Thank you for trying Sticky AMP!!

যেতে যেতে যেতে

রাজ্যপাট আছে, রাজা-রানি আছে, পেয়াদা আর কোতোয়াল আছে, অথচ রূপকথা নেই, এমন দেশে আমি পথে পথে ঘুরেছি। মনোহরণ চপলচরণ রূপকথার খোঁজে।

রূপকথা আমার বড় ভালো লাগে। লোকে ভাবে, অলস লোকে অমনই হয়। কেবল রূপকথাতেই রাত পোহালে বুদ্ধি বাড়ে, এক রাতে শিমগাছ মেঘের রাজ্যে পৌঁছে যাওয়ার মতো দীর্ঘ হয়ে যায়, রাজার লুট করে আনা দুঃখিনী মেয়ে এক ঘুম দিয়ে উঠে দেখে তার সব সুতো কোনো অদৃশ্য সুতোকাটুনি কেটে দিয়ে গেছে। রূপকথাতে বেঙ্গমা-বেঙ্গমি রাজপুরুষের বেশে রাজকন্যাকে দেখলেও গাছের ওপর বসে বসে বডিশেমিং তো করে না, ক্রস ড্রেসিংয়ের কারণে গঞ্জনাও দেয় না, ভালো মানুষের মতো ভবিষ্যতে কার্যসিদ্ধির উপায় বাতলে দেয়। এমন বন্ধু আর কে আছে! একবার বলতে গেছিলাম, একই কারণে ধর্মকথাও আমার ভালো লাগে, এই হাত-ইশারায় চন্দ্রভাগ বা নীল নদ-ভাগ, এই ক্রুশে গিয়ে ফিরে আসা, এই যুদ্ধের ময়দানে মুখের ভেতর আলগোছে তেলাপিয়ার ডিমগুচ্ছের মতো করে বিশ্বরূপ লুকিয়ে রাখা...সব ভালো লাগে, কেবল ওসবেই আজকাল শুভ অপরাজিত আছে, দুর্বল জয়ী হয়ে আছে। কিন্তু এখানে সে কথা কইবার নয়, ও থাক। মোটের ওপর বুঝতে পারলেন নিশ্চয়ই যে তরিয়ে দিলেই আমার পোষায়। এই আতান্তরের বাস্তব আমার এক্কেবারে ভালো লাগে না। অতএব রূপকথার জন্য আমার দীর্ঘ অপেক্ষার গল্পটা আপনাদের বলেই ফেলি।

ছোট্টবেলায় রুশিরা তাদের রূপকথায় শুনিয়েছিল যে তাদের উত্তরাঞ্চলে সোহাগী গ্রীষ্মে পূর্বে আর পশ্চিমে একই সঙ্গে গোলাপি আলো জেগে থাকে—একটা সূর্যাস্তের, আরেকটা সূর্যোদয়ের, সেই দেশ তাই রূপকথার। তাদের রূপকথার রাজকন্যার হতো আবলুশ কাঠের মতো কালো চুল, নইলে সোনার জরির মতো চুল, পুরু তোয়ালের মতো সেই চুল পড়ে থাকত ঘাড়ে-পিঠে। অতএব সারা ঘর খুঁজে কালো তোয়ালে না পেয়ে একটা বিচ্ছিরি হলুদ তোয়ালে মাথায় দিয়ে ছোট্টবেলায় আমি ভাবতাম, এই আমার সোনালি চুল, বুঝলেন, তারপর ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে রাজপুত্রের অপেক্ষা করতাম। ঘুম না এলে ভাবতাম, যে তোশকে পড়ে আছি, সে তোশকের তলায় মটরশুঁটি থাকলে টের পাব তো? একটিমাত্র রাজপুত্র আসবে বলে অপেক্ষায় থেকে থেকে মেয়েশিশুরা কত কত রাজা-গজা-কোতোয়ালের হাতে পড়ে, ‘হাতে পড়াটা যদি কেমন শোনায়, তবে বলব, আপনা থেকেই যায়। যা-ই হোক, রাজপুত্র নিজে ঘোড়ায় চেপে না এলে রাজকন্যারা নিজেরাই ঘোড়ায় চেপে (সাইড-স্যাডলে নয় কিন্তু, ওসব রূপকথায় থাকে না) দিগ্‌বিজয়ে বেরিয়ে যায়, সেটা তো নিশ্চয়ই দেখেছেন। মনে ভাবি, সেই দিগ্‌বিজয়ের নাম ‘আত্মানং বিদ্ধি’। সেখানে শরীর রথ, বুদ্ধি সারথি, আর মন পরিচালিকা রজ্জু। এই দেখলেন, আবার রূপকথা থেকে ধর্মকথায় চলে এলাম। আগেই তো বলেছি, রাজকন্যারা রাজপুত্রকে উদ্ধার করে, নিজেই রাক্ষসীর গুষ্টিনাশ করে—এমনটা বাস্তবে ঘটবার অনেক আগেই রূপকথায় ঘটে গেছে; এমনি কি আর ভালো লাগে, বলুন!

মুশকিল হচ্ছে, রূপকথার পটভূমি তো থাকা চাই, নইলে কিসের রূপকথা। এই চা-খানা, লন্ড্রি, ‘হাতের লেখা ভালো করুন’, স্টিমারজেটি, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, স্টেশনের সামনে আখপাতার ছড়াছড়ি, ‘এখানে প্রস্রাব করিবেন না’...এসব হট্টগোলের ভেতর হলদে কালো কোনো তোয়ালের মতো একঢাল কেশ এলিয়ে বসে থাকলেও পক্ষীরাজ ঘোড়ায় চেপে কেউ আসবে না। তার জন্য চাই নিবিড় বন, বুঝলেন, নিশ্ছিদ্র অরণ্য, ধর্মপুরুষেরা যে রকম বনে আগুন দিয়ে ময়দানবকে ধরেছিল। আরও মুশকিলের কথা এই, লোকে বনে আগুন দেওয়ার কথা শিখেছে, বন যে থাকতে হয়, সেসব গেছে ভুলে। এখন বলুন, বন নইলে বেঙ্গমা-বেঙ্গমি ঝলসানো কোনো ডালেও কি বসতে পারে? বন ছাড়া বনবাসিনী হয়? বন ছাড়া কি আর বনের মাঝখানটিতে ঘুমন্ত রাজপুরী হয়? অ্যান্ডারসন সাহেবের রূপকথাটাই ধরুন, বনরাজি বসন্তে স্নিগ্ধ হয়ে উঠবার কালেই কিনা সরোবরের আয়নায় মুখ দেখে কুচ্ছিত হাঁসের ছানা টের পেল, সে হয়ে উঠেছে মনমোহিনী রাজহাঁস। অ্যান্ডারসন সাহেবের কথা উঠল বলেই একটা কথা বলে রাখছি, দেখবেন এই আমার মতো বাপে-খেদানো, মায়ে-তাড়ানো, স্যারে-কেলানো ছেলেমেয়েরাই এমন উপর্যুপরি রূপকথারোগে ভোগে। যেমন হান্স ক্রিশ্চিয়ন অ্যান্ডারসন। যেমন এই অধম।

শুনুন, এই বলে রাখলাম, পরে বেঙ্গমির ভাষ্যের মতো করে মিলিয়ে নেবেন, বন চলে গেলে রূপকথা তো যায়ই, সঙ্গে আরও কিছু যায়। রূপকথা চলে গেলে মানুষে মানুষে মর্মস্পর্শী বিরহ-বিচ্ছেদ—এই সব চলে যায়, ভালোবাসাও যায়। ওই যে অ্যান্ডারসনের ছোট্ট মৎস্যকন্যা, ভেবে দেখুন, সে লেজ হারাল, জিব হারাল, প্রাণ হারাল একটিমাত্র পুরুষকে ভালোবেসে...এসব রূপকথা আমাদের ছোটবেলায় আততায়ীর মতো এসে হানা দিয়েছিল, মনে আছে? মনে আছে, অবচেতনে এসব গল্পই শিখিয়ে গেছিল—ভালোবাসলে ভাষ্য বদলাতে হয়, জীবন বদলাতে হয়, মরেও যেতে হয়? পাবেন আর এমনটি খুঁজে? রূপকথা ছাড়া?

রাজ্যপাট আছে, রাজা-রানি আছে, পেয়াদা আর কোতোয়াল আছে, অথচ রূপকথা নেই, এমন দেশে আমি পথে পথে ঘুরেছি। মনোহরণ চপলচরণ রূপকথার খোঁজে। সে কি আর মেলে রে ভাই! ঢাল-তরোয়াল পাবেন, অথচ রাজার মতো কলজে পাবেন না, যে পাতাকুড়ুনির ছেলের মুখ দেখে সকালবেলা নিজের মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়ার মতো শ্রেণিজ্ঞানহীন যে একবাক্যে রাজ্যপাট ত্যাগ করে ওই ‘আত্মানং বিদ্ধি’ করতে চলে যাবে। নেই জেনেও এমনটি খুঁজি। কেননা, আমরা সেই সব ছেলেমেয়ে, যারা জাদুকরের বাঁশি শুনে পিলপিল করে বের হয়ে এসেছিলাম নগরপিঞ্জর থেকে, যে যার বালাপোশের ঢাকনা থেকে, ভালোবেসে চিরকুট লিখলেও আমরা লিখেছি, ‘তোমার নামে চাঁদের ছাঁচে একটা দিঘি কাটাব আমি, একটা জলসত্র খুলব, তোমার জন্মদিনে খুলে দেব বাদশাহি তোশাখানা।’ রূপকথার হাতে অনন্যোপায় বন্দী প্রজন্ম আমরা, সামরিক জান্তাদের ছায়াতলে শৈশব কাটিয়েছি যারা, আমাদের রক্তে উল্কির মতো আঁকা আছে রূপকথা, অসম্ভবের গান।

এত নেই নেই করছি, কিন্তু আসল কথাটাই তো বলছি না। আছে মশাই, আছে জনাব। যেদিন আশপাশে কেউ নেই, সেদিন কালভার্টের ওপরকার রাস্তা ধরে নাক বরাবর চলুন। আমাদের ক্লাবঘরের পিছে যে বাঁধাকপির খেত ছিল আগে, নিচু এলাকার জলাজমি, ওই যেখানে এখন জিমখানার মাঠ, যেখানে খুনখারাবি হয়েছিল কয়েক বছর আগে, সেদিকটা দিয়ে ঢুকবেন। অনেকটা যেতে হবে। না না, রিকশা নেবেন না, পদব্রজেই যেতে হবে। পিছু তাকাবেন না, আশপাশেও তাকাবেন না, ত্রৈলোক্যনাথ যেমন করে বাঘের পিঠে চেপে সুড়ঙ্গ পার হতে বলেছিলেন, অমনি করে রাস্তাটা পেরোতে হবে। অনেক দূর নাকি অল্প দূর? দেখবেন সরু একটা নদী যায়, তীরের কাছে দুপুরমণির ঝোপ, আর সেখানে বনমানুষ গভীর অভিনিবেশযোগে উইপোকা ধরে ধরে টিপে টিপে খাচ্ছে। বলবেন, মিউনিসিপ্যালিটির ভেতর নদী-ঝোপ-বনমানুষ এত রকমের ঢপ দিচ্ছি! আরে, নিঃসংশয় মন ছাড়া কি আর দেখা মেলে? না রূপকথায়, না ধম্মোকথায়। প্রত্যয় না গেলে কী করে বলি যে আমি নিজে গেছি সেখানে। চর্মচক্ষে দেখে এসেছি।

একটা খামারবাড়ি আছে ওখানে, চিড়িয়াখানাও বলতে পারেন, মস্ত জায়গা। রয়েসয়ে দেখলেই টের পাবেন জাদুটা কোথায়। সাদাচোখে দেখলে ডোবায় হাজারটা ব্যাঙ ডাকছে—জিজ্ঞেস করুন ওরা কারা। একে অন্যের পিঠে চেপে বুক আঁকড়ে বসে ডিম পাড়তে পাড়তে বলবে, ‘কেউ নই বাবা, কেউ নই, তুমিও কি “কেউ নই”? তবে তো আমরা দুজন একাত্ম’...বুঝলেন? এমিলি ডিকিনসনের ব্যাঙ! ভাবুন তো! ব্যাঙের মৈথুনের মতো প্রকাশ্য, ব্যাঙের সভার মতো সরব আর সম্ভোগোন্মুখ ডোবা দেখে চেনা চেনা লাগছে? হাসাবেন না দোহাই, পা চালিয়ে সামনে চলুন।

সাবধান, কুকুর দেখলে ঘাবড়াবেন না, ভাবতে শিখুন ওটা হয় আইনস্টাইনের কুকুর নয়, পাভলভের কুকুর, স্বভাব বিচার করলেই টের পাবেন। কী বললেন, বিড়াল দেখলে ধরে নেবেন পো সাহেবের বেড়াল? বাহ, এই তো দিব্যি প্রশিক্ষিত লোকের মতো কথা বলছেন। পো সাহেবের না হয়ে ওটা সুকুমারবাবুর বিড়ালও হতে পারে, ফ্যাচফ্যাচ করে হাসছে আর রানাঘাট থেকে তিব্বত যাওয়ার সিধে রাস্তা ভাবছে। ওর নাম চন্দ্রবিন্দু কিংবা রুমাল। পুরোনো শিমুলগাছটায় খুব কাকের বাসা হয়েছে দেখবেন। এই কাকগুলো আপনার চেনা কি না ঠাহর করে দেখুন তো? ভ্যান গঘের মৃত্যুর আগে গমখেতে এদেরকেই ওড়াউড়ি করতে দেখেছেন কি না! দুর্ভিক্ষের কালে আবেদিন সাহেবের ক্যানভাসেও উড়ে এসেছিল এক ঝাঁক। ডাকলেই এসে নিজের পরিচয় দেবে, আমি ডেকে দেখেছি।

একটা তামাশার কথা বলেই ফেলছি ভাই। দেখবেন তেঁতুলগাছের চিরল চিরল পাতার ছায়ায় একটা জেব্রা চরে বেড়াচ্ছে, আর মাঠময় পড়ে থাকা শিমুলফুল খাচ্ছে। মেদহীন পিঠের খাঁচার তলায় দলদলে পাছা, ওটা লর্ড ক্লাইভের জেব্রার পাছা। এই জেব্রাঘোটকীকে ক্লাইভ নিজের পোষা গাধাটার সঙ্গে মিলনে বাধ্য করেছিলেন, গাধার গায়ে জেব্রার মতো ডোরা এঁকে দিয়েছিলেন তার আগে যেন জেব্রামানবী গাধাটাকে একেবারে গর্দভ না ভাবতে পারে! গাধায় আর জেব্রায় সংগম ভাবতে পারে যে সে-ই তো জাঁকিয়ে বসবে ভূভারত, তাই না? দুই শ বছর শাসন করতে তারাই তো পারবে। যাওয়ার কালে অবশ্য সক্কলকে পৃথগন্ন করে দিয়ে যাবে। এত দিন ধরে এই জেব্রা আপনাকে এমন একটা আশ্চর্য গল্প বলবার জন্যই চরে বেড়াচ্ছে।

এখানে একটা ঘোড়া আমার খুব প্রিয় জানেন। ঠোঙায় করে কয়েকটা আপেল নিয়ে যাবেন তার জন্য। জেব্রা চরবার মাঠটা থেকে বেশি দূরে নয় আস্তাবল। ঘোড়াটা বড় মার খাওয়া ঘোড়া। এই ঘোড়াটাকেই মুখ বুজে অবিরাম মার খেতে দেখে এক জার্মান সাহেব এসে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘আমি তোমায় বুঝতে পারি।’ ওই ঘটনার পর থেকেই অবশ্য সাহেব মানসিক ভারসাম্য হারাতে বসেছিলেন। চিনতে পারলেন কি না বলুন? আরে জনাব, আরে মশাই, নিৎসে সাহেবের ঘোড়া এটা। মানুষ যখন প্রাণীর ব্যথা, প্রাণীর কথা আপনার জ্ঞানে বুঝতে পারে, যখন পশুখামারে নিজেদের দেখতে পায়, যখন শাসকের যথেচ্ছাচারে নিজের বংশগতি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে টের পায়, যখন স্বাধীন সোচ্চার হওয়ার আহ্বান বুকে পায়, তখন একরকম রূপকথার মুহূর্ত জন্মায়। জন্মায় কি না বলুন? সেভাবে দেখলে এরা প্রত্যেকে এমন একেকটি রূপকথার সাক্ষী। খতিয়ে দেখেছিলাম আমি, এরা প্রত্যেকে যে যার গল্প জানে, এত দিন যে যার গল্প বলবার জন্য বেঁচে আছে। চাইলে জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন। নিজের আদ্যোপান্ত ইতিহাস তো বলবেই, চ্যা-ভ্যা করতে করতে এমনকি জন স্টুয়ার্ট মিল শুনিয়ে দেবে আপনাকে। তবু তো বলবেন, ওসব বাজে কথা, কথাবলা প্রাণী না বুজরুকি! জলবাহিত প্যাথোজেনের মতো চেহারা করে বলবেন, ‘মানুষেই আজকাল কথা কইতে পায় না, আর জানোয়ারের কথাবার্তা! যত্ত সব ছেলেভুলানি-মেয়েভুলানি গাঁজাখুরি রূপকথা!’ আহা, রূপকথাই না দেখতে চেয়েছিলেন? যেখানে প্রাণীরা মানুষের ভাষায় কথা বলে?

তবে কথা হচ্ছে, ক্লাবঘর আর জিমখানার ওদিকটার পথে যদি মাঠ খুঁজেও পান, দেখবেন শপিং কমপ্লেক্স হবে বলে বরাদ্দ করা জমিন, দেখবেন ময়লা ফেলে বুজিয়ে ফেলা ডোবা; তখন কিন্তু আর ওই চিড়িয়াঘরে যেতে পারবেন না, দুষবেন না ভাই, আগেই বলে রাখলাম।