Thank you for trying Sticky AMP!!

১৯৭১

কোলাজ: অশোক কর্মকার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কালে একদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পরিকল্পিত গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠনের এবং অন্যদিকে স্বাধীনতালাভের মরণপ্রয়াসের যে-বিপুল কর্মযজ্ঞ চলেছিল, তার কথা মনে হলে বিস্ময় জাগে। মুক্তিযুদ্ধে শহিদ এবং হৃতসম্ভ্রম মানুষের সংখ্যা নিয়ে আজ যাঁরা তর্কের ঝড় তুলেছেন, তাঁরা ভুলে যান যে, এসব সংখ্যার ভিত্তি রচিত হয়েছিল বিদেশি সাংবাদিক ও প্রতিষ্ঠানের নানা প্রতিবেদনে। তারই ভিত্তিতে অনেক পরে বঙ্গবন্ধু এবং বাংলাদেশ সরকার একটি পরিসংখ্যান উপস্থিত করে। দুই বিশ্বযুদ্ধে নিহত মানুষের যে-সংখ্যা ইতিহাসে স্বীকৃত, তাও মাথা গুনে নির্ণীত হয়নি, পরিসংখ্যানের একটি বৈজ্ঞানিক প্রণালি অনুসরণ করেই তা নিরূপিত হয়েছিল। পঞ্চাশের মন্বন্তরে কিংবা ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ে মৃত বা নিহত মানুষের সংখ্যাও স্বীকৃত হয়েছিল অনুরূপ ভিত্তিতে।
এই মারণযজ্ঞের বিপরীতে ছিল প্রতিরোধ-সংগ্রাম এবং স্বাধীনতালাভের জন্যে সুপরিকল্পিত প্রয়াস। এক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ছিল বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠা। তাজউদ্দীন আহমদের প্রজ্ঞা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন সম্ভবপর হয়েছিল ভারত সরকারের সার্বিক সহায়তায়। ১০ এপ্রিলে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এবং ১৭ এপ্রিলে বাংলাদেশের মাটিতে বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথগ্রহণ-অনুষ্ঠান আমাদের মুক্তিসংগ্রামের আইনি ভিত্তিকে দৃঢ়তা দিয়েছিল। এরপরই সম্ভবপর হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকে সংঘটিত ও ধারাবাহিকভাবে পরিচালিত বিচ্ছিন্ন প্রতিরোধ-প্রয়াসকে সংগঠিত ও শৃঙ্খলাপূর্ণ একটি মুক্তিযুদ্ধের রূপ দেওয়া। সম্পূর্ণ যুদ্ধক্ষেত্রকে ১০টি-পরে ১১টি-সেক্টরে বিভক্ত করা, সেক্টর কম্যান্ডার ও সাব-সেক্টর কম্যান্ডার নিয়োগ, প্রধান সেনাপতির নিযুক্তি এবং আরও পরে মেজর কে এম সফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে এস ফোর্স, জেড ফোর্স ও কে ফোর্স গঠন ছিল এই পরিকল্পিত প্রয়াসের অংশ। প্রধান সেনাপতির কর্তৃত্ব নিয়ে সেক্টর কম্যান্ডারের কারো কারো অসন্তোষ ছিল এবং কেউ কেউ এই পদের বিলোপসাধনের প্রস্তাবও করেছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত সরকারের অভিপ্রায়-অনুযায়ীই সেনাবাহিনী কাজ করে এবং নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীরও অঙ্কুর রোপিত হয়।
অবশ্য বাংলাদেশ সরকারও বিনা বাধায় কাজ করতে পারেনি। জনপ্রতিনিধিরাই কেউ কেউ তাজউদ্দীনের নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ করেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রতি বিরূপ মনোভাবাপন্ন এবং তার কর্তৃত্বের বাইরে মুজিব বাহিনী নামে একটি সশস্ত্র বাহিনী ভারত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠে। ভারত কেন এই উদ্যোগ নিয়েছিল, সে-সম্পর্কে নানা ব্যাখ্যা আছে, তবে ভারতের অভিপ্রায় সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যায় না। আবার, বাংলাদেশ সরকারের মধ্যে বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূতের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনলাভে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর গোপন আলোচনার বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে প্রকৃতপক্ষে দায়িত্বমুক্ত করা যায়, জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল থেকে তাঁকে বাদ দেওয়া হয় এবং নতুন পররাষ্ট্র-সচিব নিযুক্ত হন। এমনকি, ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পর্কে কলকাতার বাংলাদেশ মিশন-প্রধানের বক্তব্য বাংলাদেশ সরকার তাঁর নিজস্ব পর্যবেক্ষণ বলে অভিহিত করে প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর দিল্লি, কলকাতা, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক, ওয়াশিংটন, স্টকহোম, প্যারিস, হংকং ও টোকিওতে পাকিস্তান দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিকেরা পাকিস্তানপক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। কূটনৈতিক ক্ষেত্রে এ ছিল বাংলাদেশের বিরাট সাফল্যের পরিচায়ক। কলকাতা, লন্ডন, নিউ ইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ মিশন প্রকাশ্যে কাজ করার সুযোগ করে নেয়। লন্ডন মিশনের প্রধান বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি এবং পরে জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি নিযুক্ত হন। অন্যান্য দেশের রাজধানীতেও বাংলাদেশের প্রতি অনুগত কূটনীতিকেরা জনমতগঠনে এবং প্রবাসী বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করে তোলার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, যদিও অনেক সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলমতের প্রভাবে তাঁদের নানা অংশ পরিচালিত হন। সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে আট সদস্যের একটি পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়। এতে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ ভাসানী, ন্যাপ মোজাফফর, কমিউনিস্ট পার্টি ও জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা অন্তর্ভুক্ত হন এবং মওলানা ভাসানী এর সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এরপরে সর্বত্রই বাঙালিদের কর্মধারায় আরো সংহতি ও সমন্বয় দেখা দেয়।
প্রথমদিকে আওয়ামী লীগ ‘একলা চলো’ নীতি অবলম্বন করেছিল। তাই গোড়ায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের বাইরে কাউকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্রহণ করা হচ্ছিল না। ক্রমে গ্রামাঞ্চল থেকে বহু মানুষ, বিশেষত কৃষক পরিবারের অরাজনৈতিক সন্তানেরা, মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে এগিয়ে এলে তাদের প্রত্যাখ্যান করা সম্ভবপর হয়নি। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের সদস্যদের নিয়ে একটি মুক্তিবাহিনীও গড়ে উঠেছিল। আওয়ামী লীগের বাইরের সদস্যদের মুক্তিযুদ্ধে সংশ্লিষ্ট করার ক্ষেত্রে মেজর খালেদ মোশাররফ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
বস্তুতপক্ষে সবধরনের মানুষের অংশগ্রহণের ফলেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পরিণত হয়েছিল জনযুদ্ধে। বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন গড়ে উঠেছিল মূলত পাকিস্তানের পক্ষত্যাগী সরকারি আমলাদের নিয়ে। তবে বেসরকারি ব্যক্তিদেরও সেখানে স্থান ছিল-বিশেষত আঞ্চলিক প্রশাসনকর্মে।
সরকারের পরিকল্পনা কমিশনে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়-শিক্ষকদের প্রাধান্য। বেসরকারি শরণার্থীরা সরকারি কাঠামোর বাইরে নানাধরনের প্রয়াসে যুক্ত হয়েছিলেন। বাংলাদেশ লিবারেশন কাউনসিল অফ দি ইনটেলিজেনশিয়া, মুক্তিসংগ্রামী শিল্পী সংস্থা, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক সংগ্রাম শিবির, বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার কোর, বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি—এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সম্পূর্ণ বেসরকারি উদ্যোগে। কখনো কখনো তাতে সরকারের হস্তক্ষেপ বা প্রভাববিস্তারের চেষ্টা খানিকটা-সংকট না হলেও-সমস্যার সৃষ্টি করেছিল, তবে এসব সংগঠনের কাজকর্ম ব্যাহত করেনি। এরা শরণার্থী শিবিরে দুঃস্থ মানুষকে উদ্দীপনা দিতে, বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারাভিযান চালাতে, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ভারতে জনমতগঠনে, সীমিতসংখ্যক শরণার্থী শিবিরে শিশু-কিশোরদের জন্যে স্কুল চালাতে সাহায্য করে। আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্যে যেসব ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়, তাতেও বেসরকারি ব্যক্তিদের একটা বড়ো ভূমিকা ছিল। চিত্রশিল্পীরা একটি মনোজ্ঞ চিত্রপ্রদর্শনী করেছিলেন। বাংলাদেশের ফুটবল খেলোয়াড়েরা একটি দল গঠন করে ভারতীয়দের সঙ্গে প্রদর্শনী খেলা খেলেও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রচারে সাহায্য করেছিলেন। সেই সঙ্গে কিছু সমস্যা যে তৈরি হচ্ছিল না, তাও নয়। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহচর বা সরকারের নিকট সূত্র বলে পরিচয় দিয়ে অনেকে এমন সব মন্তব্য করছিলেন বা বক্তৃতা-বিবৃতি দিচ্ছিলেন যা সরকারি নীতির পরিপন্থী ছিল। সরকার বাধ্য হয়ে প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এসব বক্তব্যের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন।
ভারতীয় বেসরকারি উদ্যোগও আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়ক হয়েছিল। জয়প্রকাশ নারায়ণের নেতৃত্বে আগস্ট মাসে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের সাফল্যের কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এতে বাংলাদেশেরও একটি বড়ো প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল—তাতে সরকারি ও বেসরকারি ব্যক্তিরা ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশ সহায়ক পরিষদের কাজও খুব ফলপ্রসূ হয়েছিল। কিছু আন্তর্জাতিক সংগঠনও ভারতে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে সক্রিয়তার পরিচয় দিয়েছিল। তাদের মধ্যে ওয়ার অব ওয়ান্ট, কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম এবং ব্রিস্টলভিত্তিক ফ্রেন্ডস অফ বাংলাদেশের কথা মনে পড়ে।
কলকাতার বাংলাদেশ মিশন থেকে বাংলাদেশ নামে একটি নিউজলেটার মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারকার্যে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল। জয় বাংলা নামে একটি পত্রিকাও সরকারি উদ্যোগে প্রকাশিত হতো। বেসরকারি পত্রিকাও ছিল। তবে এক্ষেত্রে অতুলনীয় ছিল স্বাধীন বাংলা বেতারের ভূমিকা। স্বল্পসংখ্যক আত্মনিবেদিত বেতারকর্মীর একাগ্র প্রচেষ্টায় এর সূচনা হয় চট্টগ্রামে। পরে আগরতলা থেকে এটির প্রচারকার্য চলে, তবে ট্রান্সমিটারের সীমাবদ্ধ শক্তির কারণে তা বেশিদূর ছড়াতে পারেনি। মে মাসের শেষদিক থেকে ডিসেম্বরের শেষ পর্যন্ত এই বেতার যেমন শক্তিশালী তেমনি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। অবরুদ্ধ বাংলাদেশের মানুষকে প্রণোদনা দিতেও এর জুড়ি ছিল না।
মুক্তিযুদ্ধের মূল প্রেরণা অবশ্য এসেছিল দেশবাসীর অভূতপূর্ব ঐক্য আর দৃঢ় সংকল্প থেকে। হানাদারকবলিত বাংলাদেশেও কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী পাকিস্তানিদের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের সর্ববিধ সাহায্য করেছে দেশের সাধারণ মানুষ—তারাও জীবনের ঝুঁকি নিয়েছে, জীবন দিয়েছে এ-কারণে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত জনযুদ্ধ হতে পেরেছিল বলেই বিজয় ত্বরান্বিত হয়েছিল।