Thank you for trying Sticky AMP!!

পাবনায় প্রতিরোধযুদ্ধ

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে নিরীহ বাঙালি অসীম সাহসে মুখোমুখি হয়েছিল পাকিস্তানের প্রশিক্ষিত বাহিনীর বিরুদ্ধে । ছিনিয়ে এনেছিল বিজয়। বীরত্বপূর্ণ সেসব সম্মুখযুদ্ধ উজ্জ্বল হয়ে আছে স্বাধীনতার স্বপ্নে, আত্মত্যাগের মহিমায়। মুক্তিযুদ্ধের বহুল আলোচিত কয়েকটি যুদ্ধ নিয়ে প্রথম আলোর এ আয়োজন।

মো. জহুরুল ইসলাম

জনযুদ্ধের শুরুতে ১৯৭১ সালের ২৮ মার্চ বাংলাদেশের মধ্যে প্রথম পাবনা জেলা পাকিস্তানি সেনামুক্ত হয়েছিল। পাবনার বিপ্লবী জনগণ ২৫ মার্চ শুরু হওয়া ‘অপারেশন সার্চলাইট’ কার্যকর করার জন্য পাবনায় পাঠানো পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানির বেশি সেনাকে সম্মুখযুদ্ধে হতাহত করেছিল। অপারেশন সার্চলাইটের আওতায় সমগ্র বাংলাদেশে পাকিস্তান আর্মি আক্রমণ শুরু করার পর তিনটি জেলায় আর্মিদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। এই জেলাগুলো ছিল চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়া ও পাবনা। চট্টগ্রামে প্রতিরোধ গড়ে তোলে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ইপিআর। ৪ এপ্রিলের মধ্যে ইপিআর ও জনগণের আক্রমণে কুষ্টিয়ায় সব পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। ২৯ মার্চ পাবনার বিপ্লবী জনগণের আক্রমণে পাকিস্তানি সেনাদের বেশির ভাগ নিহত হয়। বাকিরা রাজশাহীর দিকে পালিয়ে যায়। বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র পাবনা জেলাতেই সাধারণ মানুষ যুদ্ধ করে এতগুলো পাকিস্তানি আর্মি খতম করেছিলেন। যুদ্ধের পর ২৮ মার্চ থেকে শুরু করে ১১ এপ্রিল বিকেল পর্যন্ত ১৩ দিন পাবনা শহর শত্রুমুক্ত ছিল।

২৫ মার্চ সকালে পাবনা জেলা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান মো. রফিকুল ইসলাম বকুল গোপালপুরে আবদুর রাজ্জাক রিদ্দিকের (শহীদ রিদ্দিক) বাড়ির সামনের মাঠে এক জরুরি সভা আহ্বান করেন। উত্তাল মার্চে সমগ্র দেশে দুর্বার গণ-আন্দোলন চলছিল।

ঢাকার রাজপথে এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের খবর আসছিল। যেকোনো সময় পাবনাতেও আর্মিরা চলে আসতে পারে। উদ্ভূত পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করা হবে, এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতেই আলোচনা শুরু হলো। পরবর্তী পরিস্থিতি আরও ভয়ংকর হতে পারে। শত্রু বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য আমাদের কাছে আছে শুধু বোমা, পাইপগান, ছুরি, তলোয়ার, ফালা, সড়কি, তির-ধনুক ধরনের হালকা দেশি অস্ত্রশস্ত্র; যা দিয়ে টিকে থাকা সম্ভব নয়। সার্বিক অবস্থা বুঝতে পেরে বকুল ভাই অস্ত্র ও গুলি সংগ্রহের সিদ্ধান্ত দিলেন। সিদ্ধান্ত হলো, যাদের বাড়িতে লাইসেন্স করা অস্ত্র আছে, সেগুলো যেভাবেই হোক সংগ্রহ করতে হবে। পাকিস্তানি বাহিনী যদি পাবনায় আসে, তবে এগুলো দিয়েই তাদের প্রতিরোধ করতে হবে। যেসব খবর পাওয়া গেছে, তাতে দেশে যেকোনো সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। অস্ত্র সংগ্রহ করে সবাইকে কাচারিপাড়ায় সাহারা ক্লাবে চলে আসার সিদ্ধান্ত নিয়ে সভা দ্রুত শেষ করা হলো।

সময় নষ্ট না করে আমরা সবাই বেরিয়ে পড়লাম অস্ত্র সংগ্রহে। এড্রুকের রাজ্জাক তাঁর বাড়ি থেকে একটি রাইফেল ও একটি দোনলা বন্দুক গুলিসহ নিয়ে এলেন।

আমিনুল ইসলাম চৌবের (বিলু বাবু) কাছে চাইতেই তাঁর টু-টু বোর রাইফেল দিয়ে দিলেন। আমাদের পাড়া থেকে দুটি টু-টু বোর রাইফেল সংগ্রহ করা হলো। বকুল ভাইদের পাড়ার ইঞ্জিনিয়ার মো. ইদ্রিস হায়দার তাঁর বন্দুক দিয়ে দিলেন। যাঁদের বাড়ি থেকে বন্দুক-রাইফেল নিয়ে আসা হয়েছে, তাঁরা আমাদের পরিচিত। বেশির ভাগ পরিচিতজন তাঁদের অস্ত্র চাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দিয়ে দিলেন। সারা দিনে প্রায় ১৯-২০টি বন্দুক এবং টু-টু বোর রাইফেল ও বেশ কিছু গুলি সংগ্রহ করা হলো।

বন্দুক, ছোরা, তলোয়ার, বোমা—যে যা পেরেছে, সব নিয়ে সাহারা ক্লাবের মাঠে জমায়েত হতে শুরু করল। যে বাড়ি থেকে সহজে অস্ত্র দিতে চায়নি, তাদের ওপর কিছুটা বল প্রয়োগ করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে এ রকম কয়েকজন বিষয়টি নিয়ে থানায় অভিযোগ করার কারণে পাবনার প্রশাসনে তোলপাড় শুরু হয়ে যায়। পুলিশ আমাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধারের চেষ্টা চালাতে থাকে। অনেকের বাড়িতে পুলিশ গিয়ে খোঁজখবর নিতে থাকে। বিশেষ করে বকুল ভাইকে ধরতে পুলিশ তৎপর হয়ে ওঠে। দুপুরে একটি বাড়িতে অবস্থান করার সময় পুলিশ বাড়িটি ঘিরে ফেলে। বকুল ভাই তখন গ্রেপ্তার এড়াতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেই বাড়ির দোতলার ছাদ থেকে লাফ দিয়ে পালিয়ে যান। শহরে বিভিন্ন স্থানে তৎপরতা চালালেও সাহারা ক্লাবের দিকে পুলিশ একবারও আসেনি। আমরা সবাই ওই এলাকায় অবস্থান করতে থাকলাম। এভাবেই কেটে গেল সারা দিন। আকাশবাণী কলকাতা বেতার কেন্দ্র থেকে যেসব খবর পাওয়া যাচ্ছিল, তাতে সামনের ভয়ংকর দিনের আভাস পরিষ্কার হয়ে উঠছিল।

উল্লেখ্য, এই অস্ত্র সংগ্রহের অনেক আগেই পাবনার দামাল ছেলেরা সশস্ত্র যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পাকিস্তানের সামরিক সরকার ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ষড়যন্ত্র করতে থাকে। অবস্থা বুঝতে পেরে তখনই সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমিটির প্রধান আবদুর রাজ্জাক ও কেন্দ্রীয় নেতা তোফায়েল আহমেদ ঢাকা থেকে নির্দেশ পাঠান। রফিকুল ইসলাম বকুলের উদ্যোগে পাবনায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সদস্যদের গোপনে সশস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া শুরু হয়। তিনি তখন পাবনা জেলার স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সভাপতি। সাহারা ক্লাবের আনোয়ার হোসেন (ঘুটু মেম্বার) ছিলেন সদর থানা স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান। গোপালপুর ক্লাবের মাঠে এবং পাবনা জিলা স্কুলের মাঠে প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় প্রকাশ্যে পিটি প্যারেড করানো হতো। আর রাতে জিলা স্কুলের ওয়ার্কশপে পাইপগান, ছুরি, তলোয়ার, তির-ধনুক, হাতবোমাসহ বিভিন্ন অস্ত্রের ব্যবহার শেখানো হতো। এ বিষয়ে জিলা স্কুলের দারোয়ান নুরুজ্জামানের ভূমিকা ছিল খুবই আন্তরিক। সে প্রায় প্রতি রাতেই গোপনে জিলা স্কুলের ওয়ার্কশপ রুম খুলে দিয়েছে। সেখানে থাকা মেশিনপত্র ব্যবহার করে দেশি অস্ত্রশস্ত্র তৈরি করা হতো। বিভিন্ন পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর কমিটি গঠন করে তাদের নিজ নিজ এলাকায় ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিভিন্ন দেশি অস্ত্র, যে যা পেয়েছে, তা-ই নিয়ে সবাই প্রস্তুত হয়েছিল।

‘অপারেশন সার্চলাইট’ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে সমগ্র বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মতো পাবনা জেলায়ও আক্রমণ চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। ২৫ মার্চ দিবাগত রাত আড়াইটায়, অর্থাৎ ২৬ মার্চ শুক্রবার ভোরবেলা রাজশাহী থেকে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের এক কোম্পানি পদাতিক সেনা পাবনায় পৌঁছায়। শহরের বিসিক এলাকায় এসে তারা অবস্থান নেয়। এ কোম্পানির কমান্ডিং অফিসার ছিল ক্যাপ্টেন আসগার ও ডেপুটি কমান্ডিং অফিসার ছিল লেফটেন্যান্ট রশিদ। এদের সঙ্গে ছিল তিনজন সুবেদার ও নায়েব সুবেদার র‌্যাংকের জেসিওসহ মোট ১৩০ জন সেনা।

পাবনায় ক্যান্টনমেন্ট নেই, তাই বাঙালি কোনো আর্মি ছিল না। পাবনায় ইপিআর ক্যাম্প নেই, তাই কোনো বাঙালি ইপিআরও ছিল না। এ কারণে হানাদার বাহিনী পাবনায় এসে প্রথমেই আক্রমণ চালায় নিরস্ত্র সাধারণ মানুষের ওপর।

২৬ মার্চ সকাল থেকে নিজস্ব ভ্যান ও জিপ নিয়ে সারা শহরে টহল দিতে থাকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী। পাবনা বাজারের পাহারাদারদের তৎকালীন সর্দার ছিল উজির খান। সে তাদের একটি জিপে উঠে শহরের পথঘাট এবং আওয়ামী লীগের নেতাদের ঘরবাড়ি চিনিয়ে দেয়। পাকিস্তানি বাহিনী বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে জিপ থামিয়ে বারবার বলতে থাকে, ‘কারফিউ হো গিয়া হ্যায়, সব শালে ভাগ যাও।’ শহরের মানুষজন বিষয়টির গুরুত্ব বুঝে ওঠার আগেই বেলা ১১টার দিকে হঠাৎ করে তারা সাধারণ মানুষের ওপর বর্বরোচিতভাবে গুলি চালাতে থাকে। তাদের গুলিতে অনেক নিরীহ মানুষ রাস্তায় লুটিয়ে পড়েন, কেউ নিহত হন, কেউ গুরুতর আহত হন। বিভিন্ন গলির মধ্যে বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষকেও তারা গুলি করে হত্যা করতে থাকে।

এমনকি সেদিনের একটি জানাজার নামাজেও গুলি করে তারা। ফলে সেখানেও কয়েকজন নিহত ও আহত হন। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে একজন গুলিতে নিহত হন। শহরতলি ও আশপাশের গ্রামেও তারা আক্রমণ শুরু করে। এতে অনেক মানুষ মারা যান। সারা শহর থমথমে হয়ে যায়। হতভম্ব হয়ে যায় পাবনার মানুষ, অজানা আতঙ্কে দিশাহারা হয়ে পড়ে।

এদিকে ২৬ মার্চ রাতেই আর্মিরা পাবনা শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে অনেক নেতা ও সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন পাবনা সদর মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন এমপিএ, মোটর ব্যবসায়ী আবু সাইদ তালুকদার, ডা. অমলেন্দুকুমার দাক্ষী, আমার বড় মামা মোশারফ হোসেন মোক্তার, পাবনা পৌরসভার ট্যাক্স কালেক্টর আবদুল খালেক, আলহাজ কফিল উদ্দিন আহম্মেদ, রাজেম নামে একজন পাগলসহ প্রায় ২০-৩০ জন।

পাবনা শহরে প্রতিরোধযুদ্ধ এলাকার নকশা

বিসিক এলাকায় আটকে রেখে তাঁদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার চালানো হয়। ২৭ মার্চ গভীর রাতে ওই নরপশুদের গুলিতে অ্যাডভোকেট আমিনুদ্দিন, সাইদ তালুকদার, ডা. দাক্ষী, রাজেমসহ আরও কয়েকজন শহীদ হন। অন্যরা আহত না হলেও বা গুলি না লাগলেও গুলিতে মারা যাওয়ার ভান করে মাটিতে শুয়ে পড়েন। পাকিস্তান আর্মি বিসিক ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর তাঁরা কোনো রকমে বেঁচে যান।
২৭ মার্চও তারা যাকে সামনে পায়, তাকেই গুলি করতে থাকে। তারা ভেবেছিল, এভাবেই স্তব্ধ করে দেবে পাবনার মানুষকে। ইতিমধ্যে তারা ওয়াপদা বিদ্যুৎ কন্ট্রোল রুমে এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জ ও টেলিগ্রাম অফিসে প্রহরায় নিযুক্ত করল কিছু আর্মি। প্রশাসনের কর্মকর্তা ও পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ দিল। কয়েকটি জিপ ও আর্মি ভ্যান নিয়ে শহর ও শহরতলিতে টহল দিতে থাকল। কোথাও কোনো প্রতিরোধ না হওয়ায় এবং রাস্তাঘাটে লোকজন তেমন দেখতে না পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ভাবল, সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। হানাদার বাহিনী তখনো বুঝতে পারেনি, তাদের সামনে কত ভয়ংকর সময় অপেক্ষা করছে পাবনার মাটিতে।

পাকিস্তানি বাহিনীর নির্দেশ অমান্য করে, পাবনার প্রশাসন বা পুলিশ বাহিনীর কেউ তাদের কাছে আত্মসমর্পণ না করায় ২৮ মার্চ ভোরবেলা পাবনা পুলিশ লাইন আক্রমণ করল তারা। রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে আমরাও শুরু করলাম তাদের ওপর আক্রমণ। পাবনার মাটিতে শুরু হলো পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। পাবনার আপামর জনগণ জীবন বাজি রেখে ঝাঁপিয়ে পড়ল এই যুদ্ধে।

পাকিস্তানি বাহিনী পাবনার সাধারণ মানুষের ওপর পৈশাচিক আক্রমণ শুরু করলে সাহারা ক্লাব থেকে আমরা দলবল নিয়ে ২৬ মার্চ সকালেই শহরের উপকণ্ঠে চর এলাকায় নবাব আলী মোল্লার (লবা মোল্লা চাচা) বাড়িতে চলে যাই। সবাইকে সেখানে উপস্থিত হওয়ার জন্য খবর পাঠানো হয়। পরদিন ২৭ মার্চ সকালের মধ্যেই বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর অনেক সদস্য সেখানে হাজির হলো। পাবনার সাধারণ মানুষজনের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বর আক্রমণের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আমরা এখন কী করব, সে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হলো। বকুল ভাই সিদ্ধান্ত দিলেন, যেভাবেই হোক, হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে হবে।

যেখানেই সম্ভব সেখানেই রাস্তা বন্ধ করে দিতে হবে। সুযোগ পেলেই তাদের ওপর গুলি চালাতে হবে। কিন্তু কীভাবে, কোথায় আমরা প্রতিরোধ করব, তার চূড়ান্ত পরিকল্পনা করতে পারছিলাম না। সন্ধ্যায় বেশ কিছু গুলির শব্দ শোনা গেল। পরে খবর পেলাম, পোস্ট অফিসের সামনের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় পুলিশ লাইনের ওপর আর্মি কিছু গোলাগুলি করে চলে গিয়েছে। পুলিশ বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলেছে।

২৭ মার্চ পাবনার ডিসি মো. নূরুল কাদের খান রফিকুল ইসলাম বকুলের কাছে খবর পাঠান তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য। আর্মি ডিসি সাহেবকে খুঁজতে থাকায় তিনিও শহরের পাশের চর এলাকায় এক বাড়িতে আত্মগোপন করেছেন। তাঁর খবর পেয়ে প্রথমে আমরা যাইনি। ভেবেছিলাম, তিনি আবার আমাদের ডাকবেন কেন। সন্ধ্যার কিছুক্ষণ পর আমজাদ হোসেন এমএনএ আমাদের কাছে মুনু সর্দার ভাইকে পাঠিয়ে খবর দিলেন, ডিসি সাহেবের সঙ্গে দেখা করার জন্য। তখন সবাইকে একত্রে থাকতে বলে বকুল ভাইয়ের সঙ্গে আমরা চার-পাঁচজন গেলাম ডিসি সাহেবের কাছে। রাত তখন প্রায় ১২টা, পৌঁছে দেখি আমাদের প্রিয় নেতা আবদুর রব বগা মিয়া এমপিএ সেখানে আছেন। ডিসি সাহেব ওয়্যারলেসে বিভিন্ন এলাকায় আর্মিদের অবস্থান জানার চেষ্টা করছেন। তিনি আমাদের দেখে যেন আশ্বস্ত হলেন। বললেন, আর্মিরা তাঁকে দেখা করতে বলেছিল, কিন্তু দেখা না করায় তাঁর বাড়ি ঘেরাও করেছিল। তিনি কোনো রকমে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালিয়ে এসেছেন। আরও বললেন, আর্মিরা পুলিশকে আত্মসমর্পণের জন্য চাপ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু পুলিশকে তিনি আত্মসমর্পণ করতে নিষেধ করেছেন। কিছুক্ষণ আগে পুলিশ লাইন থেকে আরআই খবর পাঠিয়েছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পুলিশকে আর ধরে রাখা যাচ্ছে না, দ্রুত একটা কিছু করতে অনুরোধ করেছেন।

পাবনা পুলিশ লাইন দখলের পর মুক্তিযোদ্ধারা

আমাদের তিনি বললেন, ‘তোমরা যেভাবে পারো, আর্মিদের প্রতিরোধ করো। হঠাৎ পুলিশ বাহিনী যদি পুলিশ লাইন ছেড়ে চলে যায় অথবা সারেন্ডার করে ফেলে, তাহলে কাউকে ওরা বাঁচতে দেবে না।’ বকুল ভাই আর্মিদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের জন্য আমাদের পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্তের কথা তাঁকে বিস্তারিত জানালেন। কথা শুনে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করলেন। এ ধরনের বিভিন্ন বিষয় আলোচনা করার পর ডিসি সাহেব ও আমরা একসঙ্গে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রতিরোধ করার সিদ্ধান্ত নিই। এরপর সবার হাতে হাত রেখে শপথ গ্রহণ করালেন তিনি। তখন রাত প্রায় চারটা, অর্থাৎ ২৮ মার্চ রোববার। হঠাৎ তুমুল গোলাগুলির শব্দ শুনতে পেলাম। প্রথমে মনে হয়েছিল, আমাদের ওপর আক্রমণ করেছে। ডিসি সাহেব বললেন, ‘মনে হচ্ছে, আর্মিরা পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে। তোমরা তাড়াতাড়ি যাও, একটা কিছু করো।’

ডিসি সাহেবের কাছ থেকে আমরা দ্রুত চলে এলাম। এসে দেখি গোলাগুলির শব্দ শুনে আমাদের যোদ্ধারা অনেকেই শহরের দিকে এগিয়ে গেছেন। আমরাও দৌড়ে কাচারিপাড়ায় জামতলা বাঁধের কাছে এসে দেখি, সবাই এখানে এসে বকুল ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। আর্মিরা পুলিশ লাইন আক্রমণ করে বৃষ্টির মতো গুলি করে যাচ্ছে। এ ধরনের গোলাগুলির শব্দ জীবনে এই প্রথম শুনছি। বকুল ভাই সবাইকে কাচারিপাড়া মাঠে একত্র করে কয়েকটি গ্রুপে ভাগ করলেন। প্রতিটি গ্রুপ কীভাবে কোন দিক থেকে আর্মিদের ওপর আক্রমণ করবে, তা সবাইকে বুঝিয়ে দিলেন। যাদের হাতে কোনো অস্ত্র নেই, তাদের বলে দিলেন, গ্রামের ভেতরে গিয়ে মানুষজনকে খবর দিতে। তারা যেন বন্দুক, ফালা, তির-ধনুক যে যা পারে, তা-ই নিয়ে এসে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। এরপর আমরা সবাই নিজেদের সুবিধামতো স্থান থেকে আর্মিদের লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে বিভিন্ন এলাকা থেকে কয়েকজন তির-ধনুক, লাঠি, ফালা নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিল। এরপর আমরা কয়েকজন বকুল ভাইয়ের সঙ্গে জামতলা থেকে এগিয়ে এসে কোর্ট এলাকায় ঢুকলাম।

জজকোর্টের পাশেই একটি আর্মির জিপ ছিল, জিপের কাছে দুজন আর্মি দাঁড়িয়ে পুলিশ লাইন লক্ষ্য করে গুলি করছিল। আমরা পেছন থেকে তাদের ওপর গুলি শুরু করলাম। ওরা দৌড়ে সামনের দিকে চলে গেল। এখান থেকে আর কোনো আর্মি দেখা যাচ্ছিল না। কোর্ট এলাকা থেকে আমরা চলে এলাম জজ সাহেবের বাড়ির পেছন দিকে। এখান থেকে বকুল ভাই জজ সাহেবের বাড়ির পাশের ড্রেনের মধ্য দিয়ে পাকা রাস্তার কাছে চলে গেলেন। মন্টুসহ আমরা কয়েকজন একটু দূরে অবস্থান নিয়ে কী করা যায়, চিন্তা করতে লাগলাম।

তখন সকাল আটটা হবে। এমন সময় দেখি, আর্মির একটি জিপ পৌরসভা ও আমজাদ সাহেবের বাড়ির মাঝখানের রাস্তা দিয়ে মেইন রোডে ওঠার জন্য আসছে। ওরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ গাড়ির ড্রাইভারকে লক্ষ্য করে বকুল ভাই গুলি করেন। জিপটি বিকট শব্দে ব্রেক ধরতে ধরতে এদিক-সেদিক করে পাশের ড্রেনে উল্টে পড়ে গেল। আর্মিরা কোনো রকমে জিপ থেকে বের হয়ে আমাদের কাউকে না দেখতে পেয়ে এলোপাতাড়ি গুলি শুরু করে দিল। কিন্তু একটু পরই আবার তারা যেদিক থেকে এসেছিল, সেদিকেই গুলি করতে করতে দৌড়ে চলে গেল।

এরপর তুমুল গোলাগুলির মধ্যেই আমরা জজ সাহেবের বাড়ি পার হয়ে পৌরসভার সামনে দিয়ে কাচারি মসজিদের সামনের ড্রেন ও বিল্ডিংয়ের পাশে গিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পেছন দিক থেকে গুলি করতে শুরু করলাম। ওদিকে জামতলা বাঁধ ও জজকোর্টের মধ্য থেকে আমাদের অন্য যোদ্ধারা গুলি করছে। আর্মিরা তাদের পেছন দিক থেকে আক্রমণ হয়েছে বুঝতে পেরে ভয় পেয়ে গেল। হঠাৎ দেখি, আর্মিদের চায়নিজ রাইফেলের গুলির আওয়াজ আর নেই। ওদিকে গুলির অভাবে পুলিশ লাইন থেকে ৩০৩ রাইফেলের গুলির আওয়াজ আগেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।

বকুল ভাই পরিস্থিতি বুঝতে পেরে খুব জোরে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে উঠলেন।

আমরা সবাই যে যেখানে ছিলাম, স্লোগানের জবাব দিতে দিতে পুলিশ লাইনের দিকে ছুটে গেলাম। পুলিশ লাইনে ঢুকেই রিদ্দিক ও শাহাদৎ হোসেন সন্টু ম্যাগাজিন রুমের তালা গুলি করে ভেঙে ফেলল। সেখান থেকে আমরা ৩০৩টি রাইফেল ও গুলি যে যার মতো নিয়ে নিলাম। আমাদের টু-টু বোর রাইফেল ও বন্দুক সঙ্গে থাকা নিরস্ত্র যোদ্ধাদের দিয়ে দিলাম। কে একজন গিয়ে জেলখানার তালা গুলি করে ভেঙে ফেলল। বন্দীরা সব বের হয়ে গেল। পুলিশের আরআই দৌড়ে এসে বকুল ভাইকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘আমাদের গুলি ফুরিয়ে গিয়েছিল। মালখানা থেকে গুলি আনার কোনো অবস্থা ছিল না। আপনারা আর্মিদের ওপর আক্রমণ না করলে আমাদের ওরা বাঁচতে দিত না।’ এদিকে সকাল থেকেই পাবনার বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার মানুষ বন্দুক, রাইফেল, তির-ধনুক, লাঠি, ফালা-সড়কি নিয়ে শহরে জমায়েত হতে শুরু করে। ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে পাবনা শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠল। পুলিশ লাইনের এই যুদ্ধে তির-ধনুক নিয়ে পাকিস্তান আর্মির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে এসে আমাদের একজন বীর যোদ্ধা শহীদ হলো।

আমাদের আক্রমণে পাকিস্তান আর্মিরা পুলিশ লাইন থেকে পালিয়ে এসে তাড়াশ বিল্ডিংয়ের পেছনে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অবস্থান নিয়েছে। সকাল ৯টার দিকে আমরাও পুলিশ লাইন থেকে চলে এলাম টেলিফোন এক্সচেঞ্জে। এবার আমাদের সবার হাতেই ৩০৩ রাইফেল। আক্রমণের জন্য যার যার সুবিধামতো অবস্থান নিলাম। আর্মিরা অবিরাম এদিক-সেদিক তুমুল গুলিবর্ষণ করে যাচ্ছে। আমরাও যে যেখান থেকে পারছি, ওদের লক্ষ্য করে গুলি করে চলেছি। আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে পাবনার আপামর মানুষ।

আমি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলাম বাণী সিনেমা হলের সামনের দিকে নির্মাণাধীন দোকানগুলোর পাশে। কিন্তু এখান থেকে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে থাকা আর্মিকে ঠিকমতো দেখা যাচ্ছিল না। দুপুর ১২টার দিকে আমার সঙ্গে থাকা কয়েকজনকে নিয়ে বাণী সিনেমা হলের সামনে থেকে হামিদ রোড দিয়ে চলে এলাম তাড়াশ বিল্ডিংয়ে। দেখলাম, এদিকে আমাদের অন্য কোনো যোদ্ধা নেই। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের ঠিক সামনে, তাড়াশ বিল্ডিংয়ের দোতলার পেছন দিকে একটি বাথরুমের ভেন্টিলেটর দিয়ে গুলি করার জন্য আর্মিদের দেখার চেষ্টা করছি। ভেন্টিলেটরটি বেশ বড় এবং তাতে কোনো শেড নেই। প্রথমে আমি মাথা বের করে আর্মিদের দেখার চেষ্টা করলাম, কিন্তু তাদের দেখা গেল না। আমার সঙ্গে থাকা সবাই একে একে দেখার চেষ্টা করল, কিন্তু দেখা গেল না। ইতিমধ্যে এক বৃদ্ধ, হাতে তাঁর দোনলা বন্দুক আর চারটি গুলি, ছুটে এসে বললেন, ‘আর্মি দেখা যায় না?’ আমরা বললাম, ‘না।’ তিনি দৌড়ে গিয়ে ওই ভেন্টিলেটর দিয়ে যেই মাথা বের করেছেন, সঙ্গে সঙ্গে একটি বুলেট এসে তাঁর কপালে লেগে মাথার প্রায় অর্ধেক উড়ে গেল। তিনি মুহূর্তে বাথরুমের মধ্যে আমাদের সামনেই পড়ে গেলেন। ওনার রক্ত ও মাথার মগজের কিছু অংশ এসে লাগল আমাদের জামাকাপড়ে। চোখের সামনে এ ধরনের দৃশ্য জীবনে প্রথম দেখে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম। কেমন যেন শোঁ শোঁ শব্দ করে রক্ত বের হচ্ছে, তাঁর সারা শরীর ও বাথরুমের মেঝে রক্তে ভিজে গেল। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য। আমরা হাঁ করে তাকিয়ে এ ভয়ংকর দৃশ্য দেখছি। ওই বেচারা না এলে একটু পরই আমরা কেউ আবার আর্মি দেখার চেষ্টা করতাম, আমাদের কারও অবস্থা এ রকম হতে পারত। আমি তাঁর রক্তমাখা বন্দুকটি নিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এলাম। এরপর তাড়াশ বিল্ডিং থেকে বের হয়ে টাউন হলের পাশের রাস্তা দিয়ে চলে গেলাম বনমালী ইনস্টিটিউটের পেছন দিকে।

বকুল ভাই একটি গ্রুপ নিয়ে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের অপর প্রান্তে অবস্থান নিয়েছেন। অনেকেই অবস্থান নিয়েছে বাণী সিনেমা হলের ছাদের ওপর। এক গ্রুপ অবস্থান নিয়েছে হোসেন খাঁর বাড়ির ছাদে। আমাদের যোদ্ধারা সবাই যে যেদিক থেকে পারছে, সেখান থেকেই পাকিস্তানি আর্মিদের লক্ষ্য করে তুমুল গুলি করে যাচ্ছে। যোদ্ধাদের গুলিতে ইতিমধ্যে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে থাকা কিছু আর্মি মারা গেছে। আগের চাইতে এখন আর্মিদের গুলিবর্ষণের শব্দ একটু কম মনে হচ্ছে।

এক্সচেঞ্জের বারান্দায় এলএমজি নিয়ে অবস্থানে ছিল এক আর্মি। তার এলএমজির ব্যারেল বারান্দা থেকে কিছুটা বাইরে বের হয়ে ছিল। তখন প্রায় বেলা দেড়টা। আমরা যেখানে অবস্থান নিয়েছি, সেখান থেকে ওই বারান্দা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু আর্মিকে দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ দেখি, বকুল ভাই মাটিতে শুয়ে ক্রল করে বারান্দা ঘেঁষে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। সে এক ভয়ংকর ব্যাপার, মরার ভয় যেন তাঁর নেই। ঠিক কাছাকাছি পৌঁছেই এলএমজির ব্যারেল ধরে এমন জোরে এক টান মেরেছেন, আর্মির হাত থেকে ছুটে এলএমজিটা বকুল ভাইয়ের হাতে চলে এল। আর্মিটি লাফিয়ে উঠে দৌড়ে বিল্ডিংয়ের ভেতর ঢুকে গেল। বকুল ভাই মুহূর্তে তড়িৎ গতিতে পিছিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে গেলেন। তারপর চাকিবাড়ির ছাদে উঠে আর্মিদের ওপর গুলি চালাতে শুরু করলেন ওদের এলএমজি দিয়ে। যারা বিষয়টি লক্ষ করেছে, তারা সবাই আনন্দে চিৎকার করে স্লোগান দিতে শুরু করে দিল। চারদিকে হাজার হাজার মানুষের গগনবিদারী স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে উঠেছে আশপাশের এলাকা। সার্বিক অবস্থা দেখে আর্মিরা ভয় পেয়ে গেল। তাদের গুলির শব্দ কিছুক্ষণের মধ্যে স্তিমিত হয়ে এল। যে কজন বেঁচে ছিল, তারা দুই হাত তুলে সারেন্ডার করে টেলিফোন এক্সচেঞ্জের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে গেল।

আমরা দৌড়ে গিয়ে ওদের অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি নিয়ে নিলাম। বকুল ভাইয়ের হাতে এলএমজি; ইকবাল ভাই, আবদুর রাজ্জাক রিদ্দিক, আবদুর রাজ্জাক মুকুল, রহিম ভাই ও আমি একটি করে টমি গান; বেবী ইসলাম, ইসমত, আহম্মদ করিম, সেলিম ভাই ও ফজলুল হক মন্টু একটি করে চায়নিজ রাইফেল আর হাবুল ভাই একটি এলএমজি পেলেন। অর্থাৎ, কাছাকাছি যারা ছিল, তাদের সবাই যে যার মতো অস্ত্র, গুলি, হ্যান্ড গ্রেনেড, হ্যাভারস্যাক, হেলমেট—সব নিয়ে নিলাম। আর্মিদের ওয়্যারলেস সেটটি নিয়ে পরে ডিসি সাহেবকে দেওয়া হয়েছিল।

যখন আমরা আর্মিদের অস্ত্রশস্ত্র ও গুলি সংগ্রহে ব্যস্ত, তখন মুক্তিপাগল বহু মানুষ এদিকে এসে লাঠি, ফালা, তলোয়ার দিয়ে আক্রমণ শুরু করলেন হাত তুলে দাঁড়িয়ে থাকা আর্মিদের ওপর। মুহূর্তেই টুকরা টুকরা হয়ে গেল ওদের দেহ। কেউ হাত কেটে ফালার সঙ্গে গেঁথে নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ পা কেটে, কান কেটে নিয়ে যাচ্ছেন, কেউ ওদের ব্যাজ খুলে নিচ্ছেন, যে যা মনে করছেন পাগলের মতো তা-ই করছেন। দীর্ঘদিনের জমে থাকা আগুন যেন একবারে জ্বলে উঠেছে। প্রায় এক প্লাটুন, অর্থাৎ ৩৩ জন পাকিস্তানি আর্মি নিহত হলো পাবনা টেলিফোন এক্সচেঞ্জের যুদ্ধে।

এক দিন পর আবদুর রাজ্জাক রিদ্দিক, ফজলুল হক মন্টু, মো. রেজাউল করিম রেজাসহ কয়েকজনের উদ্যোগে আর্মিদের লাশ তাড়াশ বিল্ডিংয়ের পেছনের বেলগাছের পাশের গর্তে মাটিচাপা দেওয়া হয়েছিল।

২৮ মার্চ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর পতনের একটু পরই একটি হেলিকপ্টার এসে শহরের ওপর দিয়ে উড়তে থাকে। অল্প কিছুক্ষণ পর হেলিকপ্টারটি ফিরে যায়। আমরা চলে এলাম ইকবাল হোসেনের বাড়িতে। বিভিন্ন স্থান থেকে যোদ্ধারা একে একে এখানে এসে জমায়েত হতে থাকে।

টেলিফোন এক্সচেঞ্জে যখন যুদ্ধ চলছিল, তখন বিসিক এলাকায় অবস্থানরত পাকিস্তানি আর্মিদের পাবনার হাজার হাজার মানুষ বন্দুক, তির-ধনুক, লাঠি, ফালা নিয়ে ঘেরাও করে ফেলেন। আর্মিরা এলোপাতাড়ি তুমুল গোলাগুলি করে যাচ্ছে। একটি জিপে আটজন আর্মি টেলিফোন এক্সচেঞ্জের যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য বিসিক থেকে গুলি করতে করতে বের হয়ে আসে। জনগণ ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলেও বন্দুক ও টু-টু বোর রাইফেল নিয়ে যাঁরা অপেক্ষা করছিলেন, তাঁরা জিপে বসা আর্মিদের ওপর আক্রমণ শুরু করেন। তাঁদের মধ্যে সার্কিট হাউসের রান্নাঘরের পাশে ছিলেন আল্লারাখা খান, শাহাদৎ হোসেন সন্টু, সাধুপাড়ার বাবলু এবং অভিযান ক্লাবের পাশে ছিলেন আবুল কালাম আজাদ বাবু, ইসরাইল হোসেন মেছের, আবদুল মতিন খান রাজ্জাকসহ আরও অনেকে। তাঁদের আক্রমণে কিছুক্ষণের মধ্যেই ওই আট আর্মি নিহত হয়।

শহরের যুদ্ধে আর্মিদের করুণ পরিণতি বুঝতে পেরে পাকিস্তানি বাহিনীর ভ্রাম্যমাণ সেনারা ভয় পেয়ে যায়। তারা শহরে ফিরে না এসে শহরতলির দিকে পালানোর চেষ্টা করে। অন্যদিকে শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হওয়ার খবর পেয়ে গ্রামগঞ্জের লোকজন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত হয়ে শহরের দিকে ছুটতে থাকেন। পথে বিক্ষিপ্তভাবে ওই আর্মিদের সামনে পেয়ে তাঁরা আক্রমণ শুরু করেন এবং বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এভাবে আরও আট আর্মি ময়লাগাড়ির (বর্তমান বাস টার্মিনাল) কাছে যখন পৌঁছায়, তখন তারা মোজাহিদ ক্লাব, মহেন্দ্রপুর, ফকিরপুরঘাট, শালগাড়িয়াসহ আশপাশের এলাকার জনসাধারণের আক্রমণের মুখে পড়ে। বর্তমানে হোমিওপ্যাথিক কলেজের কাছে এবং আশপাশের বিভিন্ন স্থানে সারা রাত যুদ্ধ চলে। আট আর্মিই নিহত হয়। এ যুদ্ধে আমাদের শামসুল আলম বুলবুল, আবুল মহসিন বেগ মুকু, ডা. আমিরুল ইসলামসহ পাঁচজন শহীদ হন।

শহর থেকে কয়েকজন আর্মি পালিয়ে বিসিকের দিকে যাওয়ার সময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের পাশে কাঠের সাঁকো নামের স্থানে জনগণের আক্রমণে নিহত হয়। টেলিফোন এক্সচেঞ্জের পেছনে নদীর ওপারে তিনজন আর্মি নিহত হয়। বালিয়া হালট এলাকায় এক আর্মি এবং ওখান থেকে কিছু দূরে গিয়ে আরেকজন নিহত হয়। লাশকাটা ঘরের (বর্তমান পুলিশ মাঠের পেছনে) কাছে আরও একজন আর্মি নিহত হয়। বিক্ষিপ্তভাবে শহরের বিভিন্ন স্থানে এ রকম আরও ১০-১৫ জন পাকিস্তানি আর্মি জনগণের আক্রমণে নিহত হয়। পাবনা শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর পতনের খবর পুরো জেলায় ছড়িয়ে পড়ে। সর্বস্তরের মানুষ ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে আনন্দ-উল্লাস করতে থাকে। গ্রামগঞ্জ থেকে এবং শহরের বিভিন্ন বাড়ি থেকে রুটি, খিচুড়িসহ যে যা আয়োজন করতে পেরেছেন, তা নিয়ে এসেই যোদ্ধাদের খেতে দিচ্ছেন। আমরা সবাই বিসিকে অবস্থানরত পাকিস্তানি বাহিনীর ওপর আক্রমণের জন্য ইকবাল ভাইদের বাড়িতে একত্র হতে থাকি। কিন্তু ইতিমধ্যে তারা বিসিক ছেড়ে পালিয়ে যায়।

পাকিস্তানি বাহিনীর এক কোম্পানি, অর্থাৎ তিন প্লাটুন সেনার মধ্যে এক প্লাটুন সেনা বিসিকে অবস্থান করছিল। আরেক প্লাটুন সেনা পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছিল এবং টেলিফোন এক্সচেঞ্জে আশ্রয় নিয়েছিল। বাকি এক প্লাটুন সেনা তিনটি জিপ নিয়ে শহর ও শহরতলির বিভিন্ন এলাকায় মানুষ হত্যার অভিযান চালাচ্ছিল। পুলিশ লাইন থেকে পিছু হটে যেসব আর্মি আশ্রয় নেয় টেলিফোন এক্সচেঞ্জে, তাদের সবাই নিহত হয়। বিভিন্ন এলাকায় যে আর্মিরা আক্রমণ করছিল, তার মধ্যে কিছু আহত ও সুস্থ অবস্থায় বিসিকে ফিরে যেতে পারলেও জনসাধারণের আক্রমণে বেশির ভাগ আর্মি শহরের আশপাশের বিভিন্ন স্থানে নিহত হয়।

পাবনায় সশস্ত্র গণবিদ্রোহ এবং পাকিস্তানি বাহিনীর চরম দুরবস্থার খবর ওয়্যারলেস মারফত পৌঁছে যায় রাজশাহীতে ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল শাফকাতের কাছে। ২৮ মার্চ সকালে রাজশাহী থেকে মেজর আসলামকে পাঠানো হয় পাবনায়। তাঁদের সঙ্গে ছিল একটি রিকোয়েললেস রাইফেল, একটি মেশিনগান, অন্য অস্ত্রশস্ত্রসহ ১৮ জন সেনা। তাকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল পাবনার অবশিষ্ট সেনাদের উদ্ধার করে রাজশাহীতে নিয়ে আসার জন্য। মেজর আসলাম মেন্টাল হাসপাতালের রাস্তা দিয়ে বিসিকে পৌঁছায় বেলা দুইটায়। বিসিক এলাকা তখন হাজার হাজার মানুষ ঘিরে রেখেছিল। দূর থেকে মানুষজনের ওপর রিকোয়েললেস রাইফেল দিয়ে শেলিং করতে থাকে আর্মিরা। ইতিমধ্যে একটি ফাইটার প্লেন এসে জনসাধারণের ওপর মেশিনগানের ব্রাশফায়ার করতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যে বিসিক এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে যায়। সুযোগ বুঝে দুটি আর্মি ভ্যান ও মেজর আসলামের একটি পিকআপ ভ্যান বিসিকে থাকা এক প্লাটুনের কিছু বেশি, অর্থাৎ ৩০-৪০ জন সেনা রাজশাহীর উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। যাওয়ার আগে আর্মিরা বাংলাদেশের একটি পতাকা পিকআপ ভ্যানের সঙ্গে লাগিয়ে নেয়। তারা ভেবেছিল, দূর থেকে জনগণ পতাকা দেখে মনে করবে ইপিআরের দল আসছে, তাহলে কেউ তাদের ওপর আক্রমণ করবে না।

পাবনা শহরের পাকা রাস্তা দিয়ে রাজশাহী যাওয়ার সাহস পায়নি হানাদার বাহিনী। তারা শহরের উল্টো দিকের গ্রামগঞ্জের কাঁচা রাস্তা দিয়ে মুলাডুলি হয়ে রাজশাহী যাওয়ার পরিকল্পনা করে। দিগ্‌বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে তারা ভুল করেই হোক আর ম্যাপ দেখেই হোক, সোজা রাস্তায় না গিয়ে গ্রামের অত্যন্ত দুর্গম পথ দিয়ে যাত্রা শুরু করে। মেন্টাল হাসপাতালের পাশ দিয়ে বুধের হাটের রাস্তা ধরে চলে যায় সানিকদিয়ার চরে। সেখান থেকে শাহাদিয়ার চর পার হয়ে দুর্গম পথ দিয়ে সাহাপুর ইউনিয়নের মাধপুর এসে আর্মিরা পৌঁছায় বেলা তিনটায়।

এদিকে শহরে পাকিস্তানি বাহিনীর করুণ পরিণামের খবর সারা জেলায় ছড়িয়ে পড়ায় মাধপুর তিন মাথায় বড় বটগাছের কাছে আগে থেকেই হাজার হাজার মানুষ লাঠি, ফালা, তির-ধনুক, বন্দুক নিয়ে জমায়েত হয়ে অপেক্ষা করছিলেন। আর্মির ট্রাক দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়েন মুক্তিপাগল মানুষ। তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ট্রাক থেকে এলএমজির বেপরোয়া গুলি চালানো হয় জনসাধারণের ওপর। ট্রাক থেকে নেমে কিছু আর্মি এলাকার সব বাড়িঘরে আগুন জ্বালাতে থাকে। ওই গ্রামের সাধারণ লোকজন যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই এলাকা ছেড়ে চলে যাওয়ায় তারা প্রাণে রক্ষা পায়। গভীর রাত পর্যন্ত যুদ্ধ চলার পর অনেক যোদ্ধা শহীদ হন, বহু ঘরবাড়ি আগুনে পুড়ে শেষ হয়ে যায়। আর্মিরা গোলাগুলি করতে করতে সেখান থেকে পথ ভুলে এদিক-সেদিক ঘুরে দাশুরিয়া তেঁতুলতলার দিকে যেতে থাকে। তখনো পেছনে বহু মানুষ তাদের আক্রমণ করার জন্য দৌড়াচ্ছে। ওদিকে পাকশী, ঈশ্বরদী, মুলাডুলি থেকে হাজার হাজার মানুষ প্রস্তুত অবস্থায় দাশুরিয়া তেঁতুলতলায় জমায়েত হতে থাকে। কারণ, সবাই জানে, এদিক দিয়ে পালানো ছাড়া আর্মির আর কোনো পথ নেই।

২৯ মার্চ সকালের দিকে দাশুরিয়ায় আর্মি পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে যায় জনগণের আক্রমণ। চারদিকের ভয়ংকর অবস্থা দেখে আর্মিদের একটি ট্রাক দাশুরিয়ার তেঁতুলতলায় একটি গাছের সঙ্গে অ্যাকসিডেন্ট করে, আরেকটি ট্রাকও কিছু দূর গিয়ে থেমে যায়। সেনারা ট্রাক থেকে নেমে ছত্রভঙ্গ হয়ে এলোপাতাড়ি গুলি করতে করতে জীবন বাঁচানোর জন্য যে যেদিকে পারে, ছুটতে থাকে। জনগণ ট্রাক দুটিতে আগুন জ্বালিয়ে দেন। মেজর আসলামের পিকআপ ভ্যান মুলাডুলিতে জনগণের আক্রমণের শিকার হয়। তাতে থাকা সেনারা বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। এদের সঙ্গে শুরু হয় খণ্ডযুদ্ধ। পাকিস্তানি সেনারা একে একে নিহত হতে থাকে। কিছু আর্মি একটা আখখেতের মধ্যে আশ্রয় নিলে জনগণ তাতে আগুন ধরিয়ে দেন। ৩০ মার্চ কিছু আর্মি গোপালপুরের বামনদহে মারা যায়। ৩১ মার্চ কিছু আর্মি মারা যায় ঈশ্বরদী এয়ারপোর্টে।

এভাবেই আর্মিরা ছত্রভঙ্গ হয়ে বিভিন্ন স্থানে মেজর আসলামসহ একের পর এক ঈশ্বরদীর বিপ্লবী জনগণের আক্রমণে নিহত হয়। কোনো আর্মিই আর রাজশাহীতে ফিরে যেতে পারেনি। যুদ্ধে এ অঞ্চলের বহু ঘরবাড়ি আর্মিরা জ্বালিয়ে দেয়, বহু মানুষ শহীদ হন।

পাবনা শহর থেকে প্রথম রফিকুল ইসলাম বকুলের নেতৃত্বে পাকিস্তানি বাহিনীকে নির্মূল করার সশস্ত্র যুদ্ধ যখন শুরু হয়েছিল, তখন পাবনার সর্বস্তরের মানুষও তাদের লাইসেন্স করা বন্দুক, টু-টু বোর রাইফেল, বিভিন্ন দেশি অস্ত্র, যথা লাঠি, ফালা, তির-ধনুক নিয়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। মোট ১৭টি খণ্ডযুদ্ধে পাবনা জেলায় পাঠানো পাকিস্তানি বাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ১৩০ জন এবং মেজর আসলামের গ্রুপের ১৮ জনসহ হানাদার বাহিনীর মোট প্রায় ১৫০ জনের সবাই নিহত হয়েছিল। এভাবেই ১৩ দিনের জন্য শত্রুমুক্ত হয়েছিল পাবনা। জনযুদ্ধের অগ্নিশিখা যে কত ভয়ংকরভাবে জ্বলতে পারে, তার জ্বলন্ত প্রমাণ পাবনার বিপ্লবী জনগণ।

মো. জহুরুল ইসলাম: জন্ম ৮ মার্চ ১৯৫১, পাবনা। ৭ নম্বর সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধা। ১৯৭১ সালে ছাত্র (বিএ) ছিলেন। বর্তমানে ব্যবসায়ী। পাবনা শহরে (দিলালপুর) বসবাস করেন। রচিত গ্রন্থ ‘পাবনা জেলার মুক্তিযুদ্ধের কথা’, ‘পাবনা ইন দ্য ওয়ার অব লিবারেশন’।

সূত্র: সম্মুখযুদ্ধ ১৯৭১, মুক্তিযোদ্ধাদের কলমে, প্রথমা প্রকাশন ২০২০, পৃষ্ঠা ৩১-৪৬