Thank you for trying Sticky AMP!!

সুহাসিনী নৃত্যনন্দিনী প্রিয়াঙ্কা

র‌্যাচেল প্রিয়াঙ্কা প্যারিস। ছবি: সাইফুল ইসলাম

পা থেকে ঘুঙুর খসে গেছে, মঞ্চে এমনটা ঘটে। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার ঘুঙুর কখনোই খসেনি। এমনভাবে বাঁধা থাকত যেন শরীরের অংশ। ঘুমুতে যাওয়ার আগে সেটা খোলা হতো। আজ সে ঘুঙুর কেবল রিনিকি-ঝিনিক সুরে বাজে না, কথাও বলে। সুহাসিনী নৃত্যনন্দিনী, গৌড়ীয় নৃত্যশিল্পী র‌্যাচেল প্রিয়াঙ্কা প্যারিসের জীবন জড়িয়ে গেছে দুই গুচ্ছ ঘুঙুরে।

প্রিয়াঙ্কার জন্ম ঢাকায়। চাকরিজীবী মা রোজলিন প্যারিস স্কুলজীবনে বক্তৃতা, নাচ ও গান করতেন। ব্যবসায়ী বাবা জন প্যারিসের ছিল নাটকের দল। চঞ্চল মেয়েকে দিয়ে গান হবে না। তাই তাঁকে দেওয়া হয়েছিল ঢাকার নাচ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টসে (বাফা)। শেখার একপর্যায়ে কিশোরী প্রিয়াঙ্কা যান প্রতিযোগিতায়। লাল শাড়ি আর হাতে তরবারি নিয়ে নাচ করেন ‘জাগো নারী জাগো বহ্নি শিখা’ গানের সঙ্গে। দেশসেরা নৃত্যশিল্পী বিচারকেরা তা দেখে উচ্ছ্বসিত হন। পরে তাঁরাই হন প্রিয়াঙ্কার শিক্ষক। কত্থকে শিবলী মহম্মদ, ওডিশিতে বেনজির সালাম এবং ভরতনাট্যমে গুরু হিসেবে পান বেবী রোজারিওকে।
মায়ের ডানার নিচ থেকে বেরিয়ে তিনি উড়তে শিখেছেন কলকাতায়। উচ্চমাধ্যমিক শেষে সবাই যখন ব্যস্ত ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে, প্রিয়াঙ্কা ছিলেন চুপচাপ। বৃত্তি নিয়ে চলে যান ভারতের কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেই শুরু হয় পরিযায়ী এক তরুণীর নিজস্ব সংগ্রাম। হাওড়ার ওপাড়ে গুরুর বাড়ি। ধাক্কাধাক্কি করে লোকাল ট্রেনে চড়া, সন্ধ্যায় যাদবপুরে মহড়া ধরা। কেমন ছিল মায়ের কোল থেকে বেরিয়ে জীবনের অমসৃণ পথচলা? বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তরের মন্ত্র শিখিয়ে দিয়েছিলেন বাবা-মা। ফলাফল ভরতনাট্যমে স্নাতক, স্নাতকোত্তর ও গৌড়ীয় নৃত্যে এমফিল। এমনকি ভারতের প্রায় সব বড় বড় মঞ্চ শুনেছে তাঁর ঘুঙুরের ধ্বনি।

>র‌্যাচেল প্রিয়াঙ্কা প্যারিস 
 ২০০৩: জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে সাধারণ নৃত্যে প্রথম
 ২০০৬: শান্তিতে নোবেল উদ্যাপন অনুষ্ঠানে নরওয়ে, ইংল্যান্ড, ফ্রান্সে
 ২০০৭: আইসিসিআরের বৃত্তি লাভ
 ২০১১: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ইনস্টিটিউটের শাস্ত্রীয় নৃত্য প্রতিযোগিতায় প্রথম
 ২০১১: পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংগীত একাডেমি আয়োজিত প্রতিযোগিতায় প্রথম
 ২০১১ ও ২০১৫: কলকাতার উদয় শঙ্কর নৃত্য উৎসবে পরিবেশনা
 ২০১২: ভারতে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ আমেরিকান বেঙ্গলি কনফারেন্স আয়োজিত শাস্ত্রীয় নৃত্যে সোনার মেডেল
 ২০১৪: দিল্লিতে ইন্দ্রধনু নৃত্য উৎসবে পরিবেশনা
 ২০১৫ সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে রাশিয়ায় পরিবেশনা
 ২০১৬: কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমফিল ডিগ্রি লাভ
 ২০১৬: সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে ফ্রান্সের প্যারিসে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের পরিবেশনা
 ২০১৭: সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের আমন্ত্রণে জাপানের নবান্ন উৎসবে পরিবেশনা

রবীন্দ্রভারতীতে গুরু হিসেবে তিনি পান অধ্যাপক মহুয়া মুখোপাধ্যায়কে। গুরুর আস্থার পাত্র হয়ে উঠতে বেশি দিন লাগেনি তাঁর। শ্রেণিকক্ষ থেকে তিনি গিয়ে ওঠেন গুরুগৃহে। সকাল থেকে রাত্রি মহুয়ার বাড়িতে চলতে থাকে অনুশীলন। এরই মধ্যে শেষ হয় অঞ্জনা গুহঠাকুরতা ব্যানার্জি ও খগেন্দ্রনাথ বর্মনের কাছ থেকে ভরতনাট্যমের পাঠ নেওয়া। ঢাকার বাফায় যাঁর শুরু, তিনি পরিণত হন ঠাকুরবাড়ির ঐতিহ্যবাহী ক্যাম্পাসে। স্বপ্ন দেখেন, শিক্ষিত নৃত্যশিল্পী গড়ে তোলায় অবদান রাখবেন। পরে শিক্ষক হিসেবে তিনি যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃত্য বিভাগে।
প্রিয়াঙ্কার ঝুলিতে রয়েছে দেশ-বিদেশে বহু অনুষ্ঠানে গৌড়ীয় নৃত্য পরিবেশনের গৌরব। নিজের গুরুদের সঙ্গে একমঞ্চে নাচ করেছেন। এমনও সময় গেছে, বছরে শতাধিক অনুষ্ঠান করতে হয়েছে। ভারতের কেরালায় গিয়ে তো রীতিমতো সিনেমার প্রস্তাব পেয়েছিলেন। ঢাকার মেয়ে মালায়ালম ছবির নায়িকা হলে কেমন হতো? দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রিয়াঙ্কা জবাব দিয়েছিলেন, ‘নাচটা শেখা হতো না।’
কলকাতায় জীবনের সবচেয়ে আনন্দের সময় কেটেছে তাঁর। দোল উৎসবটা ছিল তাঁর ভীষণ প্রিয়। রবীন্দ্রভারতীতে রং খেলা, ঢাকের বাদ্যে হইচই আর রসগোল্লা খাওয়া ছিল অনেক আনন্দের। সে রকম একটা সময়ে একবার এক ঝুপড়ি ঘর থেকে রবীন্দ্রসংগীতের সুর ভেসে আসছে শুনে আনন্দে চোখে পানি এসে গিয়েছিল তাঁর।
পরিচিতি ও প্রীতি বেড়েছে প্রিয়াঙ্কার। আমন্ত্রণ আসে চারপাশ থেকে। আত্মতৃপ্তির জন্য নাচ করেন বলে সাড়াও দেন। বলছিলেন, ‘পাগলের মতো নেচে বেড়িয়েছি একসময়। সেই গতিটা ধরে রাখতে চাই। নয়তো দেড় ঘণ্টা সাজগোজ, তিন ঘণ্টা যাতায়াতের ফাঁকে ১০ মিনিটের জন্য নাচ করতে যেতাম না।’
প্রিয়াঙ্কার মাথায় এখন ঘুরপাক খাচ্ছে একগুচ্ছ নৃত্যনাট্য। নৃত্যবিষয়ক কোনো সিনেমা হলে অভিনয়ের শখ আছে তাঁর।

রাসেল মাহ্‌মুদ প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক