গতির রাজ্য থেকে যেভাবে ঘূর্ণিতে নেওয়াজ
পাকিস্তান ক্রিকেট মানেই পেস বোলিং। ক্রিকেট-বিশ্বে পাকিস্তানের বিজ্ঞাপনটা এমনই। বাঁহাতি হলে ওয়াসিম আকরাম; ডানহাতি হলে ইমরান খান, ওয়াকার ইউনিস কিংবা শোয়েব আখতার হতে চাইবেন পাকিস্তানের যেকোনো উদীয়মান ক্রিকেটার। করাচি, লাহোরের অলিগলিতে তারকা ফাস্ট বোলার হওয়ার স্বপ্নেই শৈশব কাটে শত শত কিশোরের। রাওয়ালপিন্ডির মোহাম্মদ নেওয়াজও ছিলেন তাঁদেরই একজন। দৈবক্রমে সেই নেওয়াজই এখন পাকিস্তান দলে খেলছেন বাঁহাতি স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে।
ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটেও একই ভূমিকায় বেশ সফল ২৯ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার। স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার বলে প্রায় প্রতি বিপিএলেই নেওয়াজকে দলে ভেড়াতে চায় ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো। এবারের বিপিএলেও খুলনা টাইগার্সের হয়ে চার ম্যাচ খেলে গেছেন। ব্যাটিং-বোলিং দুটিতেই ভালো করে ঢাকা ছেড়েছেন নিজ দেশের টি-টোয়েন্টি লিগ পিএসএলে যোগ দিতে। যাওয়ার আগে গত বুধবার প্রথম আলোকে শুনিয়ে গেছেন তাঁর পেস বোলিংয়ের স্বর্গরাজ্যে বাঁহাতি স্পিনার হওয়ার গল্প।
Also Read: সব বলই মারার প্রতিজ্ঞা নিয়ে নেমেছিলেন নেওয়াজ
গল্পের প্রথম পর্ব ওয়েস্ট ইন্ডিজে। অনূর্ধ্ব-১৫ দলের হয়ে ক্যারিবীয় সফরে দলে ঢুকেছিলেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে। আর দশজন পাকিস্তানি বাঁহাতি পেসারের মতো নেওয়াজও নিজেকে ভবিষ্যতের ওয়াসিম আকরাম ভাবতেন। সেটিই বদলে গেল সেই সফরে। একদিন অনুশীলনে স্পিনারের অ্যাকশনে বল করে গা গরম করছিলেন নেওয়াজ। কোচ নিশ্চয়ই কিছু একটা দেখেছিলেন। পরদিন ম্যাচে পাকিস্তানের পেসাররা মার খাচ্ছেন। ৬ ওভারে ৬০ করে ফেলেছে প্রতিপক্ষ। এরপর কী হলো, শুনুন নেওয়াজের মুখেই, ‘কোচ আমাকে লাঞ্চ ব্রেকে জিজ্ঞেস করলেন, “কাল তুমি নেটে স্পিন করছিলে। ম্যাচে করতে পারবে?” এরপর ওই ম্যাচে ১০ ওভার স্পিন বোলিং করে ২-৩ উইকেট নেই। ম্যাচও জিতে যাই। এর পর থেকেই স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে খেলেছি।’
বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের সেই সফরের পর বেশ কয়েকবারই ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে গিয়েছেন। যতবারই ক্যারিবীয় সফরে যান, নেওয়াজের মনে ফিরে আসে সেই স্মৃতি, ‘আমি একজন মিডিয়াম পেসার হিসেবে এসেছিলাম ওয়েস্ট ইন্ডিজে, ফিরলাম স্পিন বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে। ভাবতেই অবাক লাগে।’ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এমন ঘটনা অবশ্য একেবারেই নতুন, তা নয়। পেস বোলার হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে খেলা শুরু করে অনেকেই ব্যাটসম্যান হয়েছেন, স্পিনারও হয়েছেন। বাংলাদেশের সাবেক বাঁহাতি স্পিনার মোহাম্মদ রফিকের গল্পটা তো হুবহু নেওয়াজের মতো। পাকিস্তান বলেই হয়তো নেওয়াজের গল্পটা একটু অন্য রকম, পাকিস্তানের বাচ্চাদের মনে শুধু ফাস্ট বোলিংই। সেখানে গলিতে গলিতে টেপ বল ক্রিকেট হয় আর টেপ বল ক্রিকেটে স্পিন চলে না।
বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে নেওয়াজের সামনে সেই অর্থে কোনো আদর্শ ছিল না। পাকিস্তান দলে দীর্ঘদিন খেলা বাঁহাতি স্পিনার খুঁজতে ফিরে যেতে হবে আশির দশকে। মনে পড়বে ৫০ টেস্ট খেলে ১৭১ উইকেট নেওয়া ইকবাল কাশিমকে। একই সময় পাকিস্তান দলে ছিলেন লেগ স্পিন কিংবদন্তি আবদুল কাদের। দুজনের মধ্যে কাকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রজন্ম ‘রোল মডেল’ মনে করেছে, তা বোধ হয় বলার প্রয়োজন নেই। নেওয়াজ তাই স্বপ্ন দেখেন, তাঁর ক্যারিয়ার শেষে বাঁহাতি স্পিন বোলিং অলরাউন্ডারের কথা ভাবলেই যেন পাকিস্তানের পরবর্তী প্রজন্মের তাঁর নামটা মনে পড়ে।
পাকিস্তানের হয়ে তিন সংস্করণের ক্রিকেটে ১০৩ ম্যাচ খেলা নেওয়াজ অবশ্য মনে রাখার মতো এমন এক মুহূর্তের সাক্ষী, যা ভারত ও পাকিস্তানের সমর্থকদের স্মৃতিতে থেকে যাবে দীর্ঘদিন। ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এমসিজিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে সেই পাগলাটে শেষ ওভারটা করেছিলেন নেওয়াজ। বিরাট কোহলি ও রবিচন্দ্রন অশ্বিন সেই ওভারে ১৬ রান তুলে ভারতকে অবিশ্বাস্য জয় এনে দেন। নেওয়াজকে সেদিনের দুঃসহ স্মৃতিটা মনে করিয়ে দিতেই দুই হাতে মুখ লুকালেন, ‘আপনি আরেকবার আমার ক্ষতে নুন ছিটাচ্ছেন!’ এরপর হাসতে হাসতে বললেন, ‘ওই দিনটা দর্শক যেমন ভুলবে না, আমিও ভুলতে পারব না। অস্ট্রেলিয়ায় গেলে এখনো মনে হয়…এ কই চলে এলাম! অস্ট্রেলিয়াও এখন ভালো লাগে না (হাসি)।’
ক্যারিয়ারের সবচেয়ে দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে নেওয়াজের রসিকতা করতে পারার কারণ আছে। ওই ব্যর্থতাই এখন নেওয়াজের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি, ‘এত বড় ম্যাচ, পুরো দুনিয়া আপনাকে দেখেছে…ওই ম্যাচে তো দারুণ লড়াই হয়েছিল। এটাই এখন আমার জন্য শক্তির উৎস। আপনি যখন এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাবেন, পরে একই পরিস্থিতিতে এর চেয়েও ভালোভাবে মানিয়ে নেবেন।’
সামনেই আরও একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। খেলাটাও ওয়েস্ট ইন্ডিজে, যেখান থেকে নেওয়াজের জীবনের বাঁকবদলের শুরু। মোহাম্মদ নেওয়াজের আরেকটি নতুন গল্প লেখার সুযোগও।