাত খাওয়া শিখে গেছি। বাসায় একা থাকলে নিজের পছন্দের রান্না করি।’

ওলগা বাংলাদেশকে ভালোবেসেছেন। বাংলা বলতে পারলেও সেভাবে লিখতে পারেন না। আর যুক্তাক্ষরগুলোকে বেশ কঠিন মনে হয় তাঁর কাছে। বাংলাদেশকে ভালোবাসলেও নিজের দেশের প্রতি মায়া কমেনি। তাই নিজের দেশের পাসপোর্ট পরিবর্তন করেননি। এখন পর্যন্ত নিজের মাতৃভাষাতেই কথা বলতে বেশি ভালো লাগে। বললেন, ‘সবকিছুর পরও ওইটা তো আমার নিজের দেশ, নিজের ভাষা।’

বাংলাদেশে আসার পর মণীন্দ্র-ওলগা দম্পতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সংসার শুরু করেছিলেন। ক্যাম্পাসে প্রায় সবাই শিক্ষিত হওয়ায় সেই অর্থে বিদেশি মেয়ে ওলগাকে মেনে নিতে কারও তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। আর ছেলে-ছেলেদের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে এই দম্পতি ভালো আছেন বলে জানালেন। যত দিন বাঁচবেন, ভালো থাকতে চান।