Thank you for trying Sticky AMP!!

মিঠাপুকুরিয়ার প্রতিরোধযুদ্ধ

১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল। এদিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করা হবে। ইপিআরের [ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ রাইফেলস-বিডিআর। বর্তমানে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি] অফিসাররা নিশ্চিতভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে ৪ উইংয়ের [বাঙালি] ইপিআর এবং আনসার ও পুলিশদের নিয়ে গড়া এই মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অত্যন্ত সুরক্ষিত যশোর সেনানিবাস দখল করা সম্ভব নয়। এ জন্য বাঙালি অফিসাররা ২৯ মার্চ ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে একটি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন, একটি ট্যাংক স্কোয়াড্রন, একটি আর্টিলারি ফিল্ড ব্যাটারি মুক্তিবাহিনীকে দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

ক্যাপ্টেন [স্বাধীনতার পরে কর্নেল] এ আর আযম চৌধুরী [বীর বিক্রম] তাঁর অধিনায়ক মেজর [স্বাধীনতার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল] আবু ওসমান চৌধুরীকে ফিল্ড আর্টিলারি ফায়ার রেঞ্জের বাইরে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণের পরামর্শ দেন।

ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী ৩ এপ্রিল ইপিআরের একটি কোম্পানি এবং পুলিশ ও আনসারদের নিয়ে গঠিত দলটিকে নিয়ে যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের মিঠাপুরুরিয়াতে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করেন। স্থানটি যশোর ক্যান্টনমেন্টের সনতলা লাইন থেকে প্রায় সাত মাইল দূরে অবস্থিত। যশোর-ঝিনাইদহ সড়কের সমান্তরালে ডান পাশে অবস্থিত ছিল একটি রেললাইন, যা যশোর-কালীগঞ্জের (মোবারকগঞ্জ) সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। সড়কের ডান পাশে রেললাইন ও পাকা সড়কের মধ্যবর্তী স্থানে একটি খেজুরবাগান ছিল। রেললাইনের দক্ষিণ পাশে একটি বড় বিলের অবস্থান।

এ অবস্থায় ক্যাপ্টেন আযম তাঁর কোম্পানিকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেন। ক্রমান্বয়ে তিনি তাঁর ডিফেন্সিভ পজিশনকে সুরক্ষিত করে তোলেন। তিনি ওই এলাকার মানচিত্র ও ভূমিব্যবস্থা পর্যবেক্ষণ করে পাকিস্তানিদের প্যাট্রল পার্টির (টহল দল) অগ্রবর্তী বাহিনী কোথায় এসে অবস্থান নিতে পারে কিংবা তাদের ফর্মিংআপ প্লেস (সেনাসমাবেশস্থল) কোথায় হতে পারে, সে সম্পর্কে কিছুটা পূর্বধারণা তৈরি করতে সক্ষম হন।

৬ এপ্রিলে ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী সুবেদার আবদুল মুকিতকে একটি সশস্ত্র প্যাট্রল পার্টিসহ বাঁ দিক থেকে যশোর সেনানিবাসের সনতলা লাইনের দিকে প্রেরণ করেন। লেবুতলা গ্রামের কাছে সড়কের ওপর এই প্যাট্রল দলের সঙ্গে পাকিস্তানিদের একটি প্যাট্রল দলের ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে ১ জন ক্যাপ্টেনসহ ১৬ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হয়। এ যুদ্ধের পর ক্যাপ্টেন নূরুল হুদা [পরে ৯ নম্বর সেক্টরের হিঙ্গলগঞ্জ সাব-সেক্টরের অধিনায়ক] ১২ এপ্রিল যুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে সর্বশেষ খবরাদি জানার জন্য ক্যাপ্টেন আযমের কাছে পৌঁছান। সেই দিনই বিকেল চারটার দিকে পাকিস্তানিদের একটি ছোট বিমান অনেক উঁচু থেকে মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের ওপর দিয়ে বারকয়েক চক্কর দেয়। এতে ক্যাপ্টেন আযম বুঝতে পারেন যে পাকিস্তানি আক্রমণ আসন্ন।

উল্লেখ্য, ইপিআরের যোদ্ধারা তখন মিত্রবাহিনীর সাহায্যের জন্য অপেক্ষমাণ ছিলেন। অন্য দিকে পাকিস্তানিরা যশোর সেনানিবাসে রিইনফোর্সমেন্টের মাধ্যমে বেশ শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তোলে। পিএএফ [পাকিস্তান এয়ার ফোর্স] ট্রান্সপোর্ট প্লেন (সি-১৩০) হেলিকপ্টার এবং পিআইয়ের বেসামরিক বিমানের মাধ্যমে ঢাকা থেকে এসব রিইনফোর্সমেন্ট সম্পন্ন হয়। তদুপরি যশোরে পাকিস্তানি সেনারা চালনা বন্দর ও বিভিন্ন নদীপথেও সেনা সংগ্রহ করে রিইনফোর্সমেন্ট সম্পন্ন করেছিল।

এ সময় রাজবাড়ী, নগরবাড়ী ঘাট ও অন্য স্থানে পাকিস্তানি সৈন্যদের নিয়ে বিমান ওঠানামা সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য ইপিআরের ওই বাহিনীর হাতে পৌঁছায়। ফলে ক্যাপ্টেন আযম তাঁর বাহিনীর কিছু সদস্যকে ওই সব এলাকায় প্রেরণ করেন। কিন্তু কার্যত তাঁর বাহিনীর পক্ষে এই সব এলাকা পুরোটা কাভার করা সম্ভব ছিল না।

ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী বুঝতে পারেন, ইপিআরের ৫ নম্বর উইংয়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ করা প্রয়োজন। ২৭ বা ২৮ মার্চে ওয়্যারলেস ৪ নম্বর উইং চুয়াডাঙ্গা থেকে যশোরের বেনাপোল এলাকার নিকটবর্তী অবস্থানে থাকা ৫ নম্বর উইংয়ের সঙ্গে মেসেজ (তথ্য) আদান-প্রদান করেছিল ক্যাডেট কলেজের শিক্ষক শফিকউল্লাহ (বীর প্রতীক। স্বাধীনতার পর লেফটেন্যান্ট কর্নেল) ও সুবেদার আবদুল মুকিতের হাতে দায়িত্ব হস্তান্তর করে ১১ এপ্রিল ১২টার দিকে ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী ইপিআরের ৫ নম্বর উইংয়ের সঙ্গে লিয়াজোঁ করার উদ্দেশ্যে যশোর-বেনাপোল কাঁচা রাস্তা ধরে অগ্রসর হন। তিনি যখন ঝিকরগাছা ব্রিজের ২০০ গজের নিকটবর্তী, সেই সময় এক গ্রামবাসী তাঁকে জানান যে নালা এলাকায় বেশ কিছু সৈন্য পজিশন নিয়ে আছে। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী বুঝতে পারেন, এরা খুব সম্ভবত পাকিস্তানি সৈন্য, যারা প্রতিপক্ষের অপেক্ষায় ওত পেতে রয়েছে। তিনি দ্রুতগতিতে জিপ চালিয়ে ঝিকরগাছা ব্রিজের পশ্চিম পাশে (বেনাপোল সাইড) পৌঁছে ইপিআরের ৫ নম্বর উইংয়ের সাক্ষাৎ পান। তাদের সঙ্গে একটি বিএসএফ ব্যাটালিয়নকেও সেখানে ডিফেন্সিভ পজিশনে দেখতে পান।

এখানকার ইপিআর সৈন্যদের নেতৃত্বদানরত সুবেদার খায়রুল বাশার এবং বিএসএফ অফিসারের (ক্যাপ্টেন) সঙ্গে ক্যাপ্টেন আযম যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। এই সময় পাকিস্তানিরা আর্টিলারি ফায়ার শুরু করে। প্রত্যুত্তরে বিএসএফের ক্যাপ্টেনও তাঁর ৩ ইঞ্চি মর্টার থেকে ফায়ার শুরু করেন। ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরীর পরামর্শে মর্টারের পজিশন পরিবর্তন করা হয়। কেননা, পাকিস্তানি সেনারা ওই পজিশন বুঝে নিয়ে গোলাবর্ষণ করতে পারত। দুই মিনিটের মধ্যেই মর্টারের পূর্ব পজিশনের ১০ গজের মধ্যে পাকিস্তানিদের গোলা এসে পড়ে। সৌভাগ্যবশত বিএসএফের মর্টার পজিশন সরিয়ে নেওয়ায় এ পক্ষে কেউ হতাহত হয়নি।

এভাবে প্রায় এক ঘণ্টা ধরে গোলাগুলি বিনিময় চলতে থাকে। অতঃপর ৫ নম্বর উইংয়ের জেসিও এবং সেনাদের উদ্দেশে ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী ব্রিফ করেন। তিনি তাঁদের পাকিস্তানি সেনাদের উদ্দেশ্যে আক্রমণ অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন এবং সর্বদাই ৪ নম্বর উইংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করতে বলেন। অতঃপর তিনি বেনাপোলে এসে ৭২ বিএসএফের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল কে বি সিংকে এবং অধিনায়ক গার্ড রেজিমেন্ট (এএস আর্মি) যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। তারপর চুয়াডাঙ্গায় ফিরে আসেন।

১২ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে আযম চৌধুরী মিঠাপুকুরিয়ার উদ্দেশে চুয়াডাঙ্গা ত্যাগ করেন। কিন্তু ঝিনাইদহের কাছে পৌঁছানোর মুহূর্তে ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহর কাছ থেকে এক মেসেজ পান যে পাকিস্তানিরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র এবং আর্টিলারিসহযোগে আক্রমণ করেছে। শফিকউল্লাহ ক্যাপ্টেন আযমের পরামর্শ চাইলে ক্যাপ্টেন আযম তাঁর উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত আরও কিছুটা সময় অবস্থান ধরে রাখার নির্দেশ দেন। তিনি আরও নির্দেশ দেন যে যদি ইপিআরদের পক্ষে অবস্থান ধরে রাখা নিতান্তই সম্ভব না হয়, তাহলে ক্যাপ্টেন শফিকউল্লাহ তাঁর বাহিনী নিয়ে যেন ঝিনাইদহ-মিঠাপুকুরিয়ার মধ্যবর্তী এলাকায় পশ্চাৎপসরণ করেন। মিঠাপুকুরিয়ায় পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ ইপিআরের যোদ্ধারা বীরবিক্রমে প্রতিহত করেন। তাতে প্রতিপক্ষের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুসজ্জিত পাকিস্তানি সেনারা ইপিআরের মিঠাপুকুরিয়ার অবস্থান পার হয়ে সামনে অগ্রসর হতে থাকে।

জয় পাকিস্তানিদের পক্ষে গেলেও এই যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল ব্যাপক। ইপিআর বাহিনীর পক্ষেও বেশ কজন আহত হয়েছিলেন এবং বেশ কিছু অস্ত্রশস্ত্র তাঁদের হারাতে হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ একটি ১০৬ মিলিমিটার মর্টার, দুটি ভারী মেশিনগান (৭.৬২ চায়নিজ) ও ৩টি এলএমজি (৩০৩) পাকিস্তানি ২৭ বালুচ রেজিমেন্টের হাতে পড়ে। [ক্যাপ্টেন এ আর আযম চৌধুরীর পাণ্ডুলিপি থেকে অনূদিত, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, নবম খণ্ড,] (ঈষৎ পরিমার্জিত)
সূত্র: বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, সেক্টরভিত্তিক ইতিহাস, সেক্টর আট, গণপ্রগাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।