Thank you for trying Sticky AMP!!

সাগরতলে ক্লিক ক্লিক

লায়ন ফিশ

গভীর সমুদ্রে ঘুরে বেড়াচ্ছেন একজন দুঃসাহসী ফটোগ্রাফার। পরনে ডুবুরির পোশাক। হাতে জলের নিচে ছবি তোলার উপযোগী বিশেষ ক্যামেরা। স্বচ্ছ নীল জল, পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে অসংখ্য রঙিন মাছের ঝাঁক। একপাশে ভাসছে কিছু সি হর্স। দূরে গম্ভীর মুখে এগিয়ে যাচ্ছে জেলি ফিশের ঝাঁক। আশপাশে নানা রকমের প্রবাল, পাথর ও সামুদ্রিক গাছ। গাছ, পাথরের ভেতর থেকে একটু পরপরই উঁকি মারছে অসংখ্য চঞ্চল মাছ। এমন সৌন্দর্য যেন ক্যামেরায়ও বন্দী করা সম্ভব নয়! তবু একের পর এক ছবি তুলে যাচ্ছেন ফটোগ্রাফার। হঠাৎই চোখে পড়ল ওটা। একটা অক্টোপাস! প্রতিমুহূর্তে নিজের রং বদলাচ্ছে অক্টোপাসটা। এক মুহূর্ত দেরি না করে অক্টোপাসের ছবি তোলা শুরু করলেন। ছবি তোলার নেশা পেয়ে বসেছে তাঁকে। ক্যামেরার শাটার চাপতে চাপতে একেবারে অক্টোপাসটার কাছে চলে গেলেন তিনি। আচমকা অক্টোপাসের একটা শুঁড় চেপে ধরল ক্যামেরাটা। কিন্তু তাতেও ঘাবড়ালেন না ফটোগ্রাফার। সমুদ্রের এ ভয়ংকর বাসিন্দার সঙ্গে শক্তিতে পারবেন না, তা ভালোমতোই জানেন তিনি। তাই মাথা ঠান্ডা রেখে ছবি তুলতে তুলতে ধীরে ধীরে পিছিয়ে আসতে লাগলেন। এতে কাজ হলো। ক্যামেরাটা আর ধরে রাখতে না পেরে ছেড়ে দিল অক্টোপাসটা। তারপর রং বদলাতে বদলাতে একটা প্রবালের আড়ালে হারিয়ে গেল সে। ফটোগ্রাফারও ভুস করে ভেসে উঠলেন জলের ওপর।

শরীফ সারওয়ার

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেলে এমন দৃশ্য আমরা প্রায়ই দেখি। তবে ওপরের ঘটনাটা কিন্তু আমাদের সেন্ট মার্টিন দ্বীপের। আর সেই দুঃসাহসী ফটোগ্রাফারের নাম শরীফ সারওয়ার। ২০১২ সাল থেকে সাগরতলের ছবি তুলছেন তিনি। এর আগে অনেকগুলো দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেছেন। কোথায় মিছিল-মিটিং হচ্ছে, ককটেল ফাটছে—এসবের ছবিই তুলতেন প্রতিদিন। কিন্তু এসব ছবি তুলে মন ভরত না তাঁর। একসময় চাকরি ছেড়ে দিয়ে ভাবতে বসলেন—নতুন কিছু কী করা যায়! একদিন ডিসকভারি চ্যানেলে দেখলেন পানির নিচের জগতের ছবি। বুদ্ধিটা এল তখনই। ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় সমুদ্রসৈকত আমাদের, আছে অসাধারণ সুন্দর প্রবাল দ্বীপ সেন্ট মার্টিন। চেষ্টা করলে নিশ্চয়ই আমাদের দেশেও পানির নিচের জগতের ছবি তোলা সম্ভব। এমনটাই ভেবেছিলেন শরীফ সারওয়ার। যেই ভাবা, সেই কাজ। তিনি চলে গেলেন কক্সবাজার, তারপর সেন্ট মার্টিন। সেখানে স্কুবা ডাইভিংয়ের ওপর তিন দিনের প্রশিক্ষণ নিলেন। তারপর এক বড় ভাইয়ের ক্যামেরা নিয়ে ডুব দিলেন সাগরের অতল জলে। শুধু ফটোগ্রাফার থেকে হয়ে গেলেন আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফার।

সাগরতলের জগৎটাকে স্বর্গের মতো সুন্দর মনে হয় শরীফ সারওয়ারের কাছে

এরই মধ্যে কতবার যে সাগরতলে বিচরণ করেছেন, তা নিজেও জানেন না তিনি। শুধু দেশে নয়, গিয়েছেন থাইল্যান্ড আর আন্দামানেও। উচ্চতর প্রশিক্ষণ, আন্তর্জাতিক লাইসেন্স—সবই পাওয়া হয়ে গেছে। পেয়েছেন অসংখ্য পুরস্কার। বিপদেও পড়েছেন কয়েকবার। একবার তাঁর সামনে হাজির হয়েছিল বিষাক্ত কাঁটাওয়ালা লায়ন ফিশ। এর কাঁটা গায়ে লাগলেই সর্বনাশ! তার পরও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে খুব কাছ থেকে সেই লায়ন ফিশের ছবি তুলেছেন এই দুঃসাহসী ফটোগ্রাফার। এত কিছুর পরও সাগরতলে যাওয়ার নেশা একটুও কমেনি তাঁর। বরং আরও পরিকল্পনা করছেন মালদ্বীপ, অস্ট্রেলিয়ার সাগরে ডুব দেওয়ার। অতল জলে হারিয়ে গিয়ে মাছের ঝাঁকের সঙ্গে সাঁতার কাটা, সাগরতলের আশ্চর্য সুন্দর প্রবাল, পাহাড়, গুহা দেখার নেশা একবার পেয়ে বসলে তা থেকে বেরোনো কঠিন।

এই অক্টোপাসই শুঁড় দিয়ে চেপে ধরেছিল শরীফ সারওয়ারের ক্যামেরা

সাগরতলের জগৎটা কেমন? শরীফ সারওয়ার বলেন, ‘অভাবনীয়! এ অভিজ্ঞতা না দেখে কল্পনা করা অসম্ভব। এটা একেবারেই ভিন্ন একটা জগৎ। আমি স্বর্গ দেখিনি, কিন্তু সাগরতলের জগৎটাকে আমার কাছে স্বর্গের মতো সুন্দর মনে হয়। আবার ভরশূন্যভাবে ভেসে থাকলে মনে হয় মহাশূন্যে ভেসে আছি।’ তবে জলের নিচের এ স্বর্গও নষ্ট করতে চাইছে মানুষ। জলের অনেক গভীরে গিয়েও চিপস, কোল্ড ড্রিংকসের বোতল, পলিথিনসহ অসংখ্য আবর্জনা পড়ে থাকতে দেখেছেন বাংলাদেশের এ আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফার, যা ক্রমাগত হুমকির মুখে ফেলছে জলের তলের প্রবাল আর অন্য বাসিন্দাদের। জাহাজ, নৌকার নোঙরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দ্বীপের প্রবাল আর সাগরতলের পাথরগুলো। কিন্তু এসব বিষয় সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার কথা কেউ ভাবছেই না। তার পরও শরীফ সারওয়ার মনে করেন, ১০০ শতাংশের মধ্যে সেন্ট মার্টিনের ওপরের সৌন্দর্য মাত্র ৫ শতাংশ। বাকি ৯৫ শতাংশ সৌন্দর্যই জলের নিচে, যা দেখতে হলে করতে হবে দুর্ধর্ষ অ্যাডভেঞ্চার!তোমরা নিশ্চয়ই এখনই ক্যামেরা জোগাড় করে সাগরে ডুব দেওয়ার কথা ভাবছ? একটু দাঁড়াও। শুধু ক্যামেরা আর ডুবুরির পোশাক হলেই হবে না, অচেনা সাগরের গভীরে যাওয়ার সাহস আছে তো? শরীফ সারওয়ার মনে করেন, আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে সাহস। সাগরতলের প্রতিটি মুহূর্তে আছে বিপদ, মৃত্যুর ঝুঁকি আর বুক ধড়ফড় করা অ্যাডভেঞ্চার। দুর্বল চিত্তের মানুষের জন্য আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফি নয়। আর সাহসের সঙ্গে দরকার শারীরিক সুস্থতা। স্কুবা ডাইভিংয়ের জন্য একটানা ২০০ মিটার সাঁতরে ১০ মিনিট ভেসে থাকার মতো শক্তি থাকতে হবে। অ্যাজমা ও হাঁপানি রোগ থাকা চলবে না। সাহস ও শারীরিক সুস্থতার সঙ্গে থাকতে হবে একাগ্রতা, ধৈর্য আর অজানাকে জানার তীব্র ইচ্ছা। ‘একাগ্রতা না থাকলে স্কুবা ডাইভিং, আন্ডার ওয়াটার ফটোগ্রাফি করা সম্ভব না।’ একাগ্রতাকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন শরীফ সারওয়ার। স্কুবা ডাইভিংয়ের প্রশিক্ষণটাও খুব জরুরি। এর সঙ্গে থাকতে হবে সাগর আর সাগরতলের মাছ, গাছ ও প্রবালের প্রতি ভালোবাসা। তো কবে ডুব দিচ্ছ সাগরতলে?