Thank you for trying Sticky AMP!!

পদ্মায় লঞ্চডুবি

নিখোঁজ স্বজনের পদ্মার তীরে অপেক্ষা৷ ছবি: হাসান রাজা

আড়াইশর বেশি যাত্রী নিয়ে কাত হয়ে আস্তে আস্তে ডুবে যাচ্ছে এমএল পিনাক নামের একটি লঞ্চ। দিনের আলোয়, চোখের সামনে। পদ্মার উত্তাল স্রোতে পাশের লঞ্চটিও এই বুঝি ডুবে যাবে। শত শত যাত্রী সেই করুণ দৃশ্য দেখছেন, আতঙ্কিত হচ্ছেন, সৃষ্টিকর্তাকে ডাকছেন। একসময় আর দেখা যাচ্ছে না পিনাক। কাত হয়ে একেবারেই ডুবে গেল। একসঙ্গে অনেক মানুষের সলিলসমাধি।
পাশের লঞ্চটির নাম এমএল সৈকত সেতু। ৪ আগস্ট মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় ঘটে যাওয়া পিনাক-৬ দুর্ঘটনা দেখেছেন সৈকত সেতুর একজন যাত্রী অপূর্ব সেন। তিনি ঠিক এ রকমই বর্ণনা দেন প্রথম আলোর প্রতিবেদকের কাছে। অপর এক যাত্রীর মুঠোফোনে ভিডিও করা এমন করুণ দৃশ্য দেখে টেলিভিশনের অনেক দর্শকই শিহরিত হয়েছেন। অপূর্ব বলেন, ভিডিওর চেয়ে আরও মর্মান্তিক ছিল বাস্তব দৃশ্য, যা তাঁর মতো শত শত প্রত্যক্ষদর্শী কখনোই মন থেকে মুছে ফেলতে পারবেন না।
মাদারীপুরের কাওড়াকান্দি থেকে ছেড়ে আসা পিনাকে ৮৫ জনের জায়গায় আড়াই শয়ের ওপর যাত্রী ছিল। দুর্ঘটনার পর শেষ পর্যন্ত মোট উদ্ধার হওয়া মৃতদেহের সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬। নিখোঁজ হয় ৬১ জন। বাকিদের জীবিত উদ্ধার করা হয়।
২০১৪ সালেরই ৩ মে পটুয়াখালীর গলাচিপা নদীতে ১০০ যাত্রী নিয়ে ডুবে যায় এম ভি শাথিল-১ নামের আরেকটি লঞ্চ। ১৫ মে তিন শয়েরও বেশি যাত্রী নিয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় মেঘনা নদীতে ডুবে যায় এমভি মিরাজ। এ দেশে সবচেয়ে বড় লঞ্চ দুর্ঘটনা হিসেবে চিহ্নিত ২০০৩ সালের এমভি নাসরীন ডুবে আট শয়েরও বেশি যাত্রী মারা গিয়েছিল। ১৯৮৬ সালে এমভি সামিয়া দুর্ঘটনায় মারা যায় চার শয়েরও বেশি। সব দুর্ঘটনাই করুণ। কিন্তু মৃতের সংখ্যা অপেক্ষাকৃত কম হলেও এম ভি পিনাক দুর্ঘটনায় যে হৃদয়বিদারক ও চাঞ্চল্যকর দৃশ্যের অবতারণা হয়, তা গোটা জাতিকে ভীষণভাবে আলোড়িত করে।
বাংলাদেশ লঞ্চ মালিক সমিতির যুগ্ম সম্পাদক আবদুর রউফ দুর্ঘটনার বিবরণ দিয়ে বলেন, পিনাক দুর্ঘটনায় প্রচুর যাত্রী ডুবে গেলেও ৪০টির মতো স্পিডবোট ত্বরিত ছুটে গিয়ে অনেক যাত্রীকে উদ্ধার করেছিল। নইলে প্রাণহানি অনেক বেশি হতো। অনেক যাত্রী উদ্ধার হলেও যাঁদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না তাঁদের জন্য পদ্মার পাড়ে অপেক্ষার প্রহর গুনছিলেন স্বজনেরা। তীর থেকে মাঝপদ্মায় দৃষ্টি ফেলে ছয় দিন অপেক্ষা করেছেন বৃদ্ধ জোহরা বেগম। ডুবে যাওয়া দুই মেয়ে কোথায়? শরীয়তপুরের শেখ সাদী খুঁজেছেন দুই সন্তান আর স্ত্রীকে। ১৫ বছর বয়সী রিমার দুই চোখ অস্থির ছিল বোন-ভাই ও খালা-খালুর জন্য। মধ্যবয়সী আলী জব্বার ছেলে, দুই মেয়ে আর স্ত্রীকে খুঁজে বেড়িয়েছেন।
লাশ ও পিনাক উদ্ধার তৎপরতা—সবই প্রায় ব্যর্থ। মাঝনদীতে নয়, দমকল বাহিনীর ডুবুরি দল যাত্রীদের খুঁজেছেন নদীর ঘাট এলাকায়। নৌমন্ত্রী শাজাহান খান ও কর্মকর্তারা জাহাজে টহল দিয়ে আশার কথা শুনিয়েছেন শুধু। পদ্মার ওপর হেলিকপ্টারে ঘুরে কয়েক লাখ টাকার তেল পুড়িয়েছেন বিআইডব্লিউটিএর কর্তাব্যক্তি। উদ্ধারকারী নৌযান ‘রুস্তম’ দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছে প্রায় ১০ ঘণ্টা পর। আরেকটি উদ্ধারযান ‘নির্ভীক’ আসে দুই দিনের মাথায়। ব্যর্থ হলে নৌবাহিনীর আধুনিক যন্ত্র দিয়ে খোঁজা হয়। অবশেষে ছয় দিনের মাথায় সবাই হতাশ, থেমে যায় খোঁজার পালা।
বাঁধা নিয়মে দুর্ঘটনার তদন্ত হলো। ৩৫ দিন পর প্রকাশিত হলো প্রতিবেদন। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ও ঘাটের অব্যবস্থাপনাকে দুর্ঘটনার তিন কারণ দেখিয়ে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা এড়াতে এসব বিষয়ে সতর্ক থাকার সুপারিশ করা হলো। দায়ী করা হলো লঞ্চের মালিক, মাস্টার ও চালককে। ওই পর্যন্তই। সুপারিশ বাস্তবায়ন হয়নি। সবই চলছে আগের মতো।