Thank you for trying Sticky AMP!!

দৃশ্যকলা চর্চার অগ্রপথিক

জয়নুল আবেদিন (২৯ ডিসেম্বর ১৯১৪—২৮ মে ১৯৭৬) প্রতিকৃতি এঁকেছেন মাসুক হেলাল

পূর্ববাংলা, বর্তমান বাংলাদেশের অনগ্রসর মুসলিম জনগোষ্ঠীর আত্ম-আবিষ্কার ও সমকাল-চেতনার উদ্বোধনে যে কয়েকজন মানুষের অবদান অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে, জয়নুল আবেদিন তাঁদের অন্যতম। বাংলাদেশে জয়নুল আবেদিনকে আমরা শিল্পাচার্য আখ্যা দিয়েছি আর দৃশ্যকলা চর্চার অগ্রপথিক রূপে স্বীকার করে নিয়েছি। তিনি শুধু যে চিত্রকলা শেখার জন্য পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়তে যাওয়া প্রথম মুসলিম শিক্ষার্থী তা-ই নয়, বাংলাদেশে শিল্পকলা শিক্ষা ও চর্চার তিনি একাধারে অগ্রপথিক এবং আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম শিল্পী। তাঁর শিল্পকর্মের মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো একটি জাতির জীবন-সংগ্রাম, সুখ-দুঃখ ও আশা-আকাঙ্ক্ষা বলিষ্ঠ তুলিতে সপ্রাণ সহমর্মিতায় ধরা দিয়েছে।
চিত্রশিল্পী জয়নুল আবেদিনকে প্রায় সারা জীবন লড়তে হয়েছে নানামুখী বিরূপতার বিরুদ্ধে। তৎকালীন পূর্ববঙ্গ থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে পড়তে যাওয়া প্রথম বাঙালি মুসলিম ছাত্র হিসেবে তাঁকে শুরুতেই লড়তে হয়েছে অনিচ্ছুক ও প্রতিকূল এক সমাজের বিরুদ্ধে। ঔপনিবেশিক পূর্ববাংলায় তৎকালীন অবিভক্ত বঙ্গের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বাস থাকলেও এর জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল মুসলিম ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কূপমণ্ডূকতার জোয়ালে বাঁধা তাদের মানসিকতায় পশ্চিমা শিক্ষা বা সাহিত্য-সংগীত-চিত্রকলা চর্চা ছিল ধর্মীয় অনুশাসনবিরোধী কাজ। বিগত শতকের ত্রিশের দশকের উত্তপ্ত পরিমণ্ডলের ভেতর পূর্ববাংলার প্রায়-গণ্ডগ্রামের এক মুসলিম পরিবার থেকে কলকাতার আর্ট স্কুলে ছবি আঁকা শিখতে এসেছিলেন জয়নুল আবেদিন। এটি সমাজগোষ্ঠীর প্রথাগত ভাবনা বলয়ের বিরুদ্ধে তাঁর প্রথম লড়াই। দেশভাগের আগে সমগ্র ভারতবর্ষে পরিচিতিপ্রাপ্ত একমাত্র বাঙালি মুসলিম শিল্পী ছিলেন পূর্ববঙ্গের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী থেকে আগত জয়নুল আবেদিন। শিকড়ের এই প্রান্তিক পটভূমি তাঁর শিল্প-বৈশিষ্ট্য রূপায়ণে বিশেষ ছাপ রেখেছিল।
ছাত্র হিসেবে তিনি ছিলেন অসাধারণ মেধাসম্পন্ন। শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছেন প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করে। শিক্ষানবিশি পর্ব অতিক্রান্ত হওয়ার পর সৃজনশীল শিল্পী হিসেবে আত্মপ্রকাশের পথ অনুসন্ধান জয়নুল আবেদিনের জন্য কঠিনই ছিল। পূর্ববঙ্গের পশ্চাৎপদ গ্রাম-সংস্কৃতির স্থবির জগৎ থেকে তিনি ছিটকে পড়েছিলেন ভারতীয় রাজনীতি-সংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র কলকাতার উত্তাল পরিমণ্ডলে। ভারতীয় রাজনীতি তখন অদূরবর্তী স্বাধীনতার আবেগ ও উত্তেজনায় টলমল, ভারতীয় মুসলিম তার পৃথক জাতিসত্তার ফেনিল মৌতাতে মশগুল আর সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ক্রমেই আচ্ছন্ন করছিল উপমহাদেশকে। এর বিপরীতে তাঁর অভিজ্ঞতায় ছিল পল্লিবাংলার সরল কর্মমুখর জীবনদৃশ্য আর কলকাতা আর্ট স্কুলের সাদৃশ্যবাদী অঙ্কনের শিক্ষা। পাঠ সমাপ্ত করার পর জয়নুলের সামনে সমসাময়িক রীতি হিসেবে ছিল প্রধানত ‘বেঙ্গল স্কুল’-প্রভাবিত কাব্যিক ভাবালুতা অথবা রোমান্টিকতায় মোড়ানো বাস্তবানুগ চিত্রাঙ্কন, অথবা স্বাদেশিক চেতনার পরিপূরক হিন্দু ধর্মীয় বা পৌরাণিক উপাখ্যান কিংবা ইতিহাস বা সাহিত্যের কোনো মহীয়ান ও আবেগঘন বিষয়। কলকাতা আর্ট স্কুলের, যেখানে জয়নুলের শিল্পশিক্ষা, শিক্ষার্থীরা প্রধানত আসত শহুরে হিন্দু পরিবার থেকে। তারা বিষয় হিসেবে মূলত চয়ন করত ধর্মীয় বা পৌরাণিক ঘটনা, অথবা ভূদৃশ্য হলে কলকাতার নগরচিত্র, নয়তো রোমান্টিক সৌন্দর্যমণ্ডিত প্রকৃতি। জয়নুল আবেদিন এর কোনোটিকেই গ্রহণ করলেন না।
১৯৪৩ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন সমগ্র বাংলাজুড়ে এক মহা মন্বন্তর বিপুল জনগোষ্ঠীর জীবনকে বিপর্যস্ত করে দেয়। অনাহারে আর অপুষ্টিতে মারা যায় লাখ লাখ মানুষ। মহাযুদ্ধ ও মানবসৃষ্ট এ মন্বন্তর শিক্ষিত বাঙালির স্বপ্নাবিষ্ট আর ভাবাবেগতাড়িত রোমান্টিক মানসভূমিকে অকস্মাৎ যেন নাড়িয়ে দিয়ে যায় রূঢ় বাস্তবের তীব্র কশাঘাতে। সাহিত্য-শিল্পকলা-সংগীত-নাটকে এর অভিঘাত এসে পড়ে, প্রতিবাদী প্রতিফলন ঘটে শিল্পের প্রায় প্রতিটি শাখায়।
১৯৪৩ সালেই দুর্ভিক্ষের রেখাচিত্রমালার মাধ্যমে সর্বভারতীয় শিল্পজগতে স্বকীয় বিশিষ্টতায় জয়নুল আবেদিনের আত্মপ্রকাশ। দুর্ভিক্ষের বিপর্যয়কে তিনি দেখেছেন কলকাতার ফুটপাতে মানবতার চরম লাঞ্ছনার চিত্র রূপে। তাঁর চেনা পূর্ব বাংলার গ্রামের কিষানকে, লাজনম্র পল্লিবধূকে কলকাতার রাস্তায় উদ্বাস্তু-বে-আব্রু হয়ে কুকুর-বিড়ালের মতো মরতে দেখে নির্মম ও উদাসীন নাগরিক সভ্যতার প্রতি তীব্র ধিক্কারে আন্দোলিত হয়েছিলেন জয়নুল। তাঁর চিত্রমালা সে অনুভবের ফুঁসে ওঠা উদ্গিরণ আর কেন্দ্রশক্তির বিপরীতে প্রান্তস্থিত মানুষের পক্ষে তাঁর অবস্থানের একটি শক্তিমান সূচকও। তাঁর রেখাচিত্রে ক্ষুধাদীর্ণ উদ্বাস্তু মানুষগুলোর শরীরের ভগ্ন-বিদীর্ণ প্রায়-জান্তব অবয়বে আর জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের অপ্রাকৃত অভিব্যক্তিতে লাঞ্ছিত মানবতার রূপ যে তীব্রতায় প্রকাশিত হয়েছে, তাতে এগুলো নিছক রেখাচিত্র বা তাৎক্ষণিকতার সীমা অতিক্রম করে চিরায়তের ব্যঞ্জনা অর্জন করেছে। চিত্রকলায় সে সময় প্রচলিত রোমান্টিকতার আবেশ ছিন্ন করে নিম্নবর্গীয় শ্রমশীল মানুষের রূঢ় জীবন-সংগ্রামের রূপায়ণ ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের দৃশ্যকলা জগতে জয়নুল আবেদিনকে প্রতিষ্ঠিত করেছে সমসাময়িক অন্যদের চেয়ে পৃথক উচ্চতায়।

>বাংলাদেশে শিল্পকলা শিক্ষা ও চর্চার তিনি একাধারে অগ্রপথিক এবং আজ পর্যন্ত শ্রেষ্ঠতম শিল্পী

১৯৫০-এর দশকজুড়ে পূর্ব পাকিস্তান ছিল মধ্যবিত্ত বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনা এবং অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল রাজনীতি ও সংস্কৃতির উন্মেষের কাল, যা আজ প্রতীকায়িত একুশে ফেব্রুয়ারির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে। এই বিকাশমান পটভূমির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং পঞ্চাশের গোড়াতেই বিদেশে প্রশিক্ষণ ও ভ্রমণের সুযোগ জয়নুলের মানস গঠন ও সৃষ্টিশীলতা বিকাশে বিশেষ সহায়ক হয়েছিল।
আমরা লক্ষ করি, ১৯৫০-এর দশক তাঁর সৃজনশীলতার অন্যতম ফলপ্রসূ কাল। দেখা যায়, ১৯৫১-৫২ সালে প্রথমবারের মতো ইউরোপ ভ্রমণ ও লন্ডনের স্লেড স্কুল অব আর্টসে কাজ করার সুযোগ তাঁর দৃষ্টিভঙ্গিতে যে পরিবর্তন সূচিত করল, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। পশ্চিমের সমসাময়িক চিত্রধারার সঙ্গে এ-ই তাঁর প্রথম সরাসরি পরিচয়। সাদৃশ্য রূপ ছেড়ে ফর্মের জ্যামিতিক বিভঙ্গ তাঁকে আকৃষ্ট করল, শিল্পে রূপের অতিশায়ন বা অতিরঞ্জনের প্রয়োগ সম্পর্কে এল সচেতনতা। তবে তাঁর বয়োকনিষ্ঠদের মতো এই নবলব্ধ উপলব্ধি তাঁকে পাশ্চাত্যমুখী না করে বরং করে তুলল আরও অন্তর্মুখী। বিদেশের মাটিতে বসে যেন তিনি আবিষ্কার করলেন স্বদেশের মুখ। দেশজ শিল্পের পরম্পরার মধ্যে তিনি দেখতে পেলেন অমিত সম্ভাবনা, একে সমকালের শিল্প-আঙ্গিকে প্রয়োগের অনুপ্রেরণা। এ বিশিষ্টতা জয়নুলের মানস-রূপের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক প্রতিভাত করে।

জয়নুল আবেদিনের চিত্রকর্ম ‘গুণটানা’

ধর্মীয় বিভাজন-চেতনায় প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্রে এসে চিত্র-ভাস্কর্য চর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুতের দায়িত্বেও তাঁর পথটি ছিল বন্ধুর। মাত্র ৬২ বছরের অবিশ্রাম সংগ্রামময় জীবনটি শুধু নিজের শিল্পীজীবন গড়ার কাজে ব্যয়িত হয়নি, এটি বিস্তৃত হয়েছে পাকিস্তানের প্রতিকূল পরিবেশে একটি শিল্প শিক্ষালয় প্রতিষ্ঠা ও শিল্পান্দোলন গড়ে তোলার পাশাপাশি পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ভাষ্য নির্মাণ পর্যন্ত।
পাকিস্তানে ১৯৫১ সালেই এঁকেছেন তাঁর অতি পরিচিত ‘বিদ্রোহী’, ‘মই দেওয়া’, ‘সাঁওতাল দম্পতি’ প্রভৃতি চিত্র। ‘বিদ্রোহী’ ছবিতে দড়ি ছেঁড়ার তীব্র প্রয়াসে ধাবমান গরুর শক্তিমান অভিব্যক্তিটি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। মই দেওয়ার দৃশ্যে যেমন, তেমনই ব্রহ্মপুত্র নদী পারাপারের জন্য অপেক্ষারত ছবিতে দেখি পিতা-পুত্রের পরস্পরনির্ভরতা, গ্রামীণ কৌমসমাজের পারিবারিক বন্ধনের মাধুর্যময় রূপ। ‘সংগ্রাম’ ছবিতে মানুষই শুধু নয়, পশুও শামিল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে জীবনের যুদ্ধে।
তাঁর স্বদেশ-অনুসন্ধানের অভীপ্সা আরও শিকড়-প্রত্যাশী হয়েছে লোককলাকে আশ্রয় করে চিত্রনির্মাণ প্রয়াসের মধ্যে। লোকশিল্পের আঙ্গিককে অবলম্বন করে তাঁর আঁকা ‘পাইন্যার মা’ বা ‘গুণটানা’ এ রীতির সার্থক সৃষ্টি। তবে লোককলার প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ইতিহাসখ্যাত সোনারগাঁয়ে বাংলাদেশ লোকশিল্প জাদুঘর স্থাপনে অগ্রণী ভূমিকা নিয়ে।
১৯৬৯ সালের গণজাগরণের উত্তাল জোয়ারে আন্দোলিত হয়েছিলেন শিল্পীও। আঁকলেন ৬৫ ফুট দীর্ঘ ‘নবান্ন’ চিত্রটি। এখানে বাঙালি-জীবনের এক আদ্যোপান্ত পাঁচালি যেন তুলে ধরলেন জড়ানো পটের রীতিতে। ১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিবাত্যা তাঁকে আলোড়িত করবে প্রবলভাবে। এটিই স্বাভাবিক। আঁকলেন ৩০ ফুট দীর্ঘ ‘মনপুরা-৭০’ স্ক্রলচিত্র। ‘মনপুরা’ চিত্রে গলিত মৃতদেহগুলো পর্যন্ত যেন পুঞ্জ-পুঞ্জভাবে ঊর্ধ্বমুখে ফুঁসে উঠতে চায়, মৃতের উত্থিত হাতের ভঙ্গিতে যেন প্রতীকায়িত হয়ে ওঠে প্রত্যাঘাতের প্রতিজ্ঞা। এ দুটি শিল্পকর্মে জয়নুল শুধু তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকেই প্রতিভাত করেন না, বাংলার জড়ানো পটের ঐতিহ্যকে অনুসরণ করে বক্তব্যকে বর্ণনাত্মক ভঙ্গিতে উপস্থাপন করে দেশজ সংস্কৃতির শিকড়ের সঙ্গেও একাত্মতা জ্ঞাপন করেন। এভাবেই জয়নুল আবেদিন হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর দিনযাপনের ও সংগ্রামের রূপকার আর উদার, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিবাদী বাঙালির এক শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ।
আবুল মনসুর: চিত্রশিল্পী; চিত্র-সমালোচক; সাবেক অধ্যাপক, চারুকলা ইনস্টিটিউট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।