Thank you for trying Sticky AMP!!

নিঃশব্দ বিমানবন্দরে এক রাত

দিল্লি বিমানবন্দর এখন এক নিঃশব্দ বিমানবন্দর। এখানে মাইক্রোফোনে ফ্লাইটের ঘোষণা দেওয়া হয় না। ছবি: সংগৃহীত

একটা কুইজ দিয়ে শুরু করা যাক। ধরুন দিল্লির ফ্লাইট ছিল সকাল ১১টা ৩০ মিনিটে। কিন্তু কোনো একটা রাজনৈতিক দলের অঙ্গ সংগঠনের সম্মেলনের কারণে রাস্তায় প্রচণ্ড যানজট। অর্ধেক রাস্তা দখল করে রেখেছে তাদের নিয়ে আসা বাস-ট্রাক। মিছিল তো আছেই। সকাল সাড়ে ৮টায় ঘর থেকে বের হয়েও বিমানবন্দরে পৌঁছাতে পোঁছাতে আপনার বেজে গেল ১২ টা। তবু আপনি সাড়ে ১১টার ফ্লাইটটা পেয়ে গেলেন। কীভাবে?

ভাবতে থাকুন। তার মধ্যে আসল গল্পটা বলে দেওয়া যাক। সেই গল্প এক নিঃশব্দ বিমানবন্দরে রাত কাটানোর গল্প। যে গল্পের শেষে উপলব্ধি-টাকার কাছে বুঝি সুখ-শান্তিও বিক্রি হয়!

আমার সৌভাগ্য যে, সাড়ে ১১টার ফ্লাইটে দিল্লির টিকিট কেটে প্রায় ১২টা নাগাদ হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছেও বিমানটা ধরতে পেরেছি। সেই বিমানে নিরাপদে দিল্লিও পৌঁছেছি। কিন্তু মিস হয়ে গেছে ইন্দোরের ফ্লাইট এবং সে সুবাদেই নিঃশব্দ বিমানবন্দরে রাত কাটানোর অভিজ্ঞতা।

দিল্লির ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরের বেশ কয়েক জায়গাতেই বড় করে লেখা, এটি নিঃশব্দ বিমানবন্দর (সাইলেন্ট এয়ারপোর্ট)। এখানে পারতপক্ষে যাত্রীদের জন্য মাইকে কোনো ঘোষণা দেওয়া হয় না। দিলেও সেটি নির্দিষ্ট ফ্লাইটের বোর্ডিং এলাকার বাইরে থেকে শোনানো হবে না, যদি না বিষয়টা অনেক বেশি জরুরি কিছু হয়। ওই এলাকা থেকে একটু দূরে থাকলে আপনি জানতেই পারবেন না বিমান কখন আপনাকে ফেলে উড়ে চলে গেছে। ফ্লাইট সংক্রান্ত তথ্যের জন্য এয়ারপোর্টের এখানে-ওখানে লাগানো মনিটরে চোখ রাখতে হবে। শুরুতে ব্যাপারটাকে ভালোই মনে হলো। বারবার মাইকের শব্দে অনেক বিমানবন্দরে বিরক্তই তো হয়েছি! এখানে তাহলে সেরকম কিছু হচ্ছে না। কিন্তু দিল্লির এই নিঃশব্দ বিমানবন্দর কানাডা থেকে আসা এক বৃদ্ধকে যেরকম বিপদে ফেলে দিল, সেটি দেখে ব্যাপারটা আর পছন্দ হলো না।

টার্মিনাল-১ এ ইন্ডিগো এয়ারলাইনসের টিকিট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ভদ্রলোক থরথর করে কাঁপছিলেন। মুখের কথা জড়িয়ে যাচ্ছিল। ৭০-৭৫ বছর বয়সী একজন মানুষ দীর্ঘ ভ্রমণক্লান্তির পর একটু বিশ্রাম না নিলে, অনেকটা সময় কিছু না খেয়ে থাকলে এবং প্রচণ্ড মানসিক চাপের মধ্য পড়লে এর চেয়ে ভালো তাঁর থাকার কথাও নয় অবশ্য।

তিনি এসেছেন কানাডা থেকে, যাবেন আহমেদাবাদ। ভদ্রলোকের একটাই ভুল ছিল, দিল্লি যে নিঃশব্দ বিমানবন্দর, সেটি তাঁর জানা ছিল না। দূরে বসেই কান খাড়া করে রেখেছিলেন ফ্লাইটের ঘোষণা শোনার জন্য। কিন্তু শব্দহীন বিমানবন্দরে সেই ঘোষণা তাঁর কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। সেখানেই বাঁধে বিপত্তি। ভদ্রলোকের আরও একটা দুর্ভাগ্য যে, তাঁর আহমেদাবাদের কানেকটিং ফ্লাইটটা ছিল ইন্ডিগো এয়ারলাইনসে। এমন বিপন্ন অবস্থায়ও তাঁকে তেমন কোনো সাহায্যই করলেন না ইন্ডিগো কর্মীরা।

আলোচনায় যখন ইন্ডিগো এসেই পড়ল, তখন নিজের কথাটা বলে নেই। কারণ বাংলাদেশ-ভারত প্রথম টেস্ট কাভার করতে ইন্দোর আসার পথে আমাকে যে একটা রাত অপ্রত্যাশিতভাবে দিল্লিতে কাটাতে হলো। বাধ্য হয়ে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের বাতাস ফুসফুসে ভরতে হলো, সেটির কারণও ওই ইন্ডিগো এয়ারলাইনস।

ইন্দিরা গান্ধী বিমানবন্দরে তিনটি টার্মিনাল। এক টার্মিনাল থেকে আরেক টার্মিনালে যাওয়ার জন্য শাটল বাস আছে, তবে সময় লেগে যায় ২০-২৫ মিনিট। তাড়াতাড়ি যেতে হলে ট্যাক্সি আছে। কিন্তু ট্রানজিট যাত্রীদের পকেটে সাধারণত ভারতীয় রুপি থাকে না বলে ট্যাক্সি ভাড়া দেওয়াটা ঝামেলার। তারা বোর্ডিং পাস দেখিয়ে বাসই ব্যবহার করেন। আমিও তিন নম্বর টার্মিনালে নেমে ইন্দোরের কানেকটিং ফ্লাইট ধরার জন্য শাটল বাসে চাপলাম। উদ্দেশ্য ১ নম্বর টার্মিনাল, ওখান থেকেই ছাড়বে ইন্দোরের বিমান।

লাগেজ-টাগেজ নিয়ে শাটল বাসে চড়াটাও মারাত্মক এক অভিজ্ঞতা। গিজগিজে যাত্রী আর ব্যাগ-পত্র মিলিয়ে পা রাখার জায়গা নেই। তার মধ্যে ‘সর্দারজি’রা আবার এই বাসগুলোকেই মনে করেন বিমান, অন্তত তাদের চালানোর ধরনে তাই মনে হয় আর কি। যেন উড়িয়ে নিয়ে যাবেন বাসটাকে! ধনুকের মতো বাঁকা টানেলেও বাসের গতি কমে না। ভারসাম্য হারিয়ে এই যাত্রী পড়ে ওই যাত্রীর গায়ে, ওই যাত্রী গিয়ে হয়তো পড়ল লাগেজের ওপর।

লুটোপুটি খাওয়া বাসযাত্রা শেষে ১ নম্বর টার্মিনালে পৌঁছে জানলাম, আমার ইন্দোরের বিমান এই মাত্র আকাশে উড়ে গেছে। যাওয়ারই কথা, ঢাকা থেকে ফ্লাইট দুই ঘণ্টা দেরিতে ছাড়ায় আমি টার্মিনালে পৌঁছার আগেই ইন্দোরের ফ্লাইটের সময় হয়ে গিয়েছিল। ইন্ডিগোর কাউন্টারে যোগাযোগ করলাম। সেখান থেকে তরুণী কর্মী জানালেন, পরের ফ্লাইট সন্ধ্যা ৭টায়। কিন্তু সেটি ছাড়বে ২ নম্বর টার্মিনাল থেকে। আমি যেন তক্ষুনি দুই নম্বর টার্মিনালে গিয়ে টিকিট কেটে ফেলি। কিন্তু বোর্ডিং পাস নেই বলে এবার তো শাটল বাসে চড়তে আমাকে ৩০ রুপি ভাড়া দিতেই হবে। সেটা কই পাব!

এক টার্মিনাল থেকে অন্য টার্মিনালে যেতে বাস ভাড়া মেটানোই অনেকের জন্য বিরাট সমস্যা। ছবি: লেখক

ডলার ভাঙাতে হলে আগে বিমানবন্দরের ভেতরে ঢুকতে হবে। বোর্ডিং পাস ছাড়া সে পর্যন্ত যাওয়া যাবে না। এক পুলিশকে বিষয়টা বলার পর তাঁর নিরুপায় চেহারা আমাকে আরও নিরুপায় করে দিল। পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন এক ভদ্রলোক। জানতে চাইলেন, কত রুপি দরকার। বললাম, ‘৩০ রুপি। বাস ভাড়াটা দিতে পারলেই হয়।’ ভদ্রলোক হাসতে হাসতে প্রথমে ৩০ রুপি, পরে কি ভেবে যেন পকেট থেকে আরও তিনটি ১০ রুপির নোট বের করে দিলেন। আমি তো অবাক! অপরিচিত একজন লোক এভাবে টাকা সাধছেন, তা ছাড়া তাঁকে এই টাকা কীভাবে শোধ করব! ভদ্রলোক বললেন, ‘আমিও একবার এ রকম বিপদে পড়েছিলাম এবং একজন আমাকেও এভাবেই সাহায্য করেছিলেন। টাকাটা রাখুন। ফেরত দিতে হবে না।’

কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে ভদ্রলোকের নাম জানতে চাইলাম। তিনি তাঁর দুই শব্দের নামটা বললেন। কিন্তু পরেরটার ধাক্কায় প্রথমটা এখন আর মনে নেই। কি এক আগারওয়াল যেন তাঁর নাম। সাকিব আল হাসানকে নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট মাত্রই একটা আগারওয়াল-ফাঁড়া পার হয়েছে। এর মধ্যে আরেক আগারওয়াল! তবে বাজিকর দীপক আগারওয়াল সাকিবকে বিপদে ফেলেছেন। আর এই আগারওয়াল আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করলেন। দুই আগারওয়ালের পার্থক্যটা নিশ্চয়ই আপনারাও ধরতে পেরেছেন।

যাই হোক, আবারও হাত, বুক আর পেটের ব্যায়াম করতে করতে শাটল বাসে ঝুলন্ত যাত্রা। কিন্তু টার্মিনাল-২ এ পৌঁছে যা শুনলাম, তাতে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমি যতই বলি, সন্ধ্যা ৭টায় ইন্দোরের একটা ফ্লাইট আছে। টিকিট কাটব। ততই ওরা বলে, সন্ধ্যা ৭টায় তো কোনো ফ্লাইট নেই। ফ্লাইট আছে ৭টা ৪৫ মিনিটে, আর সেটা ছাড়বে টার্মিনাল-১ থেকে। মনে হলো তক্ষুনি দৌড়ে ঢাকা চলে যাই। আগারওয়াল সাহেব বাড়তি ৩০ রুপি দেওয়ায় বাস ভাড়াটা না হয়ে হয়ে যাবে, কিন্তু লাগেজ নিয়ে আবার সেই শাটল বাসে ঝুলে টার্মিনাল-১ যেতে হবে! আর হাতে যে সময় ছিল তাতে বাসে চড়ে গিয়ে ফ্লাইট ধরতে পারাটাও অনিশ্চিত। ট্যাক্সি ছাড়া উপায় নেই। কিন্তু ৩০ রুপি দিয়ে তা হবে না, ট্যাক্সি ভাড়া ২৫০ রুপি।

বুদ্ধিটা তখনই মাথায় এল। পকেটে কিছু বাংলাদেশি টাকা আছে। সেটি দিয়ে যদি কাজ চালানো যায়! দেখতে শুনতে ভদ্র এক ট্যাক্সি ওয়ালাকে গিয়ে সংক্ষেপে পুরো ঘটনা খুলে বললাম, যার সারমর্ম-আমাকে ভাই ১ নম্বর টার্মিনালে পৌঁছে দাও। কিন্তু আমার কাছে অত রুপি নেই। বাংলাদেশি ৫০০ টাকা দেব, যেটা তোমার ২৫০ রুপি থেকে অনেক বেশি। ট্যাক্সি ওয়ালা রাজি হয়ে গেলেন এবং আমাকে শাটল বাসের মতোই উড়িয়ে নিয়ে গেলেন টার্মিনাল-১ এ। সেখান গিয়ে প্রথমে জানতে চাইলাম আমাকে ভুল তথ্য দিয়ে ২ নম্বর টার্মিনালে পাঠানো হলো কেন? কোনো উত্তর নেই। তারপর বললাম, সন্ধ্যা ৭ট ৪৫ এর টিকিট কাটব। এবার তাদের উত্তর আছে, কিন্তু সমাধান নেই, ‘স্যরি স্যার, বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে। টিকিট বিক্রি বন্ধ। আপনাকে সকালের ফ্লাইটে যেতে হবে।’

আমি বাকরুদ্ধ। হতভম্ব। ঢাকা থেকে দিল্লির বিমান দেরিতে ছাড়ায় ইন্দোরের প্রথম ফ্লাইটটা না হয় আমি মিস করেছি, কিন্তু বিমানবন্দরে সশরীরে এতটা সময় থেকেও যে ইন্ডিগো আর তিন টার্মিনালের চক্করে পড়ে আমি পরপর দুটো ফ্লাইট ধরতে পারলাম না, সে দায় কার! এবারও তারা নিরুত্তর। এর মধ্যে আরও অনেক নাটকই হলো, যার পুরোটাই ইন্ডিগো কর্মীদের অপেশাদারি আর অদক্ষতার দৃষ্টান্ত এবং আমার হতাশায় ভেঙে পড়ার গল্প। সেসব আর নাইবা বললাম।

শেষ পর্যন্ত প্রায় আরেকটি টিকিটের টাকা দিয়ে কিনলাম পরদিন ভোর ৫টা ২৫ মিনিটের টিকিট। পরবর্তী সমস্যা, রাত কাটাব কোথায়? তখন বাজে রাত ৯টার মতো। শহরে গিয়ে হোটেল নিলে পরদিন অত ভোরে এসে ফ্লাইট ধরতে পারাটা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যাবে। এত ঘটনার পর সেই ঝুঁকি কি আর নেওয়া যায়! এর চেয়ে রাতটা বিমানবন্দরে হেঁটে-বসে কাটিয়ে দেওয়াই ভালো। তবে সেটির আর দরকার পড়েনি। শান্তি কিনে নিয়েছি টাকা দিয়ে।

টার্মিনালের নিচ তলাতেই আছে একটা লাউঞ্জ। আমেরিকান এক্সপ্রেসের কার্ড থাকলে চা-কফি সহ সোফায় ফ্রি গা এলিয়ে থাকার ব্যবস্থা আছে। আর ৩ হাজার রুপি দিলে ৬ ঘণ্টার জন্য মিলে যাবে একটা অ্যাটাচড বাথ এসি রুমই। সারা দিনের এত পরিশ্রমের পর একটু বিশ্রামের জন্য দ্বিতীয়টিই বেছে নিলাম। কিন্তু ভোর ৫টা ২৫ এ ফ্লাইট, ঘুম কি আর আসে! ৩ হাজার রুপিতে ৬ ঘণ্টার জন্য নেওয়া ৬ ফুট বাই ৮ ফুট রুমটায় শুয়ে শুয়ে চিন্তা করলাম, আসলে টাকাই সব। সারা দিনে একটু ভারমুক্ত তো ওই ক্রেডিট কার্ডটাই করল আমাকে! তখনই মনে পড়ল, কানাডা থেকে আসা বৃদ্ধের খবর তো আর নিলাম না। অবশ্য না নিলেই কি! পোশাকে-আশাকেকে যা মনে হলো, তাঁর টাকা, ক্রেডিট কার্ড কোনোটারই অভাব থাকার কথা নয়। নিশ্চয়ই আমার মতো তিনিও কোথাও থেকে কিছুটা শান্তি কিনে নিয়েছেন।

লেখার শুরুতে একটা কুইজ ছিল, সেটির উত্তর এতক্ষণে জেনে যাওয়ার কথা। হ্যাঁ, ঢাকা থেকেই দুই ঘণ্টা বিলম্বে ছেড়েছে দিল্লির ফ্লাইট। সে জন্যই ১২টায় বিমানবন্দরে গিয়েও ধরতে পেরেছি সড়ে ১১টার ফ্লাইট। কিন্তু কেন বিমান দেরিতে ছাড়ল, সেটি জানবেন না? কারণ, ওই দিন সকালেই বিমানবন্দর থেকে আকাশে উড়েছেন কোনো একজন ভিভিআইপি। তাঁর উড্ডয়ন মসৃণ করতেই ভজকট লেগে যায় অন্যান্য ফ্লাইটের ওঠা নামায়। সে কারণেই আমার দিল্লির ফ্লাইট ছাড়ে দুই ঘণ্টা দেরিতে।

আমার অবশ্য সেই ভিভিআইপির বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ নেই। তিনি সেদিন গেছেন বলেই তো আমিও আমার ফ্লাইটটা ধরতে পারলাম। মিস করলাম ইন্দোরের ফ্লাইট। রাত কাটালাম নিঃশব্দ এক বিমানবন্দরে এবং সেই কাহিনি নিয়ে লিখে ফেললাম এতগুলো শব্দ!