Thank you for trying Sticky AMP!!

ভালো দিনেই ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডের বাড়িতে

ওয়েলিংটনের থর্নটনে ২৫ টিনাকোরি রোডের সেই বাড়ি। এখানেই জন্মেছিলেন নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত সাহিত্যিক ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড।

জাদুঘর কি তাড়াহুড়ো করে দেখার জিনিস! জাদুঘর দেখতে হয় ধীরে সুস্থে, সময় নিয়ে। প্রদর্শিত জিনিসগুলো মন দিয়ে দেখতে হয়, নিচে বা পাশে লেখা কাহিনিটা মন দিয়ে পড়তে হয়। আর আমি কি না ঝড়ের বেগে এই রুম থেকে ওই রুমে ছুটে গিয়ে কোনো মতে সেটি দেখা শেষ করলাম!

এই জাদুঘর অবশ্য আর দশটা জাদুঘরের মতো নয়। এ কারণেই এত তাড়াহুড়ো করার পরও মনে কোনো অতৃপ্তি থাকল না। হাতে সময় থাকলেও আর কিই–বা দেখতাম, শেষ পর্যন্ত তো এটা একটা বাড়িই। ব্যবহৃত কিছু জিনিসপত্র। কিছু ছবি। প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি আগে নিউজিল্যান্ডের উচ্চবিত্ত কোনো পরিবারের গৃহসজ্জা কেমন থাকত, এ সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়াই তো। এমন বাড়ি তো ওয়েলিংটনে নিশ্চয়ই অনেক ছিল। ২৫ টিনাকোরি রোডের বাড়িটা সেগুলো থেকে আলাদা হয়ে ৩০ বছরেরও বেশি আগে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে একটা কারণেই। এই বাড়িতেই জন্ম ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডের। এখানেই কেটেছে তাঁর জীবনের প্রথম পাঁচ বছর।

ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড মৃত্যুর প্রায় এক শ বছর পরও নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে বিখ্যাত ছোটগল্পকার হয়ে থাকতে পারেন, তবে নামটা বলা মাত্রই সব পাঠক চিনে ফেলবেন—এটা আশা করাটা একটু বাড়াবাড়িই হয়ে যায়। আমিই তো চিনেছি ঘটনাচক্রে। সেটি অবশ্য বেশ আগে। এগার বছর আগে সর্বশেষ যেবার ওয়েলিংটন এসেছিলাম, তখন। যতদূর মনে পড়ছে, আমাকে ওই বাড়িটার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এখানকার ভিক্টোরিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বাংলাদেশি অধ্যাপক। তাঁর নামটা মনে করতে পারছি না বলে একটু বিব্রতই লাগছে। তখন পর্যন্ত ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডের নামই শুনিনি, তাঁর গল্প পড়ার তো প্রশ্নই ওঠে না। এটাও স্পষ্ট মনে আছে, ওই বাংলাদেশি অধ্যাপক ম্যানসফিল্ডের পরিচয় দেওয়ার সময় লেখকসত্তার চেয়ে বড় করে দেখিয়েছিলেন তাঁর বিদ্রোহী সত্তাকে। আমাকে বলেছিলেন, ‘ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডকে বলতে পারেন “নিউজিল্যান্ডের বেগম রোকেয়া”। ২০০৭–০৮–এর সেই ট্যুরে ‘নিউজিল্যান্ড: শহর থেকে শহরে’ নামে প্রথম আলোতে একটা কলাম লিখেছিলাম। সেই কলামগুলোর সংকলন নিয়ে প্রকাশিত বইটা সঙ্গে নিয়ে এসেছি বলে ওই কথাটা শোনার পর কী মনে হয়েছিল, সেটিও তুলে দিতে পারছি: ‘বলাটা ঠিক হবে না। ম্যানসফিল্ডের জীবনাচরণে প্রচলিত সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে হয়তো বিদ্রোহ ছিল, কিন্তু বেগম রোকেয়ার সঙ্গে তুলনাটা একটু বাড়াবাড়িই। রোকেয়ার লড়াই এই বিশ্বের আর কোন মেয়েকেই বা লড়তে হয়েছে। ম্যানসফিল্ডের জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার আগেই তো নিউজিল্যান্ডে সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে মেয়েদের সমানাধিকার। মেয়েদের ভোটাধিকার নিউজিল্যান্ডেই প্রথম। সেটি ১৮৯৩ সালে। ক্যাথরিন ম্যানসফিল্ডের বয়স তখন পাঁচ।’

ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড (১৮৮৮–১৯২৩)

সেবার নিউজিল্যান্ডের বেশ কটি শহরে একটা বিলবোর্ড দেখেছিলাম। ‘ম্যাক্স’ নামে মেয়েদের পোশাক প্রস্তুতকারী একটা কোম্পানির বিজ্ঞাপন। ফ্যাশনেবল পোশাক পরা এক তরুণীর পাশে লেখা—ওয়েলকাম টু দ্য উইমেন্স রিপাবলিক অব নিউজিল্যান্ড। এবার সেটি কোথাও দেখলাম না। হয় চোখ এড়িয়ে গেছে অথবা ‘ম্যাক্স’–এর ব্যবসা লাটে উঠেছে। আবার এমনও হতে পারে, মার্কেটিংয়ের কোনো নতুন কৌশল মাথায় এসেছে তাদের। ওই বিলবোর্ডটা ধরেই নিউজিল্যান্ডে মেয়েদের সমানাধিকার ও সমাজের সব স্তরে দাপুটে বিচরণের কাহিনি লিখতে গিয়েই ওই লেখাটায় এসেছিলেন ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড। নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী তখন হেলেন ক্লার্ক। মেলাতে তাই খুব সুবিধা হয়েছিল। ঘটনাচক্রে, আজ আবার যখন ম্যানসফিল্ডের বাড়িতে গেলাম, তখনো নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। ২০১৭ সালের শেষ দিকে মাত্র ৩৭ বছর ৮৫ দিন বয়সে যিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। মাত্র ৪৬ দিনের জন্যই নিউজিল্যান্ডের ইতিহাসে কণিষ্ঠতম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কীর্তিটা গড়তে পারেননি। এই একটা জায়গায় অবশ্য ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডের নিউজিল্যান্ডের চেয়ে বেগম রোকেয়ার বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। নিউজিল্যান্ড প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে ১৯৯৭ সালে। বাংলাদেশ তো এরও ছয় বছর আগে।

আজ ২৫ টিনাকোরি রোডে গিয়ে জানলাম, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জেসিন্ডা আরডার্ন তাঁর মতো করে ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানানোর একটা দারুণ উপায় বের করে নিয়েছেন। আগামী ১৩ মার্চ একটা অনুষ্ঠানে বইয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা এবং পড়ার অভ্যাস ও সাহিত্য কীভাবে জীবন বদলে দেয়—এ নিয়ে কথা বলবেন। যেটি আসলে একটা ফান্ড রেইজিং প্রোগ্রাম। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বই নিয়ে আলোচনা করতে টিকিট কাটতে হবে। টিকিটের দাম ৫৫ ডলার। যে টাকাটা উঠবে, সেটি ব্যয় হবে ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডের বাড়িটা সংস্কার করায়।
এগার বছর আগে একবার দেখে আসার পরও আবার ম্যানসফিল্ডের বাড়িতে ছুটে যাওয়ার কারণটা এবার ব্যাখ্যা করি। ম্যানসফিল্ডের নামটা প্রথম কীভাবে জেনেছিলাম, সেটি তো বলেছিই। মাত্র ৩৪ বছর বয়সেই যক্ষ্মায় ভুগে মারা গেছেন, ছোটগল্প ছাড়া সাহিত্যের আর কোনো শাখায় কাজও করেনি। ছোটগল্পও যে খুব বেশি লিখেছেন, তাও না। তারপরও চেখভ–মোপাসাঁর সঙ্গে উচ্চারিত হয় তাঁর নাম। এসবই একটু কৌতুহলী করে তুলেছিল। সেই কৌতুহল থেকে ম্যানসফিল্ডের বেশ কিছু গল্প পড়েছি। এত নামডাক যে অকারণে হয়নি, সেটিও বুঝতে পেরেছি। এবার নিউজিল্যান্ডে আসার পর দেখছি, ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড ক্রমশই আরও ‘বড়’ হয়ে উঠছেন। হ্যামিল্টনে ওয়াইকাটো জাদুঘরে গিয়ে দেখি, ম্যানসফিল্ডের জন্য বিশাল একটা অংশ বরাদ্দ। তাঁর ছবি, সংক্ষিপ্ত জীবনী, বিখ্যাত সব গল্পের অংশবিশেষ দিয়ে যা সাজানো। এর আগেই হ্যামিল্টন গার্ডেনসে গিয়ে দেখে এসেছি, থিমভিত্তিক ওই গার্ডেনে নতুন যে কটি অংশ যোগ হচ্ছে, তার একটির বিষয় ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড। ‘দ্য গার্ডেন পার্টি’ নামে তাঁর বিখ্যাত গল্পটাতে শেরিডান পরিবারের বাড়ির সামনে বাগানের যে বর্ণনা দেওয়া আছে, সেটির অনুকরণে তা তৈরির কাজ চলছে।

হ্যামিল্টনের ওয়াইকাটো জাদুঘরে ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড ও তাঁর বিখ্যাত গল্প ‘দ্য গার্ডেন পার্টি’—ছবি: লেখক

একটু পড়াশোনা করে জানলাম, নিউজিল্যান্ডের নয়/দশটি স্কুলে ম্যানসফিল্ডের নামে মেয়েদের হাউস আছে। তাঁর জীবনীভিত্তিক বেশ কটি উপন্যাস লেখা হয়েছে, টেলিভিশন সিরিজ হয়েছে, সিনেমাও। বৃষ্টি ওয়েলিংটন টেস্ট শুরু করতে না দেওয়ায় আজ সারাটা দিন ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড চর্চা করেই কাটালাম। বেসিন রিজার্ভ আর আমার মোটেল রাস্তার এপাড়–ওপাড়—এটা তো এই ডায়েরিতে আগেই লিখেছি। সকালে ঘুম থেকে উঠেই দেখি, আবহাওয়ার পূর্বাভাসকে সত্যি প্রমাণ করে ‘ঝরঝর ঝরিছে বারিধারা’। বিকাল পর্যন্ত যা বিরামহীন ঝরেই গেল। মাঠে যাওয়ার কোনো মানেই হয় না। প্রেসবক্সে বসে থাকা আর আমার রুমে বসে থাকার মধ্যে সে অর্থে কোনো পার্থক্যই নেই। উইকেট থেকে দুটির দূরত্ব প্রায় সমানই বলা যায়। আমি তাই ল্যাপটপে বর্ষার গান শুনতে শুনতে ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডকে নিয়ে পড়াশোনা করে তাঁর ব্যাপারে মোটামুটি ‘বিশেষজ্ঞ’ হয়ে উঠলাম।
‘দ্য গার্ডেন পার্টি’ গল্পটা আবার পড়লাম, দেখে ফেললাম এই গল্প নিয়ে নির্মিত টেলিভিশন নাটকটাও। গল্পটা কি একটু বলব? খুবই সংক্ষেপে বলি। উচ্চবিত্ত শেরিডান পরিবার উৎসবের আমেজ। বিকেলে আজ গার্ডেন পার্টি। মহাসমারোহে সেটির আয়োজন চলছে। এরই মধ্যে খবর এলো, ওই বাড়ির ঢালের নিচে নিম্নবিত্ত পরিবারটির একমাত্র উপার্জনশীল সদস্য, পেশায় কোচোয়ান স্কট ঘোড়া থেকে পড়ে মাথায় আঘাত পেয়ে মারা গেছেন। রেখে গেছেন স্ত্রী ও পাঁচটি সন্তান। খবরটা শোনার পর শেরিডান দম্পতির ছোট মেয়ে লরা মাকে গিয়ে বলল, বিকেলের পার্টিটা বাতিল করে দেওয়া উচিত। শত হলেও প্রতিবেশীই তো, সেখানে এমন শোক আর এই বাড়িতে আনন্দ–উৎসব হবে, ব্যান্ড বাজবে—এটা কেমন নিষ্ঠুর হয়ে যায় না! মা লরার কথা পাত্তাই দিলেন না। গার্ডেন পার্টি ঠিকই হলো। যেটি শেষ হওয়ার পর আবারও স্কটের মৃত্যুর প্রসঙ্গ উঠল। বেঁচে যাওয়া প্রচুর খাবারদাবার একটা বাস্কেটে করে মৃতের বাড়িতে দিয়ে আসার সিদ্ধান্ত হলো। সেটি দিয়ে আসার দায়িত্ব পড়ল লরার ওপরই। প্রবল অস্বস্তি নিয়ে সেই বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই লরার পালাই-পালাই ভাব। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলা স্কটের স্ত্রীকে দেখে অস্বস্তিটা আরও বাড়ল। যাঁর বোনের জোরাজুরিতে একটা ঘরে শুইয়ে রাখা স্কটের মৃতদেহটাও দেখতে বাধ্য হলো লরা। মৃতের প্রশান্ত মুখ দেখে লরার মন থেকে সব অস্বস্তি দূর হয়ে গিয়ে জন্ম নিল অন্যরকম একটা উপলব্ধির। তাঁর মনে হলো, মৃত্যু জীবনের সব যন্ত্রণা থেকে মুক্ত সুখময় এক নিদ্রা ছাড়া আর কিছু নয়।
গল্পের শেষটা ছোটগল্পের আদর্শ সংজ্ঞা মেনে ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’। লরার ফিরতে দেরি দেখে তার খোঁজে আসা ভাইকে জড়িয়ে ধরে লরা কাঁদতে কাঁদতে দুবার ‘ইজন’ট লাইফ..’ বলেও বাক্যটা শেষ করে না। ভাই লরি তাঁর মতো করে তা বুঝে নিয়ে বলে, ‘ইজন’ট ইট, ডার্লিং?’
ছোট গল্প হলেও সেটির যে আকার, বাংলাদেশে অনেকে এমন কিছু লিখে ‘উপন্যাস’ বলে চালিয়ে দেয়। এত ছোট্ট পরিসরে সেটির স্বাদ–রস কি আর তুলে আনা যায় নাকি! গল্পটা আবার পড়তে পড়তে রবীন্দ্রনাথের ‘আজি হতে শতবর্ষ পরে’ কবিতাটার কথা মনে পড়ছিল। ওই কবিতাই বলে দিচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ নিশ্চিত ছিলেন, এক শ বছর পরও তাঁকে পড়তে হবে। নিজের লেখার স্থায়িত্ব নিয়ে ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ড যেখানে ছিলেন একেবারেই সন্দিহান। যেটি ভুল ছিল বলেই প্রমাণিত! ‘দ্য গার্ডেন পার্টি’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৯২১ সালে। প্রায় এক শ বছর পর বৃষ্টিমুখর এক দিনে ঘরবন্দি আমি ঠিকই তো সেটি পড়ছি। পড়তে পড়তেই সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেললাম। টেস্টের প্রথম দিনের খেলা আনুষ্ঠানিকভাবে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা মাত্র ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডের বাড়ির দিকে দৌড় লাগাব। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি আর কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসকে উপেক্ষা করে সেটিই করলাম। জাদুঘরে রূপান্তরিত বাড়ির দরোজা সাড়ে চারটায় বন্ধ হয়ে যায়। আমি পৌঁছলাম চারটার দিকে। এ কারণেই অমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে সব দেখতে হলো। ৮ ডলারের টিকিট কাটার সময় কাউন্টারের তরুণী বললেন, ‘আপনি বরং কাল আসুন। এটুকু সময়ে কী দেখবেন? ম্যানসফিল্ডের ওপর নির্মিত ডকুমেন্টারিটা তো দেখতে পারবেন না। ওটাই তো প্রায় ৫০ মিনিটের।’ আমি বললাম, ‘কাল আমার সময় হবে না। ডকুমেন্টারি দেখার দরকার নেই। ম্যানসফিল্ডকে আমার জানা হয়ে গেছে। বাড়িটাই একটু ঘুরে দেখি।’
দেখে–টেখে যখন মোটেলে ফিরছি, হঠাৎ মনে পড়ল, আরে, আজ তো আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ভালো দিনেই তাহলে ক্যাথেরিন ম্যানসফিল্ডের বাড়িতে ঘুরে এসেছি।