Thank you for trying Sticky AMP!!

'ঈদ এল বকরীদ'

অলংকরণ: সব্যসাচী মিস্ত্রী

মানুষ এখন করোনায় কাহিল। ভয়কে জয় করার মনোহর বাণী মানুষের মন ভরাতে পারছে না। সন্ত্রাসী মহামারি করোনা ক্রমেই গেড়ে বসছে মানুষের দেহে। মনও এখন করোনার ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত। এর শেষ কোথায়, তা এখনো অজানা।

মহামারির দুঃসহ দুর্ভোগের কাল পৃথিবীতে আগেও এসেছে। মানুষকে পার করতে হয়েছে দুর্বহ দিন। প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তর যুদ্ধ করে বেঁচে থাকাটাই নাকি মানুষের অমোঘ নিয়তি। এই যুদ্ধে মানুষ সাহস হারায় না। হেরেও যায় না।

দার্শনিক এই সব তত্ত্বকথা অবশ্য আমার নয়, পণ্ডিতদের। আমি পল্লবগ্রাহী মানুষ। ভারী কোনো কথা আমার মাথায় আসে না। ঢোকেও না। সুযোগ বুঝে আমি তাঁদের কথাগুলো জায়গামতো তুলে ধরি মাত্র।

যাহোক, কদিন আগেই সর্বনেশে করোনার মধ্যে পার হলো অসহায় নিরানন্দ এক ঈদ। সামনে আবারও এক ঈদ। এই ঈদেও সম্ভবত সহায়-সম্বল খোয়াবে অনেকে। সামাজিক অর্থনীতি নিয়ে আমার জ্ঞান ভাসা–ভাসা। আমি বরং ঈদ নিয়ে অন্য কথায় আসি।

সামনের যে ঈদ, সাধারণ বাঙালির মুখে তা ছিল বকরিদ। এখন হয়ে গেছে কোরবানির ঈদ। তবে আমরা গ্রামের মানুষেরাই যে কেবল বকরিদ বলতাম, তা নয়, বকরিদ বিখ্যাত লোকেরাও বলতেন। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতায় আছে—‘ঈদ এল বকরীদ’। আরও আছে—‘বকরীদি চাঁদ করে ফরয়্যাদ দাও দাও কোরবানী’।

এই ঈদের নাম নিয়ে আরও কথা আছে। সেই ১৯৫০-৫৫ সালের দিকে গ্রামের শিক্ষকদের মুখে শুনতাম—ঈদুজ্জোহার ছুটি। ঈদুজ্জোহা ধীরে ধীরে উধাও হয়ে এখন এসেছে ঈদুল আজহা। তবে নামে কীই-বা এসে যায়। ঈদ সেই ঈদই রয়ে গেছে—কোরবানি দেওয়ার ঈদ।

ঈদের কথা এলেই ছোটবেলায় ফিরে যাই। আমি গ্রামের ছেলে। গ্রাম অবশ্য ছেড়েছি ১৯৬১-তে। বয়স তখন ষোলো। যত দূর মনে পড়ে, আমাদের গ্রাম কিংবা আশপাশের গ্রামগুলোতে কোরবানি তেমনটা হতো না। এখন যেমন প্রতি বাড়িতে কোরবানি। কোনো বাড়িতে আবার খাসি-গরু দুটোই। তখন অবস্থা এমন ছিল না।

থানা সদর মিরপুরে আমাদের এলাকার একমাত্র গোহাটা, অর্থাৎ গরুর হাট। এই মিরপুর ঢাকার নয়, কুষ্টিয়া জেলার। এ হাটে মানুষ কোরবানির গরু কিংবা খাসি কিনতে যেত না। হাটে যেতেন কসাই ও কৃষকেরা। কৃষকদের যেতে হতো তাঁর হালের বলদের জোড়া কিনতে। কসাইদের কীর্তিকলাপ তো সবারই জানা। শেষবারের মতো বাচ্চা দেওয়া ধাড়ি ছাগল, বৃদ্ধা গাভি, বৃদ্ধ বলদ, মহিষ ইত্যাদি তাঁদের ছুরিতে চর্মহীন হওয়ার পর আত্মপরিচয় বিসর্জন নিয়ে প্রতিটি ছাগল হয়ে যেত খাসি আর গরু-মহিষগুলো হয়ে যেত ষাঁড়। এগুলো গল্প নয়, সত্যি।

ছাগি দুটো থেকে চারটে পর্যন্ত বাচ্চা প্রসব করত। আমাদের প্রবাদে ছাগলের তৃতীয় বাচ্চার অবস্থার কথা আছে। চতুর্থটার নেই। আসলে চারটে বাচ্চার ঘটনা ছিল অতিশয় বিরল। তাই সেটা প্রবাদে ঠাঁই পায়নি। বাচ্চা দিতে দিতে একপর্যায়ে বাঙালির মুখে ছাগির নাম হয়ে যায় বকরি। বকরিদে কখনো বকরি কোরবানি হয় না। কোরবানি হয় খাসি। খাসি আরবি শব্দ। যে সময়ের কথা বলছি, চাষি গৃহস্থের কাছে গরু তখনো গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সব কাজের নিত্যসঙ্গী। এখনকার খামারির মাংস সম্পদ নয়। গরু ছাড়া চাষি তখন অচল। জমিতে লাঙল দিতে, মই দিতে, পাকা ফসল মাড়াই করতে, গাড়ি টানতে সর্বত্রই গরু এবং জোড়া গরু। একটা গরু কেবল কলুর ঘানিতে—যেটা নিয়ে বিখ্যাত বাগ্​ধারা—কলুর বলদ।

এতক্ষণ গরু বললাম বটে, তবে সেগুলো সবই বলদ। জাতে কেবল গরু। গোবৎসের বাংলা নাম বাছুর। পুং বাছুর হলো এঁড়ে বা দামড়া। আর স্ত্রী বাছুর হলো বকনা। কালক্রমে বকনা পরিণত হয় গাভিতে। আর এঁড়ে বা দামড়া হয়ে যায় ষাঁড়।

গরু ও ছাগলের বয়ঃক্রমের বিভিন্ন নাম—যেমন দামড়া, বলদ, পাঁঠা—মানুষের প্রকৃতি অনুযায়ী বিশেষণে পরিণত হতো।

তখনকার কৃষকেরা অনেক বিষয়েই অভিজ্ঞ ছিলেন। ষাঁড়ের আচরণ দেখেই তাঁরা অনুমান করতে পারতেন কোনটা খর্বকায় হবে আর কোনটা তাগড়া হবে। গরুর অবস্থা সব অবস্থাতেই মন্দ। তাগড়া হওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে গুঁতিয়ে বেড়ানো ষাঁড়কে মুষ্কবিহীন করে বলদে পরিণত করা হতো। বলদ তখন হতো কৃষকদের কাজের সঙ্গী। এই বলদের জোড়া কিনতে এবং বৃদ্ধ বলদ ও জন্মদানে ক্লান্ত গাভি বিক্রির জন্য চাষি গরুর হাটে যেতেন। খর্বকায় ষাঁড় চাষির বাড়িতে বাড়তে থাকত অন্যের বাড়িতে কোরবানি হওয়ার প্রতীক্ষায়।

ওই সাইজের ষাঁড় এখন আর েচাখে পড়ে না। তবে টেলিভিশনের পর্দায় দেখি িবশাল আকৃতির সব ষাঁড়। দেখলেই পিলে চমকে যায়। অকৃত্রিম গ্রামের ভাষায় মুখ থেকে বেরিয়ে আসে, ওরে ব্বাপ। কিন্তু ঢাকায় বড় হওয়া আমার নয় বছরের নাতনি মনীষা অদ্ভুত ধ্বনি ও লয়ে ওই ষাঁড় দেখে বলল, ওয়াও! মনে হলো, আমার নাতনির এই িবজাতীয় অভিব্যক্তিই এই ষাঁড়ের জন্য উপযুক্ত।

কোরবানির খাসি নধরদেহী হতো কোরবানিদাতার বাড়িতে, বাড়ির ছেলেমেয়েদের তত্ত্বাবধানে ও আদরে। ছাগলছানা খাসিতে পরিণত হওয়ার পরপরই সেগুলো কেনাবেচা হতো। খাসির খাদ্য জোটানো সবার পক্ষে সহজ হতো না। তাই দ্রুত বিদায় করা হতো বাড়ি থেকে।

কোরবানির ঈদের নামাজ যে আটটা–সাড়ে আটটার মধ্যে শেষ হয়ে যায়, সেটা প্রথম দেখি শহরে বাস করতে এসে। এর পেছনে অবশ্য যুক্তি রয়েছে। ব্যাপারটা সবাই বোঝেন, তাই বেশি কথায় যাচ্ছি না। ফিরছি গ্রামের কথায়। মা–বাবা বাড়িতে। ঈদে আসতেই হতো। বেশ ছোটবেলা থেকেই শুনতাম গ্রামের মানুষের মুখে চারটি ইংরেজি শব্দ—টাইম, বেটাইম, ফাস্টে আর লাস্টে। শব্দগুলো আমাদের মুখেও চলত। তো, আমাদের ঈদগাহে সব সময়ই দেখেছি নামাজ শুরু হতে হতে বেলা ১১টা। শেষবার, গ্রামের মেজর সাহেব অভয় দিলেন, এবার নামাজ টাইমমতো শুরু হবে। তবু বেটাইম হয়ে গেল। নামাজ শুরু হলো সকাল সাড়ে ১০টায়।

কোরবানি করা নিয়ে ঝামেলা হতো না। কোনটা ‘লাস্টে’ আর কোনটা ‘ফাস্টে’ হবে তা নিয়ে কোনো আহ্লাদ বা বিবাদও দেখা যেত না। গ্রামে থাকা, ছুটিতে বাড়ি আসা ভাইদের কল্যাণে কাজ শেষ হয়ে যেত বিকেল চার-সাড়ে চারের মধ্যেই। মসলা তো আগেই বাটা থাকত। ব্যস্ততা শুরু হতো মায়ের।

আমাদের গ্রামে ধানকল বসে ১৯৫৭ কি ৫৮–তে। তার আগে ছিল ঢেঁকিছাঁটা লাল চাল। বাড়িতেই ঢেঁকি। যাহোক, সেই ঢেঁকির কালে ঈদের দিন আমাদের লোভনীয় খাদ্য ছিল—সেই লাল চাল আর মাষকলাইয়ের ডালের খিচুড়ি। সকালে চলত চালের বা আটার রুটি। ডাল ভাঙার চাকি এবং আটা পেষার জাঁতা—সবই ছিল বাড়িতে।

ঈদের দিন সন্ধে পর্যন্ত বাড়িতে মাংস জমা হতো প্রচুর। মায়ের কাজ যেত বেড়ে। তখন তো ‘টাটকা খাদ্য বাসি করিয়া খাইবার যন্ত্র’, অর্থাৎ রেফ্রিজারেটর গ্রামের লোক চোখেই দেখেনি। গরমের দিনে মাংস ম্যানেজ করে রাখা বেশ মুশকিল। মা কীভাবে ম্যানেজ করতেন, জানি না। রাতে শোবার ঘরে দেখতাম, দেয়ালে আটকানো মইয়ের ওপর সারি দেওয়া সাত কি আটটা হাঁড়ি। মসলার গন্ধ নাকে আসছে। কিন্তু পুরো রান্নার গন্ধ নয়। আসলে মা প্রতিটি হাঁড়িতেই অল্পবিস্তর মসলা মেখে মাপমতো সেদ্ধ করে রেখেছেন। প্রতিটি হাঁড়িই প্রতিদিন কিছুক্ষণ ধরে সেদ্ধ করা হতো। এভাবেই দিন দশেক ধরে একটা একটা করে হাঁড়ি কমে যেতে থাকত। তারপর শেষ হয়ে যেত কোরবানির পালা।

রান্না হতো খড়ির চুলায়। অনেকক্ষণ ধরে রান্না। মায়ের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দেখতাম, মা আঁচলের কোনা দিয়ে ঘাম মুছছেন। ছোটবেলাতে মা আমার কপালের ঘাম এভাবেই মুছে দিতেন। কী যে শান্তি পেতাম! সেই কথা মনে করে এখনো এই বয়সে কপালে হাত দিই। কিন্তু শান্তির বদলে অশান্তি বাড়ে।