Thank you for trying Sticky AMP!!

ঘরই হোক আশ্রয়কেন্দ্র

সাতক্ষীরার িমরাপাড়া সরকারী প্রাথমিক িবদ্যালয়টি একটি আশ্রয়কেন্দ্রও। ছবি: হাসান রাজা

উপকূল এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা থেকে কিছু কথা বলতে চাই। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি বাংলাদেশের সমগ্র উপকূল এলাকায় সম্ভাব্য জলোচ্ছ্বাসের সময় আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে অবকাঠামো নির্মাণের এক মহাপরিকল্পনা বা মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজে যুক্ত ছিলাম। কাজটি দেওয়া হয়েছিল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়কে (বুয়েট)। আমি তখন সেখানে অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। প্রকল্পটির দলনেতা ছিলেন অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী। আমার দায়িত্ব ছিল পরিকল্পনা প্রণয়নের দিকনির্দেশনা ঠিক করা। এই কাজের সুবাদে পুরো উপকূলে বিভিন্ন জনপদে গিয়েছি। জলোচ্ছ্বাসের সময় আশ্রয় নেওয়ার জন্য সাধারণ মানুষ কী ধরনের আশ্রয়কেন্দ্র চান, সে সম্পর্কে ধারণা পেতে তাঁদের সঙ্গে খোলামেলা কথা বলেছি। এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, সংশ্লিষ্ট সংসদ সদস্য, স্কুলের প্রধান শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক, রেড ক্রিসেন্টের স্বেচ্ছাসেবক এবং অন্যান্য পেশাজীবী সংস্থার সঙ্গে কথা বলেছি। অনেক সময় ওই এলাকার মানচিত্র নিয়ে বাজারের এক পাশে অপরিচিত কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলেছি এবং কোথায় আশ্রয়কেন্দ্র হলে ভালো হয়, সে বিষয়ে তাঁদের মতামত নিয়েছি। মূলত প্রধান মতামত ছিল আশ্রয়কেন্দ্রগুলোকে প্রাইমারি স্কুল হিসেবে নির্মাণ করলে সবচেয়ে ভালো হবে। কক্সবাজার থেকে চকরিয়া, বাঁশখালী, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম শহর হয়ে সীতাকুণ্ডে এসেছি। কোম্পানীগঞ্জ, মাইজদী, বর্তমানে সুবর্ণচর হয়ে সন্দ্বীপ-হাতিয়া গিয়েছি। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের নিমিত্তে কলাপাতা, কুয়াকাটাতেও সময় কাটিয়েছি। টানা ৯ দিন ভোলার চরফ্যাশনে ছিলাম। ভোলা যেহেতু সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তাই ভোলার মানুষের মতামত ওই প্রকল্পে বেশি গুরুত্ব পায়।

আজ থেকে ৩০-৩৫ বছর আগে উপকূলে বসবাসরত অবস্থাপন্ন পরিবারগুলোর টিনের দোতলা বা তিনতলা বাড়ি ছিল। কিন্তু ইট-পাথরের তেমন বাড়িঘর আমার চোখে পড়েনি। আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে একটি পরিবার কত দূর হাঁটতে রাজি আছে, এমন প্রশ্নে এলাকাবাসীর কাছ থেকে উত্তর পেয়েছি এক কিলোমিটারের বেশি নয়। আমরা গবেষণায় পেয়েছি, আশ্রয়কেন্দ্র থেকে একজনের বাড়ি যত দূরে, তিনি তত আগে আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন। আর যাঁর বাড়ি আশ্রয়কেন্দ্র থেকে কাছে, তিনি বাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে আসেন সবার শেষে। বহুবার জানতে পেরেছি, যিনি সবার শেষে আশ্রয়কেন্দ্রে গেছেন, পৌঁছে দেখেছেন সেখানে খালি জায়গা নেই। মূলত তিনি সব থেকে বেশি ঝুঁকি নিয়েছেন। আমি তাঁদের সঙ্গেও কথা বলেছি। জানতে চেয়েছি, কেন তাঁরা তাঁদের বাড়িতে একটি ঘরকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে নির্মাণ করেন না, যা জলোচ্ছ্বাসের সময় উপকারে আসবে? এটা কি নির্মাণ খরচের কারণে? উত্তরে যা জানতে পেরেছি তা আমাকে অবাক করেছে। নদীর তীরবর্তী এবং দ্বীপে বসবাসরত লোকজনের প্রধান বক্তব্য ছিল দুটি। প্রথমত, টিনের একতলা বা দোতলা বাড়ি উত্তরাধিকারীদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া যায়। অর্থাৎ, চৌচালা একটি ঘরের অংশগুলো ভাইয়েরা ভাগ করে নিতে পারে, কিন্তু একটি ইটের বাড়ি ভাগ করা যায় না। দ্বিতীয়ত, টিনের বাড়ি নদীভাঙনপ্রবণ এলাকাগুলোতে ভাঙনের কবলে পড়লে বিভিন্ন অংশ খুলে অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু ইটের তৈরি বাড়ি অন্যত্র স্থানান্তর করা সম্ভব নয়, যার ফলে পুরো বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমি তাঁদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি, ওই অবস্থাপন্ন পরিবারগুলো যদি একটা ঘর উঁচু করে তৈরি করে, যেটা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কাজ করবে, দুর্যোগের সময় ওই বাড়ির পরিবারসহ আশপাশের পরিবার আশ্রয় নিতে পারবে। অধিকাংশ মানুষই তাঁদের ভিটেমাটি এবং গবাদিপশু রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়াটা পছন্দ করেন না।

সাম্প্রতিক কালে বিভিন্ন কাজে যখন উপকূল এলাকাগুলোতে গেছি, তখন দেখেছি যে দেশের আর্থিক অবস্থা উন্নতি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক পাকা বাড়ি গড়ে উঠেছে। মধ্যপ্রাচ্য বা ইউরোপের কোনো দেশ থেকে পাঠানো টাকায় পাকা বাড়ি নির্মাণে কিছুটা আগ্রহ এসেছে। যাঁরা জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকির মুখে বসবাস করেন, তাঁদের জন্য আমার পরামর্শ: যে একটি ঘরকে স্থানভেদে ১০ বা ২০ ফুট উঁচু করে নির্মাণ করুন। সমুদ্র থেকে ৩ বা ৪ মাইলের মধ্যে যাঁদের বসবাস, তাঁরা ধরে নিতে পারেন ভবিষ্যতে ২০ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হানতে পারে। অর্থাৎ তাঁরা একতলা বাড়িটি স্বাভাবিকভাবে ব্যবহারের জন্য তৈরি করবেন এবং জলোচ্ছ্বাসের সময় তাঁরা দোতলা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করবেন। জলোচ্ছ্বাসের সময় যাতে পানি এক দিক থেকে অন্যদিকে সহজে প্রবাহিত হতে পারে—এই বিষয় মাথায় রেখে বাড়ি নির্মাণ করতে হবে। দোতলার ঘরটিতে একটি ছোট রান্নাঘর এবং টয়লেটের ব্যবস্থা রাখা উচিত বলে আমি মনে করি। যাতে চাপাচাপি করে হলেও বসা যায়, সে ব্যাপারটা মাথায় রেখে আসবাব কম রাখাই ভালো।

যেসব এলাকা জলোচ্ছ্বাসে আক্রান্ত হতে পারে, সেই সব এলাকায় মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রেও একই পদ্ধতি নেওয়া যেতে পারে। স্বাভাবিক সময়ে একতলা এবং দোতলায় নামাজ আদায় করা হবে এবং দুর্যোগের সময় যা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে। একতলা খোলা থাকলে ভালো। আর ওপরের ছাদ সমান হলে ভালো হয়। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে ছাদে প্যারাপিট উঁচু করে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করা যেতে পারে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো দুর্যোগের প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা, সাউথ ক্যারোলাইনা অথবা ওই অঞ্চলের দ্বীপরাষ্ট্রগুলো প্রতিবছরই ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হচ্ছে। চলতি বছরের অক্টোবর মাসের প্রথম দিকে জাপানে প্রায় ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস আঘাত হেনেছিল। উন্নত বিশ্বের ধনী দেশগুলোর জনগণ প্রয়োজন হলে সরকারের নির্ধারিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে আশ্রয় নেন। যদি দেখেন যে জলোচ্ছ্বাসের আঘাত থেকে তাঁদের বাড়িটি নিরাপদ, তাহলে তাঁরা মূলত তাঁদের বাড়িতেই থেকে যান।

আমার ধারণা, বর্তমানে বাংলাদেশে যে পরিমাণ ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজন, তার অর্ধেক রয়েছে। উপকূলের পশ্চিমে সাতক্ষীরা, বাগেরহাট ও বরগুনায় আশ্রয়কেন্দ্র প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। হাতিয়া, সন্দ্বীপ বা নিঝুম দ্বীপে বেশ কিছু আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে আরও কিছু আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা দরকার।

আমার পরামর্শ হচ্ছে, জলোচ্ছ্বাস এবং ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকাগুলোতে ব্যক্তিপর্যায়ে অন্তত একটি নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা। এই উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য আর্থিক সহযোগিতা প্রদান করা যেতে পারে।

উপকূলের আবাসন নিয়ে বলতে গেলে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করি; তা হলো গবাদিপশুর জন্য নিরাপদ আশ্রয়। আমাদের নিরাপদ আশ্রয়ের বিষয়টির পাশাপাশি গবাদিপশুর আশ্রয়ের কথাও মনে রাখতে হবে। সে জন্য মাটির উঁচু ঢিবি বা টিলার প্রয়োজন। উপকূলবাসীর কাছে এ ধরনের অবকাঠামো মুজিব কেল্লা নামে পরিচিত। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর জীবদ্দশায় এ ধরনের কেল্লা বা অবকাঠামো নির্মাণ শুরু করেছিলেন এবং এ ধরনের কেল্লার ওপর নির্মিত আশ্রয়কেন্দ্র মানুষ বেশি পছন্দ করে। ঘূর্ণিঝড় আইলা এবং সিডরের পর সরকারের পূর্ত বিভাগ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে বহুসংখ্যক আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করেছে। এই প্রকল্পের পরিকল্পনাকারীরা যদি জনগণের মতামত নিতেন, তাহলে হয়তো মুজিব কেল্লা নির্মাণে অগ্রাধিকার পেত। সেই সঙ্গে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর নকশাও জনসাধারণের পছন্দনীয় হতো। একই সঙ্গে ব্যক্তিগত পর্যায়ে দুর্যোগকালে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এমন বসতবাড়ি নির্মাণে স্থানীয় জনসাধারণকে উৎসাহিত করা যেত।

আইনুন নিশাত পানি ব্যবস্থাপনা িবশেষজ্ঞ, ব্র্যাক িবশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক