Thank you for trying Sticky AMP!!

গণতন্ত্রের ক্রিকেট, ক্রিকেটের গণতন্ত্র

আনিসুল হক

ফুটবলকে বলা হয় সবচেয়ে গণতান্ত্রিক খেলা। একটা জাম্বুরা বা একটা কাপড়ের পোঁটলা দিয়েই খেলতে শুরু করা যায়। ক্রিকেট ছিল রাজার খেলা; খেলার রাজা কথাটা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ। এখন ক্রিকেট আর শুধু রাজার খেলা নেই, এটা সাধারণেরও খেলা হয়ে গেছে। যদিও কমনওয়েলথের বাইরে সারা বিশ্বে ক্রিকেটকে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগ সাফল্যের মুখ দেখেনি, তবু এটা আর রাজার খেলা নয়। এটা এখন সাধারণের খেলা। বরং রানির ছেলেদের হাতে এখনো ওঠেনি ক্রিকেট বিশ্বকাপ। ভারত (দুবার), পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাও কাপ নিয়ে গেছে ঘরে।

বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের কথা ভাবলেই তো বিস্মিত হতে হয়। কোন মাগুরা থেকে উঠে এসেছেন সাকিব আল হাসান, পৃথিবীর ১ নম্বর অলরাউন্ডার। মোস্তাফিজ এসেছেন সাতক্ষীরা থেকে, মিরাজ এসেছেন খুলনা থেকে।

গতকালের খেলাটা আমি দেখছিলাম নিউইয়র্কে বসে। মুক্তধারার বইমেলায় যোগ দেব বলে এসেছি মার্কিন মুলুকে। ভোর সাড়ে পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে খেলা দেখছি। বিমানে বসে একটা প্রামাণ্যচিত্র দেখছিলাম, বিষয় এক দিনের ক্রিকেট কী করে সাদা বল আর রঙিন জার্সির হয়ে উঠল। ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ হয়ে উঠেছিল রঙিন, আর তাতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইমরান খানের পাকিস্তান। ইমরান খানের দল শুরুতে হেরে গিয়েছিল, তারপর একটা পয়েন্ট পেয়েছিল বৃষ্টির কল্যাণে। তখন ইমরান খান দলকে বলেছিলেন, ‘আহত বাঘ মারাত্মক হয়, আমরা হলাম কর্নারড টাইগার, এবার পাল্টা আঘাত করো।’ সেবার ইমরান খান আস্থা রেখেছিলেন এক তরুণের ওপর—ইনজামাম–উল–হক।

ফুটবলে এটা আমরা অনেক দেখেছি, বস্তি থেকে উঠে আসা তৃতীয় বিশ্বের ছেলেরা মহাতারকা হয়েছেন, ক্রিকেটেও তা ঘটে চলেছে পৃথিবীর নানা প্রান্তে।

ফলে ক্রিকেটকেও এখন গণতান্ত্রিক খেলাই বলতে হচ্ছে। ক্রিকেটের আরেকটা বিষয় মজার, তা হলো, এটা কেবল দলের খেলা নয়, ব্যক্তিরও খেলা এবং ক্যাপ্টেনসির খেলা। কাজেই টসে জিতে ব্যাট না বল নিতে হবে, কোন খেলোয়াড়কে নামানো উচিত ছিল, এখন কাকে বল করতে দেওয়া উচিত হবে—এসব বিষয়ে দর্শকেরা খুবই মুখর থাকেন। প্রত্যেক দর্শকের নিজস্ব মত থাকে। প্রত্যেকেই আমরা হয়ে উঠি ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ। সাধারণ থেকে আমরা হয়ে উঠি অসাধারণ। আমরা যাঁরা আদপে ক্রিকেট-বিশেষজ্ঞ নই, বরং বিশেষভাবে অজ্ঞই যাঁদের বলা যায়, যাঁরা জীবনে হয়তো কোনো দিনও ক্রিকেট গ্লাভস হাতে নিয়েও দেখিনি, তাঁরাও বড় বড় খেলোয়াড়, ক্যাপ্টেন, কোচের ভুল ধরি। এখানে আমার বন্ধু ক্রিকেট-লেখক উৎপল শুভ্রর কথা মনে পড়ে। তিনি বলেন, খেলার পরে এ কথা বলা খুব সহজ যে আগে বল নেওয়া উচিত ছিল, ওই সময় ওই বোলারকে দিতে হতো, কিন্তু খেলার মাঠে সেটা করে দেখানো সত্যিই কঠিন। যখন দল জেতে, তখন সবাই ক্যাপ্টেনসির প্রশংসা করে। যখন দল হারে, তখন সব দুর্বলতা প্রকট হয়ে ওঠে; সমালোচনার তুবড়ি বয়ে যায়।

পৃথিবীজুড়েই শাসনব্যবস্থায় গণতন্ত্রের পরিধি ছোট হয়ে আসছে। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। আর আছে সিসিটিভি, হাতের আঙুলের ছাপ, ক্যামেরা, ট্র্যাকার—ব্যক্তিমানুষের চলাচলের স্বাধীনতাও আসলে কমে আসছে। এই সময়ে আমাদের মত জানানোর, নাগরিক অধিকার প্রয়োগের একমাত্র জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফেসবুক–টুইটার। ক্রিকেটের বেলায় সেই মতটা প্রকাশ করে আমরা দুধের সাধ কিছুটা হলেও ঘোলে মেটাতে পারছি। গণতন্ত্রে যেমন পলিটিক্যাল সায়েন্সের অধ্যাপকেরও এক ভোট, রাজার ছেলেরও এক ভোট; ফেসবুকের বুকে ক্রিকেট আলোচনায় তেমনি ওয়াসিম আকরামেরও এক লাইক, শচীন টেন্ডুলকারেরও এক লাইক, আবার আমার মতো ক্রিকেট–মূর্খেরও এক লাইক।

কাজেই গণতন্ত্রের এই ক্রিকেটীয় চর্চাকে এবং ক্রিকেটের এই গণতান্ত্রিক প্রকাশকে আমাদের স্বাগতই জানানো উচিত। শুধু মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতা মানে দায়িত্বও। আগে যখন আমরা ড্রয়িংরুমে কিংবা চায়ের দোকানে আড্ডা দিতাম, মুখের কথায় হাতি–ঘোড়া মারতাম, সেসব বাইরের জগতে ছড়িয়ে পড়ত না। কিন্তু এখন আর কিছুই ব্যক্তিগত নয়। একটা স্ট্যাটাসে যা লিখব, তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়তে পারে জগৎময়। সে ক্ষেত্রে আমরা যেন আলো ছড়াই, রাশি রাশি অন্ধকার নয়; আমরা যেন সৌরভ ছড়াই, আস্তাকুঁড়ের আবর্জনার দুর্গন্ধ নয়।

বাংলাদেশের বিশ্বকাপ শেষ হয়ে যায়নি; পাকিস্তান যদি শুরুর খেলায় এমনভাবে হেরে পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডকে হারাতে পারে, বাংলাদেশ যদি ৫৮ রানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে অলআউট হয়ে পরের ম্যাচে ইংল্যান্ডকে চট্টগ্রামে হারাতে পারে, তবে আমরা এই ২০১৯ বিশ্বকাপে ভালো করতে পারব—এই আশা ছাড়া চলবে না। ক্রিকেট আসলেই অনিশ্চয়তার খেলা। তবে ক্রিকেট সাহসীদেরও খেলা। দুর্বলচিত্তের মানুষের জন্য ক্রিকেট নয়।