Thank you for trying Sticky AMP!!

আর্জেন্টিনার ফুটবল খুন করছে যারা

সেমিফাইনালে যেতে পারবে মেসি-মার্টিনেজরা? ছবি: টুইটার
>পোর্তো আলেগ্রের অ্যারেনা দো গ্রেমিওতে কাতারের বিপক্ষে গত রাতে ২-০ গোলে জিতেছে আর্জেন্টিনা। ম্যাচ জিতে কোনোভাবে কোয়ার্টারে উঠলেও এভাবে আর কতকাল?

খোঁড়াতে খোঁড়াতে কোপা অভিযান শুরু করেছে আর্জেন্টিনা। কোপা আমেরিকায় কলম্বিয়া এবং প্যারাগুয়ের সঙ্গে জয়বঞ্চিত তারা। যে টুর্নামেন্টের শিরোপায় ঠাসা আলবিসেলেস্তেদের ট্রফি কেস, সেই আরাধ্য টুর্নামেন্টের গ্রুপ পর্ব পেরোতেই কি না, এবার গলদঘর্ম হতে হচ্ছে। ২০১৮ বিশ্বকাপেও তাদের একই অবস্থা ছিল, গ্রুপ পর্বের দুই ম্যাচ শেষে পয়েন্ট টেবিলের তলানিতে ছিলেন মেসিরা। শেষ ম্যাচে কাতারকে হারালেও প্রশ্ন উঠেছে, এই অরাজক পরিস্থিতির মধ্যে আর্জেন্টিনার ফুটবল আদৌ কিছু জিততে পারবে কি?

কোচ বদলেছে, খেলোয়াড়দের মাঝেও অনেক বদল এসেছে, কিন্তু বদলায়নি তাদের ফুটবলের চালচিত্র। ২০১৫ ও ২০১৬ আসরের ফাইনালিস্টদের ফুটবল যে পতনের দ্বারপ্রান্তে, তা অস্বীকারের জো নেই। কাতারকে হারিয়ে কোয়ার্টারে উঠলেও, সেমিতে ওঠার লড়াইতে যে ভেনেজুয়েলাকে হারাতে পারবে, সে কথাটা কি জোর দিয়ে বলা যায়?

আর্জেন্টিনার ফুটবলের এই যে জঘন্য অবস্থা, তার পেছনে ভূমিকা রেখেছে বছরের পর বছর ধরে চলা অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা এবং সেগুলোর সমাধানে কোনো দৃশ্যমান পদক্ষেপের অভাব। আর্জেন্টিনার ফুটবলে সমস্যার মূলটা যেন একদম ভেতরে প্রোথিত। ওপর থেকে নিচ পর্যন্ত প্রতিটি পদেই অনিয়ম আর অস্বচ্ছতার মচ্ছব। প্রায় ৩৫ বছর সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর অসংখ্য দুর্নীতি এবং মাফিয়াসুলভ আচরণের অভিযোগ মাথায় নিয়ে হুলিও হুম্বের্তো গ্রন্দোনা ধরাধামের মায়া ত্যাগ করেন। গ্রন্দোনা যাওয়ার পরেও অরাজক অবস্থার উন্নতি হয়নি। একটি কারণে লোকে তবুও গ্রন্দোনাকে মনে রাখবে, কারণ তাঁর আমলে অন্তত 'সময়মতো ট্রেন ছেড়েছিল'। মানে ফুটবলীয় কার্যক্রমগুলো অন্তত বিনা ঝক্কিতে পরিচালিত হতো তাঁর সময়ে। কিন্তু জোড়াতালি দেওয়া আর্জেন্টিনার ফুটবলের দায়ভার যখন ক্লদিও তাপিয়ার ওপর এসে পড়ে, তখন শুরু হয় চূড়ান্ত হট্টগোল।

সভাপতি পদে তাপিয়া আসার পর আর্জেন্টিনার বলার মতো তো দূরের কথা, মুখ বাঁচানোর মতো কোনো অর্জনও নেই। তাঁর আমলে ১১টি প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলে মাত্র তিনটিতে জয় পেয়েছে আর্জেন্টিনা। এর একটি ২০১৮ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচে ইকুয়েডরের বিপক্ষে আর অপরটি বিশ্বকাপের মূল আসরে নাইজেরিয়ার বিপক্ষে। শেষ জয় এসেছে গতকাল। তাঁর আমলে বড় আসরগুলোতে প্রায় জিততে ভুলে গেছেন মেসি-আগুয়েরোরা। আর্জেন্টিনার ফুটবলের সঙ্গে যুক্ত অনেকে তাই রসাত্মকভাবে বলে থাকেন, মেসির সঙ্গে উষ্ণ সম্পর্ক রক্ষা এবং সেলফি তোলার মাঝেই তাপিয়ার সফলতা নিহিত।

২০১৪ বিশ্বকাপ ফাইনালের পর আলেজান্দ্রো সাবেলার বিদায়ের পর থেকেই আর্জেন্টিনার কোচের পদ নিয়ে জটিলতা চলছে। সাবেলা চার বছর দায়িত্ব পালন করে গেলেও তাঁর ৪ জন উত্তরসূরির মাঝে শুধু জেরার্ডো মার্টিনো অন্তত দুই বছর দায়িত্বে ছিলেন। কোচ নিয়োগ দেওয়ার বিষয়েও ক্লদিও তাপিয়া বেশ খামখেয়ালি। কাউকে মাথায় তুলতে যেমন কুণ্ঠা করেন না, তেমনি আশানুরূপ ফল না এলে সেই ব্যক্তিকে ছুড়ে ফেলতেও বাধে না তাঁর। ২০১৭ সালে সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই এডগার্ডো বাউজাকে কোচের পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে হোর্হে সাম্পাওলির হাতে দায়িত্ব তুলে দেন। সে সময় সাম্পাওলিকে ‘বিশ্বের সেরা কোচ’ হিসেবে আখ্যা দেন তিনি। অথচ বিশ্বকাপে ভরাডুবির পর সাম্পাওলিকে অবলীলায় পদচ্যুত করেছেন। আর এভাবে কোচদের সরিয়ে দেওয়ার ফলে বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। এই যেমন চুক্তিগত কারণে ২০১৬ সালে পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরও টাটা মার্টিনোকে ২০১৮ পর্যন্ত বেতন দিয়েছে এফএ। তাই সস্তায় ভালো মানের কোনো কোচ না পেয়ে শেষে সাম্পাওলির সহকারী লিওনেল স্কালোনির হাতে জাতীয় দলের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়। অথচ সিনিয়র পর্যায়ে কোচিংয়ের কোনো অভিজ্ঞতাই নেই কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনার ভার কাঁধে নেওয়া স্কালোনির।

সাম্পাওলির কাছ থেকে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১১ টি ম্যাচে ১১টি ভিন্ন একাদশ মাঠে নামিয়েছেন স্কালোনি। ঠিক একই রকম অতি-পরিবর্তনের ধকল সামলে উঠতে না পেরে কিন্তু সাম্পাওলির বিপক্ষে বিশ্বকাপের সময় প্রায় বিদ্রোহের পথে পা বাড়িয়েছিলেন মেসি-ডি মারিয়ারা। অবশ্য স্কালোনিই বা কী করবেন, খেলোয়াড়েরা যদি মাঠে তাঁদের সবটুকু দিয়ে পারফর্ম না করেন! অনেক অদল-বদলের মাঝেও সাম্পাওলির দলে জিওভানি লো সেলসো, জার্মান পেজেল্লা, রদ্রিগো ডি পল, লাউতারো মার্টিনেজ এবং লিয়ান্দ্রো পারেদেস নিয়মিত ছিলেন। কিন্তু আর্জেন্টিনা দলে তাঁদের পূর্বসূরিদের নামের প্রতি কতটা সুবিচার করতে পেরেছেন তাঁরা, তাঁর উত্তর কারও অজানা নেই।

কোপা আমেরিকা শুরুর আগেই এবার মেসি বলেছেন, ‘অন্যান্য বারের মতো আমরা এবার ফেবারিট নই।’ মেসি সত্যি কথাটাই সোজা ভাষায় বলে দিয়েছেন। কিন্তু আর্জেন্টিনার চিরাচরিত ফুটবল শিল্পের এ যুগের বার্তাবাহক মেসি যখন নিজেদের অসহায়ত্বের কথা মুখ ফুটে বলে দেন, তখন তা দলের মাঝে আত্মবিশ্বাসের প্রবল সংকটকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।

মেসি কখনোই তুখোড় নেতৃত্বের জন্য বিখ্যাত নন। মাঠে ফুটবলীয় কারিকুরি দেখানোতেই তার শ্রেষ্ঠত্ব। কিন্তু দল যখন বিপদে, দিশেহারা হয়ে ক্রমেই হারের দিকে ধাবিত হচ্ছে; সেই মুহূর্তগুলোতে দলের প্রয়োজন প্রেরণাদায়ী কিছু কথা, দলকে চাঙা করার রসদ হিসেবে যা কাজ করবে। কিন্তু অধিনায়ক মেসি বা আগুয়েরো-ডি মারিয়াদের মতো সিনিয়ররা কেউই তাঁদের অনুপ্রেরণাদায়ী উপস্থিতির জন্য বিখ্যাত নন।

কাতারের বিপক্ষে জয়টা নিয়ে কোয়ার্টারে উঠলেও, এই অবস্থায় সেমিতে কি পারবে আর্জেন্টিনা? এভাবেই কি চলবে আর্জেন্টিনার ফুটবল? একজন অনভিজ্ঞ কোচ, একটা দল যারা সাফল্য বাদ থাক, অন্তত মনকাড়া খেলাও উপহার দিতে পারছে না; একজন অধিনায়ক, যিনি নিজের কারিকুরি দেখাতে পটু, কিন্তু দলকে বিপদের মুহূর্তে উজ্জীবিত করতে অপারগ। এই সব ভঙ্গুর অনুষঙ্গে ভর করে আর কত দিন চলবে আর্জেন্টিনার ফুটবল?