Thank you for trying Sticky AMP!!

হাসির মোড়কে ব্যথা লুকোনো উইলিয়ামসন

>
নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন। কাল বিশ্বকাপ ফাইনালে হারের পর। ছবি: রয়টার্স

‘সবাই যা হতে চায় সেটাই হতে পারে আর আমার কাছে এটাই বিশ্বসংসারের সৌন্দর্য। সবারই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব সেরা হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। শুধু নিজে যা করছেন তা উপভোগ করুন।’ ম্যাচ শেষে এ কথাই বলেছেন নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক কেন উইলিয়ামসন।

জিমি নিশামের টুইট, ‘বাচ্চারা, খেলাধুলায় এসো না। কেক-বিস্কুট বানাও কিংবা অন্য কিছু করো। তাহলে ৬০ বছর বয়সে মোটাতাজা হয়ে মনে সুখ নিয়ে মরতে পারবে।’ কিউই অলরাউন্ডারের এ টুইটের পর প্রশ্ন উঠতে পারে, এটাই তাহলে কেন উইলিয়ামসনের একহারা শরীরের রহস্য?

যে কোনো অধিনায়ককেই চাপ নিতে হয়। ম্যাচে বিতর্কিত কিংবা প্রশ্ন তোলার মতো কিছু ঘটলে এগিয়ে আসতে হয় অধিনায়ককে। অর্জুনা রানাতুঙ্গা থেকে রিকি পন্টিংরা তার নজির। কিন্তু উইলিয়ামসন ঠিক কোন ঘরানার অধিনায়ক? কাল ফাইনালে দর্শকদেরই স্নায়ু ক্ষয় হতে হতে আর কিছু ছিল না। সেখানে যাঁরা মাঠে ছিলেন তাদের অবস্থাটা স্রেফ ভাবা যায় না। কিন্তু ম্যাচ শেষে উইলিয়ামসনের হাস্যোজ্জ্বল মুখ দেখে কি চাপ-টাপ কিছু বোঝা গেল?

ধারাভাষ্যকার নাসের হুসেইনই খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কিউই অধিনায়কের ভেতরে রক্তক্ষরণের স্রোতটা বোঝার চেষ্টা করলেন। উইলিয়ামসন কিছুটা বুঝতে দিয়েছেন আবার দেননি। মার্জিত আবেগ আর ভদ্রোচিত কথায় কিউই অধিনায়ক মনে করিয়ে দিলেন হাল আমলের ক্রিকেটে ভুলতে বসা কথাটা—ক্রিকেট ভদ্রলোকের খেলা। উইলিয়ামসন এখনকার ক্রিকেটে সেই বিরল ‘ভদ্রলোক’দের একজন।

যে ম্যাচে শুধু ফলটাই হারের নির্দেশক, বাকি সব গৌরবের, আর হেরে যাওয়া দলের অধিনায়ক যদি মনের ব্যথা গোপন করে অভিনন্দন জানান প্রতিপক্ষকে—তখন জয়ী দলের গৌরব ছাপিয়ে সবার হৃদয়ে জায়গা করে নেয় হেরে যাওয়া দল। কাল ফাইনালের পর থেকে নিউজিল্যান্ড নিয়ে এমন আবেগের রেণুই ভাসছে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে। বিশেষ করে উইলিয়ামসন আলাদা জায়গা করে নিয়েছেন ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে।

‘ভদ্র ও মার্জিত’ ক্রিকেটারের তকমা পেয়েছেন আগেই কিন্তু কালকের পর উইলিয়ামসনের জায়গা কোথায় তা টুইটে বুঝিয়ে দিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ক্রিকেটার ক্রিস লিন, ‘ভেবেছিলাম উইলিয়ামসনকে এর বেশি সম্মান করা সম্ভব না। কিন্তু সে নিজেকে আরেক উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কী দুর্দান্ত এক চ্যাম্পিয়ন।’ কিউই অধিনায়ক ভক্ত থেকে ক্রিকেটপ্রেমীদের মনে ঠিক কোথায়, কতটুকু উচ্চতায় আসীন হয়েছেন তা কালকের ম্যাচের কিছু দৃশ্যপট থেকে আন্দাজ করে নেওয়া যায়।

শেষ ওভারের চতুর্থ বলের দৃশ্যটা কল্পনা করুন। গাপটিলের থ্রো বেন স্টোকসের ব্যাটে লেগে চার হয়ে গেল। দৌড়েও রান নেওয়ায় চারের সঙ্গে যোগ হলো আরও ২ রান। ৩ বলে ৯ রানের সমীকরণ থেকে খেলা নেমে আসল ২ বলে ৩ রানে। ম্যাচটা ঘুরে গেল ওখানেই। ম্যাচের উত্তেজনা বিচারে এমন পরিস্থিতিতে অন্য যে কোনো অধিনায়ক স্টোকসকে অভিযুক্ত করে আম্পায়ারের সঙ্গে বাধিয়ে বসলে দোষ দেওয়ার কিছু থাকে না। আর এটা বিশ্বকাপ ফাইনাল, নিউজিল্যান্ড যা কখনোই জেতেনি।

হারের পর ধারাভাষ্যকার নাসের হুসেইনের সঙ্গে হাসিমুখে কথা বলছেন উইলিয়ামসন। ছবি: টুইটার

কিন্তু উইলিয়ামসন কী করলেন, অনেকটা নিয়মরক্ষার ভঙ্গিতেই দুই হাত উঁচিয়ে একবার আম্পায়ারের মনোযোগ কাড়ার চেষ্টা করলেন। ব্যস, এটুকুই! খেলা সুপার ওভারেও টাই হওয়ার পর বাউন্ডারি নিয়মে (বেশি বাউন্ডারি মারা দল জয়ী) হারের পরও উইলিয়ামসন কোনো প্রশ্ন তোলেননি। ওদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মটির মুণ্ডুপাত করছিলেন সাবেক থেকে বর্তমান ক্রিকেটাররা।

কিন্তু উইলিয়ামসন কোনো অভিযোগ না করে, মনের ব্যথা যতটুকু সম্ভব গোপন করে হাসিমুখে গেয়েছেন ক্রিকেটের জয়গান, ‘তাজা আবেগ, তাই (হার) হজম করা কঠিন। দুটি দলই জয় পেতে ভীষণ ভীষণ খেটেছে। তবে এটাই সত্য। শুরু থেকেই তো নিয়মটি আছে। অসাধারণ একটা ক্রিকেট ম্যাচ হলো। আশা করি সবাই উপভোগ করেছে। সত্যি বাউন্ডারি নিয়ম কী, আমি সেটাই জানি না। আমরা একটু পিছিয়ে ছিলাম। তবে ইংল্যান্ডকে প্রাপ্য অভিনন্দন দিতেই হচ্ছে। যোগ্য দল হিসেবেই তারা বিশ্বকাপ জিতেছে।’

স্টোকসের ব্যাটে বল লেগে বাউন্ডারি হওয়ার ঘটনাটি নিয়েও কথা বলেছেন উইলিয়ামসন। এ নিয়ে কিউই অধিনায়কের মন্তব্য শুনলে মনে হবে—শুধু নিউজিল্যান্ডের হার নয়, ম্যাচের অমন মুহূর্তে আর কোনো দল যেন কখনোই এসবের শিকার না হয়, সেটাই উইলিয়ামসনের প্রথম চাওয়া। মানে, যা ঘটার ঘটে গেছে সামনে যেন আর না হয়, ‘স্টোকসের ব্যাটে বল লাগাটা লজ্জার। তবে আমি আশা করি অমন মুহূর্তে এসব যেন আর না ঘটে। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এসব ঘটনাই বারবার ঘটে থাকে। এটা খেলারই অংশ। কোনো অভিযোগ করার ইচ্ছে নেই। শুধু এটুকু চাই, ম্যাচের অমন পরিস্থিতিতে এসব যেন আর কখনোই না ঘটে।’

মাঠে নাসের হুসেইনের সঙ্গে কথা শেষে সংবাদ সম্মেলনে একটি অক্রিকেটীয় প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিলেন উইলিয়ামসন। জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, সবার তাঁর মতো ভদ্র হওয়া উচিত কি না? কিউই অধিনায়কের জবাব, ‘সবাই যা হতে চায় সেটাই হতে পারে আর আমার কাছে এটাই বিশ্বসংসারের সৌন্দর্য। সবারই নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী যতটুকু সম্ভব সেরা হওয়ার চেষ্টা করা উচিত। শুধু নিজে যা করছেন তা উপভোগ করুন।’

উইলিয়ামসন এ কথা বলেই সংবাদ সম্মেলনকক্ষ ত্যাগ করেন। তখন উঠে দাঁড়িয়ে তাঁকে সম্মান দেখিয়েছেন কক্ষের সবাই। কিন্তু যা দেখা গেল না তার ব্যাখ্যা কী? উইলিয়ামসনও তো মানুষ। তিলে তিলে গড়া একটা দল ফাইনালে এভাবে হারলে অধিনায়কের কী রাগ-ক্ষোভ-অভিমান-দুঃখ কিছুই হয় না? আর হলেও তা সর্বক্ষণ হাসির মোড়কে ঢেকে রাখা যায় কীভাবে? কোনো অভিযোগ, দোষারোপ, রাগ কিংবা আবেগে ভেসে যাওয়া নয়—শুধু হাসি?

ওই হাসির মর্মার্থটুকু যদি বোঝা যেত!