Thank you for trying Sticky AMP!!

এমন পরিবেশে থেকেই খেলছেন আজমপুরের ফুটবলাররা

কেউ রেল লাইনের ধারে, কেউ অন্যের ঘরে

উত্তরার ৪ নম্বরের সেক্টরের ১৯ নম্বর রোডের শেষে দেয়ালে লেখা ‘মানবতার দেয়াল’, তার ওপর ঝুলছে আজমপুর স্পোর্টিং ক্লাব উত্তরার সাইনবোর্ড। কিন্তু ছোট গেট পার হয়ে ক্লাবে ঢুকলে অমানবিক জীবনযাপনের চিত্রই বেরিয়ে আসে।

একটি কক্ষে ১৫টি বিছানা, অন্যটিতে ১৪টি। এই দুই কক্ষে গাদাগাদি করে থাকেন ২৫ জন খেলোয়াড়। কক্ষে নেই পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা। কক্ষের মধ্যে বুট-জার্সি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকায় উটকো গন্ধ ছড়ায়।

বাংলাদেশ রেলওয়ের জমি ভাড়া নিয়ে রেললাইনের পাশে তৈরি করা হয়েছে একতলা টিনশেডের আজমপুর ক্লাব। একটু পরপর ট্রেন যাওয়া–আসার শব্দে সেখানে কান পাতা দায়। ক্লাবের এক খেলোয়াড় মজা করে বলছিলেন, ‘এখন হর্নের আওয়াজ শুনেই বুঝি এটা বনলতা এক্সপ্রেস না সিলেটের ট্রেন।’

বাংলাদেশের ফুটবলের দ্বিতীয় স্তরের লিগের একটি ক্লাবের খেলোয়াড়দের থাকার পরিবেশ এমনই

এই আজমপুর ক্লাবটিই এখন পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে পাতানো খেলার অভিযোগে বাফুফের কাঠগড়ায়। অভিযোগ তুলেছেন ক্লাবেরই প্রধান কোচ সাইফুর রহমান (মনি)।

জাতীয় দলের সাবেক এই স্ট্রাইকার গত ২৭ মার্চ পদত্যাগ করেছেন আজমপুর ক্লাবের প্রধান কোচের পদ থেকে। তাঁর অভিযোগের তির ক্লাব সভাপতি সাইদুর রহমানের দিকে। তবে সাইদুর রহমান ম্যাচ পাতানোর বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন।

এ বছর ক্লাবটির বাজেট এক কোটি টাকা বলে জানিয়েছেন ক্লাব সভাপতি। তবে খেলোয়াড়দের প্রয়োজন মেটাতে না পারার হতাশাও আছে তাঁর, ‘কয়েকটি বেসরকারি কোম্পানি ও এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা ক্লাবের পৃষ্ঠপোষকতা করছেন।

রেল লাইনের পাশে আজমপুর ফুটবল ক্লাব উত্তরা

তবে অর্থনৈতিক সমস্যা থাকায় কিছু খেলোয়াড়ের টাকা এখনো দিতে পারিনি। খেলোয়াড়দের এভাবে থাকা কষ্ট, সেটাও আমরা বুঝি। খেলোয়াড়দের রাখার জন্য ফ্ল্যাট খুঁজেছিলাম, কিন্তু ব্যাচেলর থাকতে দেবে না বিধায় পাইনি।’

এই ক্লাবটিকেই দ্বিতীয় বিভাগ থেকে এবার সরাসরি দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের ফুটবলের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলার সুযোগ দিয়েছে বাফুফে। গত দুই মৌসুমে ফর্টিজ ফুটবল ক্লাব, উত্তরা ফুটবল ক্লাব, বাফুফে এলিট একাডেমি, গোপালগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবকেও সরাসরি চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলার সুযোগ দিয়েছে বাফুফে। কিন্তু ফর্টিজ ছাড়া চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে বাকি দলগুলোর অবস্থান ভালো নয়।

গোপালগঞ্জ ক্লাবের তো নিজস্ব থাকার জায়গাই নেই। খেলোয়াড়দের রাখা হয়েছে ব্রাদার্স ইউনিয়ন ক্লাবে। অথচ এই ক্লাবগুলোর অবকাঠামোগত ভালো সুযোগ–সুবিধা আছে নিশ্চিত হয়েই বাফুফে তাদের চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে সরাসরি সুযোগ দিয়েছে। অন্তত বাফুফে সে রকমই বলছে।

এটা একটা ফুটবল ক্লাব

২০২০ সালে সরাসরি বিসিএলে খেলার সুযোগ দেওয়া হয় উত্তরা ক্লাবকে। উত্তরার ১৪ নম্বর সেক্টরে রাজউকের জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত ক্লাবটি একতলা টিনশেড ভবন। গত বছর অভিষেকেই নিজ দলের মধ্যে ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগ তুলে পদত্যাগ করেন দলটির প্রধান কোচ।

সেই কোচ প্রথম আলোকে বলেন, ‘লিগের প্রথম পর্বের ৩-৪ ম্যাচ যাওয়ার পরেই বুঝতে পারি দলের মধ্যে সমস্যা আছে। কয়েকজন খেলোয়াড়ের আচরণে আমি অবাক হই। বিষয়টি আমি বাফুফে সাধারণ সম্পাদককেও জানিয়েছিলাম। পরে ৫ ম্যাচ শেষে পদত্যাগ করি।’

উত্তরা ক্লাবের বিভিন্ন সূত্র জানায়, ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগে এ মৌসুমের আগে ক্লাবটির সভাপতির পদ থেকে মিজানুর রহমানকে (মিয়া ভাই) সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে মিজানুর রহমানের দাবি, ‘ক্লাব চালাতে যে আর্থিক সমর্থন দরকার ছিল, সেটা জোগাড় করতে পারছিলাম না। এ ছাড়া আমার ব্যবসায়িক ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় ক্লাব থেকে পদত্যাগ করি।’

ব্রাদার্স ইউনিয়নের ক্লাবে থাকে গোপালগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের খেলোয়াড়েরা

কিন্তু ব্যস্ততার জন্যই যদি পদত্যাগ করেন, তাহলে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্র ও গোপালগঞ্জে ক্লাবের কর্মকর্তা হওয়ারও চেষ্টা করেছিলেন কেন?

খোদ মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘গত বছর উনি (মিজানুর) আমার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু আমার কাছে বিষয়টি ভালো মনে হয়নি বলে আমি রাজি হইনি।’

এ বছর সরাসরি বিসিএলে খেলার সুযোগ পাওয়া গোপালগঞ্জকেও নাকি বড় প্রস্তাব দিয়েছিলেন মিজানুর। ক্লাবটির ম্যানেজার মামুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিনি (মিজানুর) আমাদের পৃষ্ঠপোষকতা করে পুরো ক্লাবের খরচ বহন করতে চেয়েছিলেন। বিনিময়ে ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান হতে চেয়েছিলেন। সঙ্গে সম্পাদক, কোচ, খেলোয়াড়ও ওনার মতো করে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু আমরা রাজি হইনি।’

মুক্তিযোদ্ধা ও গোপালগঞ্জের বিষয়টি মিজানুরকে জানানো হলে তাঁর পাল্টা জবাব, ‘মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের কর্মকর্তা হওয়ার কোনো চেষ্টা আমি করিনি। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আমার খুব পরিচিত, উনি আমাকে বলেছিলেন আপনি যেহেতু ফুটবলের লোক। আমাদের ক্লাবটার অবস্থাও ভালো নয়। আপনি ক্লাবটির দায়িত্ব নিন। তেমনি গোপালগঞ্জও আমাকে ডেকেছিল তাদের ফুটবল কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য।’

তাঁর বিপক্ষে যে ম্যাচে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ উঠেছে, সেটি উড়িয়ে দিয়ে মিজানুরের কথা, ‘গত বছর আমার দলের সাত খেলোয়াড়ের ব্যাপারে আমার সন্দেহ হয়। তাদের খেলা দেখে মনে হচ্ছিল তারা অন্য কারও কথা শোনে। সাত ম্যাচ শেষে সেই সাত খেলোয়াড়ের ব্যাপারে বাফুফেকে আমি চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলামও। কেউ যদি আমাকে এই বিষয়গুলোর সঙ্গে এক ভাগও প্রমাণ করতে পারেন, আমি যেকোনো শাস্তি মেনে নেব।’

উত্তরা ফুটবল ক্লাবের খেলোয়াড় ও কর্মকর্তারা

প্রশ্ন হচ্ছে, বাফুফে কেন অনেকটা চালচুলোহীন এই ক্লাবগুলোকে সরাসরি চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলার সুযোগ দেয়?

বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটির চেয়ারম্যান ও বাফুফের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি সালাম মুর্শেদী প্রথম আলোকে বলেন, ‘কিছু শর্ত মেনেই আমরা ক্লাবগুলোকে সুযোগ দিয়েছি। তাদের ক্লাব অবকাঠামো, আর্থিক অবস্থা সন্তোষজনক ছিল। এ ছাড়া আমাদেরও ক্লাব বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল, তাই তাদের আবেদন বিবেচনা করে সুযোগ দেওয়া হয়েছে।’

কিন্তু এভাবে সুযোগ পেয়ে অনেক ক্লাবই দেশের ফুটবলে ফিক্সিংয়ে জড়িয়ে পড়ছে। কলুষিত হচ্ছে ফুটবল।