Thank you for trying Sticky AMP!!

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যতি চিহ্ন টেনে দিলেন মহেন্দ্র সিং ধোনি।

শুধু এক–দুই মুহূর্তের কবিই নন ধোনি

মে পাল দো পাল কা শায়ের হু...আমি এক-দুই মুহূর্তের কবি-মহেন্দ্র সিং ধোনি ।আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে যেন বিদায় জানালেন গানের সুরে, কবিতার ছন্দে। বিদায় বার্তাটাও যে এমন সৃজনশীল হতে পারে, সেটিও ধোনি দেখালেন। ইনস্টাগ্রামে অমিতাভ বচ্চনের ‘কাভি কাভি’ সিনেমায় মুকেশের গাওয়া ‘মে পাল দো পাল কা শায়ের হু’ গানটা জুড়ে দিয়ে ৪ মিনিট ৭ সেকেন্ডে ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক ফিরে দেখেছেন তাঁর ১৫ বছরের পথ চলা।

সেই পথের বাঁকে আছে যেমন অসামান্য সব সাফল্যের ফলক, একইভাবে কখনো কখনো কড়া ব্রেক করতে হয়েছে ব্যর্থতার ‘স্পিডব্রেকারে’ও। তবুও ১৫ বছরের ক্যারিয়ারটা যেখানে শেষ করলেন, তৃপ্তির একটা হাসি খেলে যেতেই পারে ঝাড়খণ্ড থেকে উঠে আসা ‘মাহি’র মুখে। পশ্চিমবঙ্গের খড়গপুর রেলওয়ে স্টেশনের একজন টিটিইর জীবন যে এমন বর্ণাঢ্য হতে পারে, এত সাফল্যের মণিমুক্তা খচিত হবে, সেটি ধোনি নিজেও ভেবেছিলেন আজ থেকে ২০ বছর আগে? প্রয়াত সুশান্ত সিং অভিনীত বলিউডের ‘এমএস ধোনি: দ্য আনটোল্ড স্টোরি’র সৌজন্যে ধোনির জীবনের গল্পটা অবশ্য অজানা নয়।

২০০৪ সালে নাইরোবিতে অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় টুর্নামেন্টে ভারত ‘এ’ দলের হয়ে দুই সেঞ্চুরির পর নজর কাড়েন নির্বাচকদের। একই বছরের ডিসেম্বরে বাংলাদেশের বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক। প্রথম আলোচনায় এলেন পরের বছর বিশাখাপট্টনামে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ১২৩ বলে ১৪৮ রানের ইনিংসের পর। ধোনি নিজের আগমনী জানান দিলেন উচ্চধ্বনিতেই! তারপর? অ-নে-ক কিছু! ২০০৭-এ ভারতকে জেতালেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। টেস্ট র‍্যাঙ্কিংয়ে ভারতের প্রথমবারের মতো ১ নম্বরে ওঠা তাঁর অধীনেই (নভেম্বর ২০০৯ থেকে আগস্ট ২০১১)। তাঁর নেতৃত্বেই ২৮ বছর পর বিশ্বকাপ জিতেছে ভারত। টি-টোয়েন্টি ও ৫০ ওভার—দুটি বিশ্বকাপ জয়ের গৌরব একমাত্র ধোনিই গায়ে মেখেছেন। ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র অধিনায়ক হিসেবে আইসিসির তিনটি টুর্নামেন্ট জেতার অনন্য রেকর্ড তাঁর অধিকারে। ভারতকে সবচেয়ে বেশি ২৭টি টেস্টও জিতিয়েছেন তিনি।

অথচ একটা সময় ব্যাডমিন্টন ও ফুটবলেই মগ্ন ছিলেন ভারতীয় ক্রিকেট দলের এই অধিনায়ক! খেলোয়াড়ি জীবনের শুরুর দিকে জেলা পর্যায়েও বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে এ খেলাগুলোই খেলেছেন নিয়মিত। ফুটবল দলে তাঁর ভূমিকা ছিল গোলরক্ষক হিসেবে। ক্রিকেটে আসার ঘটনাটাও চমকপ্রদ। তাঁর ফুটবল কোচই পাঠিয়েছিলেন স্থানীয় একটি ক্রিকেট দলের ‘খ্যাপ’ খেলতে। ক্রিকেটের প্রতি গভীর টান সৃষ্টি হয় রাঁচির কমান্ডো ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে (১৯৯৫-৯৮) খেলার সময়। দারুণ পারফরম্যান্সের পর ১৯৯৭/৯৮ মৌসুমে সুযোগ পেলেন ভিনু মানকড় ট্রফির অনূর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপ খেলার। এরপর জাতীয় দলে সুযোগ পেতে লেগে গেল আরও সাত বছর। সমসাময়িক অন্য সতীর্থদের তুলনায় একটু দেরিতে অভিষেক হয়েছিল বলেই কি না, ১৫ বছরের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটা সাজালেন অর্জনের পর অর্জনে। অধিকাংশ সময় কাটিয়েছেন দলের নেতৃত্ব দিয়ে। দলের প্রতি তাঁর নিবেদন প্রসঙ্গে একবার বলেছিলেন, ‘আমার স্ত্রীকে বলেছি, আমার জীবনে তাঁর অবস্থান তিনে। প্রথমে দেশ, দ্বিতীয় অবস্থানে বাবা-মা, এরপর স্ত্রী।’

মাঠে যেমন চকিতে চমকে দেওয়া সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, নিজের ক্যারিয়ার নিয়েও সিদ্ধান্তগুলো কম চমকপ্রদ নয়। ২০১৪ সালের ডিসেম্বরে সিরিজের মাঝপথে হঠাৎ অধিনায়কের অবসর ঘোষণা দিলেন; কোনো বিদায়ী টেস্ট, বিদায়ী ভাষণ কিংবা বিদায়ী সংবাদ সম্মেলনেরও সুযোগ দেননি—ভারতের টেস্ট ইতিহাসে আর কোনো অধিনায়কের এভাবে বিদায় বলার ঘটনা নেই। ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে ভারতীয় দলের অধিনায়কত্ব ছাড়ার ঘোষণাটাও যথেষ্ট চমকপ্রদ। তাঁর নেতৃত্বেই ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তিন ওয়ানডে ও তিন টি-টোয়েন্টি ম্যাচের সিরিজ খেলার কথা ছিল ভারতের। সেই সিরিজ শুরুর দিন দশেক আগে ধোনি ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ডকে (বিসিসিআই) জানিয়ে দিলেন, সীমিত ওভারের ক্রিকেটেও আর অধিনায়কত্ব করবেন না!

গত বিশ্বকাপের পর থেকে নিজেকে একেবারেই আড়াল করে রেখেছিলেন ধোনি। তাঁর অবসর নিয়ে কত কথাই হলো এ সময়ে। অবশ্য অবসর-সংক্রান্ত কথা তাঁকে শুনতে হচ্ছে গত পাঁচ-ছয় বছর ধরেই। একই বিষয়ে বারবার কথা বলতে বলতে বিরক্ত ধোনি ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এক অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিককে সংবাদ সম্মেলনের ডায়াসে ডেকে কী রসিকতা করেছিলেন, নিশ্চয়ই মনে আছে! আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরু করেছিলেন রানআউটে, শেষটাও হলো রানআউট দিয়ে। শুরু আর শেষটার এই মিল যেমন তাঁর ক্যারিয়ারের মতোই চমকে ভরা!

কারও কথায় ধোনি অবসর নেবেন না, সেটি জানাই ছিল। জানা ছিল না তিনি কোন উপায়ে ঘোষণাটা দেন। ঘোষণাটা দিলেন আচমকা, গীতিকাব্যের সুরে সুরে—‘কত কবি এসেছে আমার আগে/তারা এসেছে, চলে গেছে/...কাল আমি তোমাদের থেকে আলাদা হয়ে যাব/যদিও আমি তোমাদের বর্তমানের অংশ...।’

ঠিক, ধোনির আগে কত অধিনায়ক, কত উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান এসেছেন ভারতীয় ক্রিকেটে। কিন্তু তাঁর মতো এত গাঢ় ছাপ কজন রেখে যেতে পেরেছেন? ধোনি যতই বলুন ‘আমি এক-দুই মুহূর্তের কবি’—ক্রিকেট বলবে, ‘মি. মহেন্দ্র সিং ধোনি, আপনি অসংখ্য মুহূর্তের কবি।’