Thank you for trying Sticky AMP!!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি সংরক্ষণ প্রকল্পেও ঢিলেমি

তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের আড়াই বছর শেষ। ২০ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি সংরক্ষণের পরিকল্পনা থাকলেও হয়েছে মাত্র ৪৩টির।

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণের তিন বছর মেয়াদি একটি প্রকল্পের প্রায় আড়াই বছর পেরিয়েছে। এ সময়ে মাত্র ৪৩ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি সংরক্ষণের কাজ শেষ করতে পেরেছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এর বাইরে ১১৪টির কাজ এগিয়েছে। যদিও প্রকল্পটির আওতায় ২০ হাজার জন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি সংরক্ষণের কথা।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কাজ আগাতে না পেরে এখন প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। প্রকল্পের ভৌত কাজ বাস্তবায়নকারী সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তর বলছে, নির্ধারিত মেয়াদ, অর্থাৎ আগামী জুনের মধ্যে তারা ৩ হাজার ১০৮টি সমাধি সংরক্ষণ করতে পারবে। এর মধ্যে ১ হাজার ৫৮৬টি সমাধি সংরক্ষণের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।

মুক্তিযুদ্ধকালে শহীদ ও পরে মারা যাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণের জন্য ৪৬১ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের মেয়াদ শুরু ২০১৮ সালের জুনে (প্রথম পর্যায়)। যদিও প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) ২০১৮ সালের অক্টোবরে অনুমোদন পায়। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা জাগ্রত করতে সেই সময়কার ঘটনা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে তুলে ধরার জন্য বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণ করাই প্রকল্পের উদ্দেশ্য।

প্রকল্পের শুরুতে কিছুটা ধীর গতি ছিল। এখন আর বিলম্ব হবে না। সমাধি চিহ্নিত করা ও স্থান নিয়ে যে জটিলতা ছিল, তা নিরসন হচ্ছে
আ ক ম মোজাম্মেল হক, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, প্রকল্পের আওতায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থলের নকশা হবে ধর্মভেদে ভিন্ন। তবে প্রতিটি সমাধির স্মৃতিফলক বা এপিটাফে বীর মুক্তিযোদ্ধার নাম, জন্ম, মৃত্যুর তারিখ, খেতাব (যদি থাকে) ইত্যাদি তথ্য থাকবে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে তাঁর বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার সংক্ষিপ্ত বিবরণও উল্লেখ করা হবে। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি সংরক্ষণ ও ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২ লাখ ১২ হাজার টাকা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রকল্পে এত দেরি হওয়ার কারণ মোটা দাগে দুটি। প্রথমত, এত দিন প্রকল্পটি তেমন একটা জোর পায়নি। বারবার প্রকল্প পরিচালক বদলানো হয়েছে। দ্বিতীয় কারণ, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল প্রমাণসহ চিহ্নিত করার জটিলতা ও স্থান সংকুলান।

এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, প্রকল্পের শুরুতে কিছুটা ধীর গতি ছিল। এখন আর বিলম্ব হবে না। সমাধি চিহ্নিত করা ও স্থান নিয়ে যে জটিলতা ছিল, তা নিরসন হচ্ছে।

দায় নেয় না কেউ

বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণের প্রকল্পটি জোর পায় মূলত গত মাস, অর্থাৎ নভেম্বরে। এর আগে বারবার পরিচালক বদলেছে। স্বল্প সময় দায়িত্বে থাকা পরিচালকেরা বিলম্বের দায় নিতে রাজি নন। বর্তমানে প্রকল্পটির পরিচালক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ফয়সাল আহমেদ চার মাস ধরে দায়িত্বে রয়েছেন। বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যিনি আগে দায়িত্বে ছিলেন, তিনিই এ বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। তবে আমি দ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের চেষ্টা করব।’

ফয়সাল আহমেদের আগে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সৈয়দ শাহজাহান আহমেদ। বর্তমানে মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন শাখায় থাকা এই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, তিনি মাত্র এক মাস সেখানে ছিলেন।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বারবার পরিচালক বদলানোর কারণে প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে কারও আগ্রহ ছিল না।

এভাবে দুই বছরের বেশি সময় কাটার পর গত ২৯ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটি নিয়ে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এতে সভাপতিত্ব করেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী। কার্যবিবরণী অনুযায়ী, বৈঠকে পরের এক দিন, অর্থাৎ ৩০ নভেম্বরের মধ্যে কমপক্ষে ৫ হাজার সমাধিস্থল সংরক্ষণের অবকাঠামো নির্মাণের দরপত্র আহ্বানের নির্দেশ দেওয়া হয়। অবশ্য তা হয়নি। বৈঠকে এ কাজে সহযোগিতার অনুরোধ জানিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) চিঠি দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়, যাতে তাঁরা সমাধি শনাক্ত ও নির্মাণের কাজটি তদারকি করেন। প্রকল্পের জনবলও দ্রুত নিয়োগ করতে বলা হয়।

প্রকল্পের মেয়াদের শেষ দিকে এসে তৎপর গণপূর্ত অধিদপ্তরও। গত সোমবার অধিদপ্তরে গিয়ে জানা যায়, সংস্থাটি গত ১ নভেম্বর তাদের সব জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়েছে। এতে বলা হয়, যেসব সমাধি প্রমাণসহ চিহ্নিত, সেগুলোর সংরক্ষণের ভৌত অবকাঠামো নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করতে হবে। বাকিগুলোর বিষয়ে পরে বিবেচনা করা হবে। গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী কাজী মো. ফিরোজ হাসান প্রথম আলোকে বলেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দরপত্র আহ্বানে ব্যর্থ হলে দায় নিতে হবে নির্বাহী প্রকৌশলীদের।

সমাধি চিহ্নিত করতে জটিলতা

নির্ধারিত তালিকা অনুযায়ী সমাধি চিহ্নিত করার কাজটি করে বীর মুক্তিযোদ্ধা ও ইউএনওদের নিয়ে গঠিত কমিটি। তবে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের মতামতও নেওয়া হয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সমাধি চিহ্নিত করা কঠিন কাজ। অনেক ক্ষেত্রে একনেকে অনুমোদিত তালিকা ধরে বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি পাওয়া যাচ্ছে না। যেমন গত ৩০ সেপ্টেম্বর রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ থেকে চিঠি দিয়ে জানানো হয়, তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করেছে। বেশির ভাগ পরিবার জানিয়েছে, নির্ধারিত জায়গায় সমাধি নেই। পরিবারগুলো তাদের দেখানো স্থানে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের অনুরোধ জানিয়েছে।

ফেনীর গণপূর্ত বিভাগ জানায়, মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জেলায় ৫২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকা পাঠানো হয়। তবে স্থানীয়ভাবে ৩১ জনের সমাধির সন্ধান পাওয়া গেছে। এসব সমাধি সংরক্ষণের কাজ শেষের পথে।

ফেনীতে ১৪ জনের সমাধি সংরক্ষণের কাজ পাওয়া ঠিকাদার মো. ইব্রাহিম বলেন, ১২টির ভৌত কাঠামো নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। দুটি সমাধি ভারতীয় সীমান্তের কাছে। এ দুটির কাজ অর্ধেক হওয়ার পর ভারতী সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বাধা দেয়। ফলে কাজ বন্ধ রয়েছে। তিনি আরও দাবি করেন, কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে থাকলেও কোনো বিল দেওয়া হয়নি। এদিকে মন্ত্রণালয় থেকে অর্থছাড় না করায় বিল পরিশোধ সম্ভব হয়নি বলে দাবি করেন ফেনী গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী শা’দ মোহাম্মদ।

জামালপুরে গত এপ্রিল থেকে পাঁচজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সমাধি চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান জেলার গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মোবারক হোসেন। তিনি বলেন, তিনটি সমাধি সংরক্ষণের কাজ শেষ। দুটি প্রক্রিয়াধীন।

জামালপুরের ইসলামপুর পৌর কবরস্থানে গিয়ে দেখা যায়, শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মতিউর রহমানের কবরটি সংরক্ষণের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়নি। কবরস্থানের পাহারাদার মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, করোনা সংক্রমণ শুরুর আগে (গত মার্চে) কাজটি শুরু হয়। কিছু কাজ বাকি। যদিও তা শেষ করতে সাম্প্রতিক কেউ যাননি।

এদিকে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বীর বিক্রম খেতাব পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নানের কবরের সন্ধান পাওয়া গেছে চট্টগ্রামের রাউজানের গহিন অরণ্যে। তাঁর বাড়ি ছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায়। শহীদ আবদুল মান্নান স্মৃতি বাস্তবায়ন পরিষদকে তাঁর কবর স্থানান্তরের অনুমতি দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়।

‘এটা আন্তরিকতার অভাব’

২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার বধ্যভূমি ও গণকবর চিহ্নিত করা, শহীদদের নাম-পরিচয় সংগ্রহ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করার অঙ্গীকার করা হয়েছিল। এই অঙ্গীকার পরের দুটি সংসদ নির্বাচনের সময়ও দলটির পক্ষ থেকে রাখা হয়। এর অংশ হিসেবে বধ্যভূমি ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধিস্থল সংরক্ষণের প্রকল্প নেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। ২৮১টি বধ্যভূমি সংরক্ষণে আড়াই বছর আগে প্রকল্প নেওয়া হয়। যদিও ২৬৫টির কাজই শুরু হয়নি।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সমাধি সংরক্ষণের উদ্যোগটি ভালো। তবে মন্ত্রণালয় একদিকে প্রকল্প নিয়েছে দেরিতে, অন্যদিকে সময়মতো বাস্তবায়নও করছে না। এর জন্য দায়ী আমলাদের আন্তরিকতার অভাব।