Thank you for trying Sticky AMP!!

লোকসংগীতের ফিউশায়ন

ফিউশনের অবশ্য অন্য রকম আগ্রহোদ্দীপক দিকও আছে। কথিত আছে, জাপানি ও কোরিয়ানরা পশ্চিমা ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতে পশ্চিমাদের থেকে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল ও পারদর্শী। অথচ এই দুই দেশ একসময় পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনের প্রবল বিরোধিতা করেছিল।

জেমস, আনুশেহ ও অর্ণব—ফিউশনের মধ্য দিয়ে লোকসংগীতকে নতুনভাবে উপস্থাপন করছেন তাঁরাসহ অনেকেই

বাংলাদেশের লোকসংগীতের সঙ্গে আবহমান বাংলার লোকসংস্কৃতির রয়েছে এক গভীর যোগাযোগ। এসব সংগীতের তাল, লয়, কথা ও উপস্থাপনে জড়িয়ে আছে স্বকীয়তা, উদাসীন ভালোবাসা ও গভীর দর্শনের প্রবহমান উপস্থিতি। ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, পল্লিগীতি ও বাউলিয়ানার সংস্কৃতি এক সহিষ্ণু বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে সবার সামনে পরিচয় করিয়ে দেয়। অবশ্য এখন এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে এসেছে বৈচিত্র্য। কেননা, ‘লোক’ ও ‘লোকালয়’-এর ধারণা আর আগের মতো সরলরৈখিক নেই। গ্রামে গ্রামে এখন পাওয়া যায় শহুরে ও আন্তর্জাতিক সংস্কৃতির ইন্টারনেট। বিশ্বায়ন ও অবাধ যোগাযোগ এখন দেশের সংস্কৃতিকে করেছে একই সঙ্গে দেশি ও আন্তর্জাতিক।

সংগীতশিল্পী, গবেষক ও শিক্ষক মৃদুলকান্তি চক্রবর্তী বাংলাদেশি বিশ্বকোষ বাংলাপিডিয়ার প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলা লোকসংগীতের স্বাতন্ত্র্য এর বিশিষ্ট রূপভঙ্গি ও সাত স্বরের বিশেষ ব্যবহারের ক্ষেত্রে।’ কেবল সুরের দিক দিয়ে নয়, ছন্দের দিক দিয়ে এর মধ্যে নানা বৈচিত্র্যের সৃষ্টি হলেও মৃদুলকান্তি মনে করেন, বাংলা লোকসংগীতে ভাটিয়ালি সুরেরই একচ্ছত্র আধিপত্য রয়েছে। সেই সুরকে মোটা দাগে ঠিক রেখে দেখা যাচ্ছে এর উপস্থাপন ভঙ্গিতে আসছে কিছু পরিবর্তন।

হাল আমলে গেরুয়া রঙের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে কিছু কিছু বাউলকে দেখা যায় ব্যান্ড সংগীতের আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সঙ্গে গাইতে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীত শিল্পীদেরও দেখা যায় ওই বাউলদের মতো করে এবং তাঁদের বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে লোকসংগীত উপস্থাপন করতে। এখানে ব্যান্ড শিল্পীরা অনেক ক্ষেত্রে বাউলদের বাদ্যযন্ত্রের আধুনিকীকরণও করছেন। দেখা যাচ্ছে, সাধারণ দর্শক-শ্রোতারাও গ্রহণ করছেন তাঁদের এই ধরনের উপস্থাপনা। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এই পারস্পরিক আদান-প্রদান বা ফিউশন ধীরে ধীরে আমাদের লোকসংগীতের পরিমণ্ডলে ফিউশন সংগীত হিসেবে স্থায়ী জায়গা করে নিচ্ছে।

প্রযুক্তি ও বাজার অর্থনীতির অগ্রগতি এই ভিন্নধর্মী সংস্কৃতিকে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে গড়ে তুলছে। তাই কৌশিক হোসেন তাপসের গানবাংলা টিভিতে চিশতি বাউলকে যখন দেখা যায় দেশি-বিদেশি সংগীতশিল্পী ও যন্ত্রের মাধ্যমে ফিউশন করে ‘বেহায়া মন ১-২’ গাইতে, তখন এটা বলাই যায় যে বাজার অর্থনীতির প্রসারের মুখে অনিবার্য হয়ে উঠেছে ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতি, অর্থাৎ একে অন্যের কণ্ঠে কথা বলার চেষ্টা করবে। তো, ফিউশনমূলক এই গানের ভিডিওগুলোর ভিউ থাকে মিলিয়নের ওপরে। এগুলো এখন এটা প্রমাণ করে যে লোকসংগীতের ফিউশন অগাধ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। একই সঙ্গে মিউজিক ভিডিওগুলো আমাদের আরও দেখিয়ে দেয় যে ঐতিহ্য ও আধুনিকতার প্রসার আমাদের জানাবোঝার দিগন্তের মধ্যে নতুন বৈচিত্র্যই রেখে যায়। পৃথিবীব্যাপীই চলছে এই অবস্থা।

দার্শনিকভাবে ব্যাপারটা ব্যাপকভাবে উৎসাহব্যঞ্জক। কারণ, উপরিউক্ত জানাবোঝার দিগন্তটি আমাদের সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ঐতিহ্য ও ভাব প্রকাশের ভাষা—এসবের সমন্বয়ে গঠিত। যেমন সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর জীবনযাপনের পদ্ধতি সমাজ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমাদের নিজস্ব ধ্যানধারণাকে গড়ে তোলে। ফলে যা লোকসংগীত, তার অর্থ কেবল সংস্কৃতিগত ঐতিহ্য, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর জীবনযাপনের পদ্ধতি এবং পৃথিবী সম্পর্কে গড়ে তোলা ধারণার দিগন্তের মধ্যেই অর্থবহ হতে পারে। কারণ, আমাদের গড়ে ওঠা ও জানাবোঝার দিগন্তের উপাদানগুলোই কোনো কিছুর অর্থ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ ফরাসি কম্পোজার হেক্টর বার্লিয়োজের কথা বলা যায়। বার্লিয়োজ বলেছিলেন, ‘চীনারা কুকুরের কান্নার মতো গান গায়, এ রকম শব্দ করে যেন বিড়াল ব্যাঙ গিলে ফেলেছে।’ এই ধরনের বর্ণবাদী মন্তব্য আসলে যতটা না চীনা গানকে উপস্থাপক করে, তার চেয়ে বেশি করে বার্লিয়োজের অজ্ঞতাকে। আবার বার্লিয়োজের এই অজ্ঞতা পৃথিবী অনুধাবন সম্পর্কে দার্শনিক কান্টের মন্তব্যকে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলে। কান্ট বলেছেন, ‘আমরা শুধু একটি জিনিস নিজের মধ্যে অনুবাদ করে উপলব্ধি করি, যা সময় ও স্থান দ্বারা উপলব্ধ হয়। আর আমাদের লোকসংগীতের এই ফিউশন সেই “সময় ও স্থান”-এর গল্প বলে, যেখানে লোক ও লোকালয়ের ধারণা সদা প্রবহমান ও পরিবর্তনশীল।’

কিন্তু লোকসংগীতের এই ফিউশন বেদনাদায়কও বটে। কেননা, ফিউশন বলে আধুনিক উন্নয়নের এই কংক্রিটের জঙ্গলে ‘লোক’কে হতে হবে শহুরে ও আধুনিক। আর এভাবে আধুনিকতার মাধ্যমে লোকসংগীতের উপস্থাপন আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে এটা বলে এবং বুঝিয়ে দেয় যে লোকসংগীতের মূল স্পিরিট, তাল ও লয় পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এর ফলে লোকসংগীতকে হয়তো তার নিজস্ব ঢঙে আর বোঝা হয়ে উঠবে না তরুণ প্রজন্মের। করপোরেট পুঁজি, ইন্টারনেট এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে লোকসংগীতের এই আধুনিক উপস্থাপন একই সঙ্গে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে এক আগ্রাসী সংস্কৃতির গল্প, যেখানে সবার গ্রহণযোগ্য হতে হলে বিশেষভাবে উপস্থাপন করতে হবে।

ফিউশনের প্রধান সুবিধা হলো, এটা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার মধ্যে একটা সেতু তৈরি করে এবং ফিউশনের এই সেতু বিশ্বায়নের যুগে জন্ম নেওয়া নাগরিকদের লোকসংগীতের দিগন্তকে উপলব্ধি করার জন্য একটি পরীক্ষামূলক প্রবেশাধিকারও দেয়। তবে এই ধরনের ফিউশনের সেতুরও আবার অসুবিধা রয়েছে। মনে করুন, যখন একটা দ্বীপের জন্য একটা সেতু তৈরি করা হয়, সে সময় ওই দ্বীপের লোকজন অভিযোগ করতে পারে যে এই সেতুর ফলে মূল ভূখণ্ডের লোকজন দ্বীপের লোক ও লোকালয়কে চিরতরে বদলে দেবে। এই উদাহরণ দিয়েই বাংলাদেশের ফিউশনমূলক লোকসংগীতের বাতাবরণকে ব্যাখ্যা করা যায়। যদিও বাংলাদেশের লোকসংগীত ও সংস্কৃতি একসময় ছিল এই ভূখণ্ডের মূল সংগীত, কিন্তু বিশ্বায়নের যুগে সারা বিশ্ব যখন সংগীতকে এক ঘরানায় প্রকাশ করার জন্য উদ্‌গ্রীব, সেই প্রেক্ষাপটে এ দেশের লোকসংগীতের ফিউশনকে আমরা ধরে নিতে পারি পশ্চিমা সংস্কৃতির ওপর ক্রমশ নির্ভরশীল হয়ে ওঠা এবং পশ্চিমের স্বাদে দেশীয় সংস্কৃতিকে উপস্থাপন করা—এমন ভাবে। এর ফলে ঐতিহ্যবাহী শিল্পের ফর্ম ধীরে ধীরে পাশ্চাত্য শৈলীতে রূপান্তরিত হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তৈরি হয়, যেমন আমাদের লোকসংগীতের ফিউশনগুলোতে হচ্ছে।

ফিউশনের অবশ্য অন্য রকম আগ্রহোদ্দীপক দিকও আছে। কথিত আছে, জাপানি ও কোরিয়ানরা পশ্চিমা ক্ল্যাসিক্যাল সংগীতে পশ্চিমাদের থেকে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল ও পারদর্শী। অথচ এই দুই দেশ একসময় পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসনের প্রবল বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ জনগণের জন্য যেসব স্কুল রয়েছে, সেখানে যেহেতু বিটোফেন বা তুসকানির ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত শেখানো হয় না, তাই সাধারণ মার্কিন নাগরিকদের মধ্যে এমন ধারণা হচ্ছে, ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত পশ্চিমা সংস্কৃতির মূল উপাদান নয়; বরং ইউরোপের অভিজাত সংস্কৃতির উপাদান ও উপলক্ষ। তবে জাপান ও কোরিয়ায় বাস্তবতা এর উল্টো, এই দুই দেশের মানুষ সাধারণত স্কুলেই পশ্চিমা ক্ল্যাসিক্যাল সংগীত শেখে। ফিউশন কেন ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতির মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করে, তা নিয়ে গবেষণা হয়েছে বিস্তর। এ ক্ষেত্রে মোটামুটি সবারই আছে একই ধরনের উপসংহার, যেখানে বলা হয়, সংগীতের একটি বৈশ্বিক আপিল রয়েছে। আছে সর্বজনীন অনুভব। ভিন্ন ভাষা, সুর, তাল, লয়ের মধ্যে এমন কিছু আছে, যা সাংস্কৃতিক বৈষম্যভেদে মানুষকে আকর্ষণ করে এবং যা ভেঙে ফেলতে পারে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রথাগত ধারণাও। এর মধ্য দিয়ে প্রতিনিয়ত গঠন ও পুনর্গঠন হচ্ছে জাতীয়তা ও সংস্কৃতির পরিচয়। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বলতে পারি, ফিউশন আমাদের একই সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী ও আধুনিক করে তুলছে, যেমনভাবে বদলে যাচ্ছে আমাদের লোক, লোকালয় ও লোকসংগীত।