Thank you for trying Sticky AMP!!

আরতেতার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার যথেষ্ট সামর্থ্য কি লুইজদের ছিল?

আরতেতার একগুঁয়েমি-ই কি হারাল আর্সেনালকে?

খেলোয়াড়ি জীবনে মিকেল আরতেতা বেশ সৃষ্টিশীল মিডফিল্ডার ছিলেন। ছোটবেলা থেকে সান সেবাস্তিয়ানে জাবি আলোনসোর সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, দুজনের খেলার ধরনই মোটামুটি এক। তাঁদের ছোট-বড়  পাস দিয়েই আক্রমণের মালা গাঁথত দল। মিডফিল্ডে থেকে দলের খেলার গতিপথ একাই নির্ধারণ করে দেওয়ার ক্ষমতা ছিল দুজনেরই। আরতেতার এই ক্ষমতাই তাঁকে নিয়ে যায় বার্সেলোনায়, এককালে তাঁকেই খেলোয়াড় পেপ গার্দিওলার যোগ্য উত্তরসূরি মানা হতো। পরে পিএসজি, এভারটন, আর্সেনাল—   যে ক্লাবেই গিয়েছেন, আরতেতার ভূমিকার পরিবর্তন হয়নি তেমন। এখনো নিচ থেকে ছোট ছোট পাসে আক্রমণ গড়ে তোলায় বিশ্বাসী তিনি।

এমনকি আর্সেনালে কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন যাকে, সেই আর্সেন ওয়েঙ্গারও আরতেতার মতো ক্ষমতাসম্পন্ন মিডফিল্ডারদের অনুরাগী ছিলেন। এ জন্য যুগে যুগে আরতেতা ছাড়াও সেস্ক ফাব্রিগাস, সান্তি কাজোরলা, এদু, অ্যালেক্স সং, টমাস রসিস্কির মতো মিডফিল্ডারদের আলাদা কদর ছিল তাঁর কাছে। খেলোয়াড়ি জীবন শেষ করে কোচ যখন হলেন, আরতেতা মাথার ওপর ছায়া হিসেবে পেলেন পেপ গার্দিওলাকে। সব মিলিয়েই, কোচ হিসেবে আরতেতার মন-মস্তিষ্ক হয়ে উঠেছে পাসিং ফুটবল নির্ভর। চান নিজের দলও সেই দর্শনে খেলুক, পেছন থেকে আক্রমণ গড়ে তুলুক।

আর্সেনালের শুরুর একাদশ।

যথেষ্ট ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে এ ধরনের টেকনিক্যাল ফুটবল খেলার জন্য উঁচু মানের মেধাসম্পন্ন খেলোয়াড় দরকার। অমন খেলোয়াড় না থাকলে, এই কৌশলে ফুটবল খেলা কিছু ক্ষেত্রে আত্মঘাতী হয়ে ওঠে। যেমনটা হয়েছে গতকাল। এর মাশুলও দিয়েছে আর্সেনাল। লিভারপুলের বিপক্ষে ৩-১ গোলে হেরেছে তাঁরা। প্রিমিয়ার লিগে আর্সেনালের প্রথম পরাজয় এটা।

কিন্তু কীভাবে আত্মঘাতী হয়ে উঠল আরতেতার কৌশল?

আরতেতার পরিকল্পনা, পরিস্থিতি যেমনই হোক না কেন, নিচ থেকে আক্রমণ গড়তে হবেই। প্রতিপক্ষ প্রেস করুক বা না করুক, আর্সেনালের এই নীতির কোনো গড়বড় হয় না কখনো। লিগের প্রথম দুই ম্যাচে ফুলহাম ও ওয়েস্ট হামের সঙ্গে এই কৌশলে খেলিয়ে যথেষ্ট সফল হয়েছিলেন আরতেতা। সফল হয়েছিলেন গত মৌসুমের শেষ দিকে লিভারপুলের বিপক্ষেও, যে ম্যাচে আর্সেনাল ২-০ গোলে জিতেছে।

বল পায়ে থাকলে ৩-৪-৩ ছকের আর্সেনাল ৪-৪-২ হয়ে যাচ্ছিল।

এখানে বলে রাখা ভালো, ফুলহাম বা ওয়েস্ট হামের কেউই তেমন প্রেসিং ফুটবলে পারদর্শী নয়। নিজেদের অর্ধে বসে থেকে সময়-সুযোগ মতো প্রতি আক্রমণে ওঠো ; মোটামুটি সবারই খেলার আপ্তবাক্য এটা। প্রতিপক্ষকে প্রেস করার ব্যাপারে তাদের আগ্রহ নেই তেমন। আর লিভারপুলের বিপক্ষে আর্সেনাল যে ম্যাচটা জিতেছিল, সে ম্যাচে দুটি গোলই লিভারপুল খেয়েছিল নিজেদের রক্ষণের ভুলে।

প্রতিপক্ষ প্রেসিং ফুটবলে পারদর্শী না হলে আর্সেনালের নিচ থেকে আক্রমণ গড়তে সমস্যা হয় না। সমস্যা হবে কী করে? আর্সেনালের ডিফেন্ডারদের প্রেস করার মতো কেউ থাকেন না তো, সবাই নিজেদের ঘর সামলাতেই ব্যস্ত থাকেন। আর্সেনালও এন্তার সময় পেয়ে যায় আক্রমণ রচনা করার জন্য।

নিচ থেকে আক্রমণ শুরু করার সময় আর্সেনালের ডিফেন্ডার ও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের পজিশন।

লিভারপুলের বিপক্ষে গতকালের ম্যাচটা এমন ছিল না। লিভারপুল আক্রমণভাগের ত্রিফলা, মানে-সালাহ-ফিরমিনো ; তিনজনই প্রেসিং ফুটবলে সিদ্ধহস্ত। গোল করা বা গোল সহায়তা করাই শুধু নয়। একদম প্রতিপক্ষ রক্ষণভাগকে নিরন্তর প্রেস করার ব্যাপারেও তাদের সাফল্য চোখে পড়ার মতো। এমন দলের বিপক্ষে একদম নিচ থেকে আক্রমণ রচনা করতে চাইলে এমন ডিফেন্ডার ও ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মাঠে নামানো উচিত, যারা অনায়াসে প্রতিপক্ষের প্রেসিং ভেদ করে নিজেদের খেলা গড়ে নিতে পারেন।

আরতেতার একগুঁয়েমিটা এখানেই। আর্সেনালের রক্ষণভাগ ও মিডফিল্ডে এ দিন ছিলেন দাভিদ লুইজ, রব হোল্ডিং, এইন্সলি মাইটল্যান্ড-নাইলস, মোহাম্মদ এলনেনির মতো খেলোয়াড়। তাঁরা প্রেসের বিপক্ষে কতটা মানসম্পন্ন এই নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রশ্ন আরও বেড়েছে গত রাতের ম্যাচের পর। নিয়মিত মানে-সালাহ, ফিরমিনো এমনকি ফাবিনিও-কেইতাদেরও প্রেসের শিকার হয়েছেন তাঁরা। দ্বিতীয়ার্ধে তো এমন অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছিল, গোলরক্ষকের পা থেকে রক্ষণভাগ হয়ে বল ঠিকঠাক মিডফিল্ডেই যেতে পারছিল না। তার আগেই লিভারপুলের কেউ না কেউ বল কেড়ে নিয়ে দ্রুত প্রতি আক্রমণে উঠে যাচ্ছিলেন।

আরতেতা কীভাবে খেলোয়াড়দের দিয়ে নিচ থেকে আক্রমণ রচনা করতে চান, এখানে একটু বলে রাখা ভালো। নিজেদের বক্সে বলতে গেলে প্রায় গোললাইন স্পর্শ করে দাঁড়িয়ে থাকেন গোলরক্ষক বার্নড লেনো। পেনাল্টি বক্সের মধ্যে গোললাইন বরাবর ঠিক লেনোর দুপাশে দুই সেন্টারব্যাক থাকেন (কালকের ম্যাচে ডানদিকে ছিলে রব হোল্ডিং, বাঁদিকে কিয়েরান টিয়েরনি)। একদম ডানদিকের টাচলাইনে থাকেন রাইটব্যাক (হেক্টর বেয়েরিন), বাঁ দিকের টাচলাইনে লেফটব্যাক (এইন্সলি মাইটল্যান্ড-নাইলস)। গোলরক্ষকের সামনের ফাঁকা জায়গায় পেনাল্টি স্পট বরাবর নেমে আসেন গ্রানিত জাকা কিংবা মোহাম্মদ এলনেনির মধ্যকার কোনো একজন মিডফিল্ডার। পরিস্থিতি যা-ই হোক না কেন, গোলরক্ষক দুই সেন্টারব্যাকের একজন বা নিচে নেমে আসা মিডফিল্ডারকে পাস দেওয়ার মাধ্যমেই আক্রমণ রচনা করা শুরু করে দেন।

এতে যা হয়, প্রতিপক্ষ প্রেস করার জন্য উৎসাহী হয়। গোটা দল ওপরে উঠে আসে। প্রতিপক্ষের ডিফেন্ডাররাও দেখা যায় মিডফিল্ডে চলে আসেন। তখন আর্সেনালের অধিনায়ক ও লেফট উইঙ্গার পিয়ের-এমেরিক অবামেয়াং অপেক্ষা করতে থাকেন প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের মাঝে। কোনোভাবে প্রেস অতিক্রম করে অবামেয়াংয়ের পায়ে বল গেলেই কেল্লাফতে। দ্রুত প্রতি-আক্রমণে গোল করতে সমস্যা হয় না গ্যাবনিজ এই স্ট্রাইকারের।

অবামেয়াং ছিলেন নিষ্প্রভ।

যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত উপায়, কিন্তু আপনার খেলোয়াড় যদি প্রতিপক্ষের প্রেসে নিয়মিত খাবি খেতে থাকে, তাহলে এই কৌশল বুমেরাং হয়ে যায়। যেমনটা হয়েছে কাল। প্রায় পুরোটা ম্যাচ লিভারপুলের প্রেসে হাঁসফাঁস করেছে আর্সেনাল। দ্বিতীয়ার্ধে ছোট ছোট পাস দিয়ে রক্ষণভাগ থেকে মিডফিল্ড হয়ে বলকে আক্রমণভাগে নিয়ে যেতে পারেনি। হ্যাঁ, পেরেছে তখনই, যখন নিজেদের অর্ধ থেকে আর্সেনালের কেউ নিখুঁত একটা লং পাস বা উড়ন্ত বল দিয়ে লিভারপুলের ওপরে উঠে আসা রক্ষণভাগ ভেদ করতে পেরেছেন।

আর্সেনালের খেলোয়াড়েরা লিভারপুলের মতো নিরন্তর প্রেস করা দলের বিপক্ষে নিজ অর্ধেই প্রেসে খাবি খাচ্ছে, এমনটা দেখার পর আরতেতা চাইলেই অন্তত এই ম্যাচের জন্য এই কৌশল বাতিল করতে পারতেন। কিন্তু সেটা করেননি। যার মাশুল শেষমেশ দিয়েছে আর্সেনাল, এক গোলে এগিয়ে থাকার পরেও তিন গোল খেয়ে।

এই এক একগুঁয়েমি না করলে হয়তো আরেকটু প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ম্যাচ হতো গত রাতে!