Thank you for trying Sticky AMP!!

চীনে কতটা দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে?

অভ্যন্তরীণ চাহিদার ভিত্তিতেই শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার সামর্থ্য চীনের আছে। ছবি: ডিজিটাল ট্রেন্ডস

চীনে বাজার অর্থনীতি চালু হওয়ার পরবর্তী ৩৫ বছরে দেশটি গড়ে ৯

জাস্টিন ইফু লিন

দশমিক ৮ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে—এই উত্থান বিস্ময়কর ও নজিরবিহীন। কিন্তু চীনা বিস্ময়ের অবসানের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে অথবা অন্তত দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি ধীর হয়ে আসছে, এটা স্পষ্ট। ২০১০ সালের প্রথম পর্যায় থেকেই চীনের প্রবৃদ্ধির হার কমতে শুরু করেছে। ২০১৪ সালের শেষ পর্যায়ে এসে এই হার তুলনামূলক বিবর্ণ—৭ দশমিক ৩ শতাংশ।
২০১৪ সালের হার নিম্নমুখী, চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ভবিষ্যতে অন্তত গত দশকগুলোর চেয়ে শক্তিশালী ঝড়ের মুখোমুখি পড়ার আশঙ্কা বেশি। ২০১৫ সালের নীতিনির্ধারকেরা দেশটির ত্রয়োদশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা করতে গিয়ে একটি মৌলিক প্রশ্নের সঙ্গে লড়াই করবেন—চীন কতটা দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রত্যাশা করতে পারে?
একটি দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের জন্য প্রথমে সেখানকার অর্থনীতির সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির হার বুঝতে হয়। আরও বুঝতে হয় অর্জনের উপযোগী সম্প্রসারণের সম্ভাব্য সর্বোচ্চ গতি। আন্দাজ করতে হয় অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক অনুকূল পরিবেশ এবং ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতা ও টেকসই প্রবৃদ্ধিকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে লক্ষ্য অর্জনের উপায়। অ্যাডাম স্মিথ যেমনটা তাঁর অ্যান ইনকোয়ারি ইনটু দ্য নেচার অ্যান্ড কজেজ অব দ্য ওয়েলথ অব নেশনস বইয়ে আলোচনা করেছেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নির্ভর করে শ্রম উৎপাদনশীলতার উন্নয়নের ওপর, যা আজ প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন বা শিল্প উৎপাদনে আধুনিকায়নের ফলে সম্ভব হচ্ছে।
কিন্তু নতুনত্বের সীমারেখায় থাকা উন্নত দেশগুলোর একটা অসুবিধা আছে। নতুন প্রযুক্তির সুবিধা নিতে হলে তাদেরই সেটি তৈরি করতে হয়। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশগুলো ‘দেরিতে আসার সুবিধা’ কাজে লাগাতে পারে। কারণ, তারা অনুকরণ, আমদানি, সংযুক্তি ও অনুমতি (লাইসেন্স) নেওয়ার মাধ্যমে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সুফল পায়। ফলে তাদের খরচ ও ঝুঁকি তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। গত ১৫০ বছরে সমৃদ্ধ অর্থনীতির দেশগুলো বছরে গড়ে ৩ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। আর কয়েকটি উন্নয়নশীল দেশ বার্ষিক ৭ শতাংশ বা তার চেয়ে বেশি হারে ২০ বছর বা আরও দীর্ঘ সময় ধরে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে।
চীন ৩৫ বছর ধরে নজিরবিহীন প্রবৃদ্ধি অর্জন করার পর ‘দেরিতে আসার সুবিধা’ কতটুকু পেয়েছে, তা হিসাব করার জন্য দেশটির প্রযুক্তিগত উন্নয়ন এবং শিল্পোন্নয়নের মাত্রা এবং একই ক্ষেত্রে উচ্চ আয়ের দেশগুলোর অর্জনের মাত্রার ব্যবধানটা যাচাই করতে হবে। এ ক্ষেত্রে, সবচেয়ে ভালো উপায় হলো উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে মাথাপিছু আয়ের তুলনা করা এবং ক্রয়ক্ষমতা সমতার (পিপিপি) সমন্বয়। মাথাপিছু আয়ের ব্যবধান যত বেশি হয়, দেরিতে আসার সুবিধা এবং প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা তত বেশি হয়।
২০০৮ সালে চীনের মাথাপিছু আয় ছিল যুক্তরাষ্ট্রের পাঁচ ভাগের এক অংশের কিছু বেশি। এই ব্যবধান ১৯৫১ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও জাপানের মধ্যকার ব্যবধানের প্রায় সমান। তার পররবর্তী ২০ বছর জাপান বার্ষিক ৯ দশমিক ২ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। ১৯৭৭ সালে যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়ার মাথাপিছু আয়-ব্যবধানও প্রায় কাছাকাছি পর্যায়ে ছিল। এরপর দুই দশক ধরে দক্ষিণ কোরিয়া বার্ষিক ৭ দশমিক ৬ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন করে। সিঙ্গাপুরে ১৯৬৭ সালে এবং তাইওয়ানে ১৯৭৫ সালে একই রকমের ব্যবধান ছিল। পরবর্তী সময়ে তারাও প্রায় ওই ধরনের প্রবৃদ্ধি অর্জনের ধারায় চলে যায়। সম্প্রসারণের মাধ্যমে ২০০৮ সালের পরবর্তী ২০ বছরে চীনের সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধির হার হওয়া উচিত প্রায় ৮ শতাংশ।
কিন্তু সম্ভাব্য প্রবৃদ্ধি হচ্ছে গল্পের একটা অংশ মাত্র। এটা অর্জন করা সম্ভব হবে কি না, নির্ভর করছে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক পরিবেশের ওপর। পরে আসার সুবিধা কাজে লাগানোর জন্য চীনকে অবশ্যই নিজেদের সংস্কার আরও জোরদার করা এবং অর্থনীতির সমস্যাগুলো (রেসিডুয়াল ডিসটর্শন) দূর করার ওপর নির্ভর করতে হবে। আর অগভীরতা ও সমন্বয়হীনতার মতো বাজার-ব্যর্থতা সমস্যা মোকাবিলায় সরকারকে আগে থেকে সতর্ক হতে হবে। প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন ও শিল্প খাতের আধুনিকায়নের জন্যই এ ধরনের উদ্যোগ জরুরি।
কেবল ঘরোয়া ব্যয় নয়, বরং অভ্যন্তরীণ চাহিদার ভিত্তিতেই শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার সামর্থ্য চীনের আছে। দেশটিতে বিনিয়োগের ঘাটতির মতো সমস্যা নেই। আছে শিল্প খাতে আধুনিকায়নের বিস্তর সুযোগ এবং নাগরিক অবকাঠামো, পাবলিক হাউজিং ও পরিবেশ ব্যবস্থাপনার মতো খাতে উন্নয়নের প্রভূত সম্ভাবনা।
আবার, চীনের বিনিয়োগের সংস্থান অনেক। কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় সরকারের সমন্বিত ঋণ মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫০ শতাংশেরও কম। আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী এই পরিমাণকে কমই বলা যায়। ইতিমধ্যে, চীনে বেসরকারি সঞ্চয়ের পরিমাণ জিডিপির প্রায় ৫০ শতাংশ এবং দেশটির বিদেশি মুদ্রার মজুত চার লাখ কোটি মার্কিন ডলারে পৌঁছে গেছে। আর তুলনামূলক প্রতিকূল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতেও চীন সংক্ষিপ্ত মেয়াদি কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগের ওপর নির্ভর করতে পারে; কর্মসংস্থান যত বাড়বে, খরচও ততটাই বাড়বে।
বাইরের চিত্রটা তুলনামূলক অন্ধকারাচ্ছন্ন। উন্নত দেশগুলোর কর্তৃপক্ষ যদিও ২০০৮ সালের অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব কাটিয়ে উঠেছে এবং গুরুত্বপূর্ণ অর্থ ও মুদ্রা-উদ্দীপক নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে, তার মধ্যে কাঠামোগত অনেক সীমাবদ্ধতার সমস্যাগুলো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। জাপানে ‘অ্যাবেনোমিকসের’ সাফল্য অর্জন এখনো বাকি রয়ে গেছে, আর ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক অনুসরণ করছে আমেরিকা ও জাপানের পদাঙ্ক। তারা চাহিদা সীমিত রাখার চেষ্টায় পরিমাণগত শিথিলতার পথ বেছে নিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ছে। কিন্তু কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের হার সীমিত রয়ে গেছে এবং অর্থনীতি এখনো ৬ থেকে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের চেষ্টা করে যাচ্ছে। মন্দা-পরবর্তী পরিস্থিতির চিত্র এ রকমই। চীনের রপ্তানি প্রবৃদ্ধিকে আটকে রেখে এগিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও জাপানকে এখন বেশ ধীরগতিসম্পন্ন মনে হচ্ছে।
ফলে, চীনের প্রবৃদ্ধি বার্ষিক সম্ভাব্য লক্ষ্যমাত্রা ৮ শতাংশের চেয়ে কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নীতিনির্ধারকেরা যেমনটা আগামী পাঁচ বছরের জন্য পরিকল্পনা করছেন, তাতে তাঁদের চীনের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা ৭ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ ধরে নিয়েই সমন্বয় করা উচিত। কারণ, পরিবর্তনই আন্তর্জাতিক পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ রকম প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য দেশটিতে কর্মসংস্থানের সুযোগ স্থিতিশীল রাখতে, অর্থনৈতিক ঝুঁকি কমিয়ে রাখতে এবং দেশটির আয় ২০২০ সালের মধ্যে দ্বিগুণ করার লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হতে পারে।
জাস্টিন ইফু লিন: বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এবং সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। তিনি পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্কুল অব ডেভেলপমেন্টের অধ্যাপক ও অনারারি ডিন এবং চীনা সেন্টার ফর ইকোনমিক রিসার্চের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক। সম্প্রতি তিনি অ্যাগেইনস্ট দ্য কনসেনসাস: রিফ্লেকশন অন দ্য গ্রেট রিসেশন নামের একটি বই লিখেছেন।