Thank you for trying Sticky AMP!!

কালকের বাংলাদেশ সুন্দর হবেই

আগামী দিনের বাংলাদেশ কেমন হবে? আমাদের সমস্যা, সম্ভাবনা ও স্বপ্নের বিভিন্ন দিক নিয়ে বইপাঠে উ​দ্বুদ্ধকারী একুশে পদকপ্রাপ্ত পলান সরকার ও বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মুখোমুখি হলো নতুন প্রজন্ম

.

প্রশ্ন: শুরুতেই পলান সরকারের কাছে জানতে চাই, আপনি কী ভাবনা থেকে বই বিতরণ শুরু করেছিলেন?
পলান সরকার: এক কথায় কই, ‘পড়িলে বই আলোকিত হই, আর না পড়িলে বই অন্ধকারেই রই।’ বই পড়া যত বেশি হবে, সবাই তত আলোকিত হবে, আনন্দিত হবে। জীবন সুখী হবে। আমি সবাইকে বই পড়তে দিয়েছি কারণ আমার মতে, পৃথিবীতে যত কাজ আছে তার মধ্যে সব থেকে মূল্যবান কাজ হলো জ্ঞানদান। আর জ্ঞানের আধার হলো এই বই। বই যে যত বেশি পড়বে, সে তত বেশি জ্ঞানবান হবে।
কিন্তু আমার টাকাপয়সা ছিল না, বিদ্যা-বুদ্ধি ছিল না। শুরুতে এক লাইব্রেরির সঙ্গে যোগাযোগ করে নগদে, বাকিতে বই নিতাম। রাজশাহী অঞ্চলের ২০-২২টা গ্রামে হেঁটে হেঁটে গিয়ে আমি বই পড়তে দিই। আরেক দিন ফেরত আনি। এভাবেই চলছে ৩০ বছর। হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে আমি বই পড়তে দিয়েছি। আমার দেশের বেশিরভাগ মানুষ অশিক্ষিত। বই পড়ার প্রতি, পড়ালেখার প্রতি কারও আগ্রহ নেই। তারপরেও কিছু লোক আসে, বইপত্র পড়ে। আর আমার আসল কাজ, পথে পথে বই বিতরণ চলছেই।
প্রশ্ন: এবার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের কাছে আসি। আপনি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে সব সময় বলেন, ‘আলোকিত মানুষ চাই’। একজন আলোকিত মানুষের গুণাবলি কী কী? তাকে আমরা চিনব কীভাবে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: তুমি কি এই পৃথিবীতে সুখ চাও না দুঃখ চাও? অবশ্যই সুখ চাও। সব মানুষই তা চায়। তাই যে তোমাকে সুখ দিতে পারবে, সে হলো আলোকিত মানুষ। বিপরীতভাবে যে তোমাকে দুঃখ দেয়, সে হলো অন্ধকারের মানুষ। তাই আমার মতে, যে সবাইকে একটা সুন্দর পৃথিবী দিতে পারবে, একটা সুখী আনন্দময় জীবন দিতে পারবে, সে হচ্ছে একজন প্রকৃত আলোকিত মানুষ। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, একজন মানুষের পক্ষে কি পুরোপুরি আলোকিত মানুষ হওয়া সম্ভব? আমার মনে হয় তা সম্ভব নয়। কিছু পাপ, অপরাধ, নিষ্ঠুরতা এগুলো সবার মধ্যে থাকবেই। তবে হ্যাঁ, আমাদের সবারই আলোকিত হওয়ার চেষ্টাটা থাকা চাই। যে ব্যক্তি মন-প্রাণ, শক্তি দিয়ে ভালো মানুষ, সুন্দর মানুষ, আলোকিত মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছে, সেই হলো আলোকিত মানুষ।

প্রশ্ন: পরিচিতদের মধ্যে দেখি, বইপড়ুয়া বন্ধুদের সংখ্যা খুব কম। কেন?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ১০ জনের মধ্যে যদি নয়জনও খেলাধুলা কিংবা এটা-ওটা নিয়ে ব্যস্ত থাকে, তার পরেও মাথায় রাখবে যে একজন পাঠকও কমেনি। বইপড়ুয়া মানুষের সংখ্যা সব দেশে সব সময়ই কম থাকে। ১০ জন মানুষের মধ্যে কেবল একজন মানুষ বই পড়তে পারে। কারণ, বই পড়তে হলে চিন্তাশীল হতে হয়, মননশীল হতে হয়। তাই বইপড়ুয়া মানুষেরাই পৃথিবী বদলাতে পারে।

প্রশ্ন: এখনো দেশে অনেক অঞ্চল আছে, যেখানে বই পৌঁছায় না। সেখানকার ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করতে পারে না। প্রত্যন্ত সেই সব অঞ্চলে বই পৌঁছে দেওয়ার জন্য আপনার পরিকল্পনা কী?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: এখন পর্যন্ত সারা দেশে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মাধ্যমে আমরা ১৫ লাখ পাঠকের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি। কিন্তু বাংলাদেশে হয়তো পাঠক ৩৫ লাখ আছে। আমরা এখনো তাদের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। সেই পৌঁছানোর কাজটাতে তরুণ প্রজন্ম এগিয়ে আসুক, এটাই আমার চাওয়া। তোমার সাধ্য তুমি করো, আমার সাধ্য আমি করি, সকলের সাধ্য সকলে করুক, দেখো বাংলাদেশ পরিবর্তন হয়ে যাবে। কথা দিয়ে হবে না। কাজ দিয়ে করে দেখাতে হবে।

.

প্রশ্ন: পলান সরকার, আপনি কীভাবে লেখাপড়ায় আগ্রহী হলেন?
পলান সরকার: জন্মালেই মানুষ হয় না। শিক্ষাই মানুষকে মানুষ করে। আমি নিজে কিন্তু কিছু না। পাঁচ মাস বয়সে বাবা মারা গিয়েছেন। কলেজ-ভার্সিটি পড়তে পারিনি। নিজে নিজে লেখাপড়া করেছি। এক মাস্টার বিনা পয়সায় প্রাইমারি পড়িয়েছিলেন, তাও সেই স্কুলে ক্লাস ফাইভ ছিল না। চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিলাম। তাও ফাইনাল পরীক্ষা দিতে পারিনি। পরীক্ষা দেওয়ার জন্য নাটোর যাওয়ার কথা ছিল, সেই নাটোরে যাওয়ার পয়সা দেওয়ার কেউ ছিল না। তাই যাওয়া হয়নি, পরীক্ষাও দেওয়া হয়নি। আমার পড়াশোনা ওইটুকুই। দুনিয়া আমার এভাবেই চলছে। আজ যতটুকু আসতে পেরেছি, নিজের চেষ্টাতেই পেরেছি।
প্রশ্ন: আমরা কিশোর-তরুণেরা সবাই কমবেশি স্বাপ্নিক। আমাদের স্বপ্নপূরণের জন্য আমরা কী করতে পারি?
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: স্বপ্ন তোমার, বাস্তবায়ন কাকে করতে হবে? অবশ্যই তোমাকে। স্বপ্ন মানে আকাশে কিছু মেঘ উড়ে যাচ্ছে আর আমি তা দেখলাম, সেটাই আমার স্বপ্ন হয়ে গেল; এটা হতে পারে না। তুমি নিজে যে স্বপ্ন দেখো, সেই স্বপ্ন পূরণে তুমি কী কাজ করলে, সেই কাজটাই হলো আসল স্বপ্ন। আমরা মনে করি যে বসে বসে শুয়ে শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখলাম আর লাখ টাকা হয়ে গেল; সেটা স্বপ্ন হতে পারে না। লাখ টাকা পাওয়ার জন্য তুমি যা করবে, সেটাই হলো তোমার স্বপ্ন।

প্রশ্ন: আগামী দিনগুলোতে বইয়ের ভবিষ্যৎ কী? ছাপার অক্ষরে বই থাকবে, নাকি সবই ডিজিটাল হয়ে যাবে? তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পঠন-পাঠনের অবস্থা কেমন হতে পারে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: মানুষ যখন পাথরে লিখত তখন তা ছিল বই, তারপর মানুষ যখন গাছের ছালে, পাতায় কিংবা চামড়ায় লিখত তখন তা ছিল সেকালের বই। এত দিন কাগজে লেখা হচ্ছে। এখন আবার ডিজিটাল সিস্টেম শুরু হয়েছে। কিন্তু আসল কথা, সেটা বই হলো কি না! ডিজিটালভাবে হলেও সেটা কি বই নয়? অবশ্যই সেটাও বই। আমার ধারণা, পাঠ্যবই, তথ্যের বই, গবেষণার বই—এই বইগুলো ডিজিটালভাবে এলে আমাদের সবারই সুবিধা। আর কিছু বই আছে, যেগুলো স্বপ্ন দেখায়, যে বই ভাবায়, যে বই আমাকে বড় হওয়ার প্রেরণা দেয়, সাহিত্যের বই, আনন্দের বই, সৌন্দর্যের বই, যেগুলোর সঙ্গে আমাদের একটা সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আমার মনে হয়, ওই ধরনের বইগুলো কাগজের বই হিসেবেই থেকে যাবে। সামনের পৃথিবীতে কী হবে তা আমরা কেউই বলতে পারি না। তবে আমার মতে, দুই ধরনের বই-ই চলতে থাকবে।

প্রশ্ন: আপনি যেসব গ্রামে বই বিতরণ করেন, সেখানে শুধু কি ছেলেরাই পড়ে, নাকি মেয়েরাও আছে?

পলান সরকার: ছেলে ও মেয়ে সবার কাছে আমি বই দিই। শুরুর দিকে শুধু ছেলেরা ছিল, ছিল দু-একজন মেয়ে। এখন মেয়েরা অনেক পড়ছে। মেয়েদের না হলে জাতির উন্নতি হয় না। মেয়েদের কাজে লাগাতে হবে। ক্ষমতা দিতে হবে। যত রকমের ক্ষমতা আছে, সব কাজেই তাদের লাগাতে হবে।

.

প্রশ্ন: জীবন নিয়ে আপনার ভাবনা কী?
পলান সরকার: ‘জন্মিলে মরিতে হবে, অমর কে কোথা কবে? চিরস্থির কবে নীর হায় রে জীবন-নদে?’ এই জীবন নদীতে জোয়ার-ভাটা সবই আছে। এসব থেকে বাঁচতে হলে দরকার জ্ঞান। লেখাপড়া। অনেকেই এগুলো বিশ্বাস করে না। নিজে কীভাবে ধনী হওয়া যাবে, আরেকজনকে কীভাবে জব্দ করা যাবে, তা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। এই প্রতিযোগিতা করতে গিয়েই দেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মারামারি কাটাকাটিতে দেশ অস্থির হয়ে গেছে। কে কার থেকে বড় হবে, ওপরে উঠবে তা নিয়েই ব্যস্ত। ঠেলাঠেলি-মারামারি করে এরা অস্থির। আমি রাজনীতি বুঝি না। কিন্তু এরা একসঙ্গে বসে আলোচনা করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। মারামারি করে কোনো সমাধান আসবে না। মিলিতভাবে কাজ করলে, আলোচনা করলে সমাধান আসবে। সে জন্য দরকার ভালো মানুষ।
প্রশ্ন: তাহলে ভালো মানুষ তৈরিতে আপনার পরামর্শ কী?
পলান সরকার: ভালো মানুষ চিনতে হলে নিজেকেও ভালো মানুষ হতে হবে। সব দিক বিচার-বিবেচনা করার ক্ষমতা থাকতে হবে। নিজে ভালো মানুষ হও। আরেকজন ভালো মানুষকে চিনতে পারবে। সবাইকে চেষ্টা করতে হবে। বসে থাকলে কিছু হবে না। নিজের চেষ্টার কারণেই সবকিছু হবে। যে চেষ্টা করবে, সেই বড় হতে পারবে। আর কাজ করতে হবে। ভালো ভালো কথা অনেকেই বলে কিন্তু কাজ কেউ করে না। কথায় আছে, ‘মনে বলে হেন কর্ম না করিব আর’ মনে সবাই বলে যে কেউ খারাপ কাজ করবে না। কিন্তু স্বভাবে পরিবর্তন না হলে সে কাজ সবাই করতেই থাকবে। মনে মনে বলে কিছু হবে না। স্বভাবের পরিবর্তন করতে হবে।

প্রশ্ন: ভবিষ্যতের বাংলাদেশ কেমন হবে? ভবিষ্যতের বাংলাদেশ নিয়ে আপনার আশা কী?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বাংলাদেশে অনেক মানুষ এখনো আছে, যাদের কাছে যদি আমরা সুযোগ-সুবিধাগুলো ঠিকঠাক পৌঁছে দিতে পারি, তাহলে সেই ঘুমন্ত মানুষ, শুয়ে থাকা মানুষগুলো জেগে উঠবে। তোমরা জানো যে চাহিদা থাকলে সরবরাহ থাকে। আবার সরবরাহ থাকলে চাহিদা তৈরি হয়। এখন আমরা যদি সরবরাহটা দিতে পারি সারা দেশে, তাহলে সারা দেশের মানুষের মধ্যে নিদেনপক্ষে আলোকিত হওয়ার চেষ্টাটা জেগে উঠবে। সেই কাজটায় নতুন প্রজন্ম এগিয়ে আসবে, এটাই আমার আশা।

প্রশ্ন: ধরা যাক, আজ থেকে ২০ বছর পর বাংলাদেশকে কোথায় দেখতে চান?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: ২০ বছর পর বিত্তবৈভবের দিক থেকে বাংলাদেশ যথেষ্ট সম্পদশালী হবে, এটা আমি বলতে পারি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ এখন অসৎ। নৈতিকতার দিক থেকে আমরা ধ্বংস হয়ে গেছি। ক্ষমতার লোভে দেশে সুশাসন ধ্বংস হয়ে গেছে। আমাদের সংবিধানে ৭০ ধারা থাকার কারণে দুইটা স্বৈরতন্ত্র তৈরি হয়েছে, যারা একে অপরকে শেষ করে দিয়ে নিজেরা ক্ষমতায় আসতে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই সংঘাত করতে গিয়ে দুই দল জনগণের বদলে নির্ভর করছে সন্ত্রাসীদের ওপরে, খুনিদের ওপরে, লাঠিয়াল বাহিনীর ওপরে। এর ফলে রাষ্ট্রের সব ন্যায়নীতি নষ্ট হয়ে গেছে৷

প্রশ্ন: এই অবস্থা কবে বদলাবে?

আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ: বদলটা রাতারাতি হবে না। হবে ক্রমাগতভাবে। রাজনীতি এখন একমুখী হয়ে গেছে। রাজনীতি নিজেও সংঘাতে সংঘাতে একসময় ক্লান্ত হয়ে যাবে। শক্তিহীন হয়ে যাবে। আর ধীরে ধীরে দেখবে সাধারণ জনগণের মধ্য থেকেই শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নায়কেরা-নায়িকারা উঠে আসবে। আমি মনে করি, আমরা একটা জাতি যখন একই ভাষায় কথা বলি, একই সংস্কৃতির মানুষ, তখন একসময় না একসময় এই সমস্যার সমাধান হবেই। আমার মতে, তোমরা তোমাদের জীবদ্দশায় তা দেখে যাবে। যদি তুমি সেই নায়ক হও। আর যদি তুমি বসে থাক যে কখন কোন নায়ক উঠে আসবে, তাহলে তো আর হবে না। নিজেকে আগাতে হবে। অন্যের দিকে তাকিয়ে থাকার লোকের সারিতে নিজেকে রাখলে হবে না।

শুধু একটা কথা মাথায় রেখো, তোমাকে উঠে দাঁড়াতে হলে তুমি একাই যথেষ্ট। তোমরা উঠে দাঁড়াও। দেখো বাংলাদেশ একদিন বদলাবেই।

অংশগ্রহণকারী

সামীয়া শারমিন, একাদশ শ্রেণি, হলি ক্রস কলেজ

মাহতাব রশীদ, নবম শ্রেণি, উদয়ন মাধ্যমিক উচ্চবিদ্যালয়

সাবিহা শারমিন, নবম শ্রেণি, তেজগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়

সজিব উজ জামান, একাদশ শ্রেণি, সরকারি বিজ্ঞান কলেজ

ফারহানা আমিন, অষ্টম শ্রেণি, শহীদ বীর উত্তম লে. আনোয়ার গার্লস কলেজ

মাশায়েখ হাসান, দশম শ্রেণি, বিয়াম মডেল স্কুল

আলোকচিত্রী: সুমন ইউসুফ

সঞ্চালক

ফিরোজ জামান চৌধুরী