Thank you for trying Sticky AMP!!

পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা পেয়েছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনা।ছবিটি ইতালির নেপলসে তোলা

ম্যারাডোনা যদি আসতেন এই বাংলায়

ম্যারাডোনা কখনো বাংলাদেশে এলে তাঁর ভালো লাগত নিশ্চিত। মানুষের ভালোবাসার বৃষ্টিতে ভিজতেন। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের ঘাসে তাঁর পা পড়ত। মাঠে ঢুকেই দর্শকদের উদ্দেশে ছুড়ে দিতেন উড়ন্ত চুম্বন। বলে লাথি মারতেন নিজস্ব ভঙ্গিতে।

বল শিল্প ভবনের ছাদ অবধি উঠে যেত হয়তোবা। ছবি তোলার হুড়োহুড়ির মধ্যে ফটোগ্রাফাররা বারবার বলতেন, ‘ডিয়েগো...ডিয়েগো...প্লিজ লুক...লুক।’

আমাদেরই দুর্ভাগ্য, বাংলাদেশে কখনো আসেননি ফুটবল–জাদুকর। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে অবশ্য তাঁকে ঢাকায় আনার ঘোষণা দিয়েছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।

ম্যারাডোনার এজেন্টের সঙ্গে নাকি কথাও হয়েছিল তাঁর। সব ঠিক থাকলে এবং ম্যারাডোনার শরীর সাড়া দিলে কে জানে হয়তো এ বছর আমরা তাঁকে ঢাকায় দেখতে পেতাম।

পাশের বাড়ি কলকাতায় ২০০৮ ও ২০১৭ সালে ঘুরে গেছেন ম্যারাডোনা। আশাবাদী হওয়ার তাই যথেষ্ট কারণ ছিল। কিন্তু বাদ সাধল গোটা পৃথিবীকে স্তব্ধ করে দেওয়া করোনা-অতিমারি।

বোকা জুনিয়র্সের জার্সি পরে আর্জেন্টিনার প্রেসিডেনশিয়াল প্যালেস কাসা রোসাদায় ম্যারাডোনাকে শেষবারের মতো দেখতে যাচ্ছেন ভক্তরা। আহা! ভালোবাসা!

ম্যারাডোনার উত্তরসূরি লিওনেল মেসি ঢাকায় আসেন ২০১১ সালে। নাইজেরিয়ার বিপক্ষে পুরো শক্তির আর্জেন্টিনা প্রীতি ম্যাচ খেলে গেছে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে। ২০০৬ সালে ঢাকায় পা রাখেন ফরাসি কিংবদন্তি জিনেদিন জিদান।

রোমাঞ্চকর একটা পরিবেশ তখনই তৈরি হয়েছিল ঢাকায়। ম্যারাডোনা কখনো ঢাকায় এলে কী কী হতো, ভাবতেই শিহরণ লাগছে। বিমানবন্দর থেকে বেরোতেই হয়তো তাঁর কয়েক ঘণ্টা লেগে যেত। তাঁকে দেখতে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারি ভরে যেত নিশ্চিত।

ম্যারাডোনাও দেখে যেতে পারতেন বাংলাদেশে তাঁকে নিয়ে উন্মাদনার পারদ কোথায় ওঠে? অবশ্য তিনি কখনো বাংলাদেশে না এলেও বাংলাদেশ দু-চারজন ক্রীড়া সাংবাদিক সুযোগ পেয়ে এই দেশের কথা তাঁর সামনে তুলে ধরেছেন।

তাঁকে স্মারক উপহার দিয়েছেন। ম্যারাডোনা এ দেশে আসেননি, কিন্তু শুনেছেন দেশটির কথা। যে দেশের গ্রামগঞ্জে আজও ফুটবল ম্যাচ দেখতে লোকে গাছের ডালে উঠে যায়।

বুয়েনস এইরেসে এক রেসিং প্রতিযোগিতায় ম্যারাডোনার ১০ নম্বর জার্সি দেখিয়ে এভাবেই সম্মান জানান ব্রাজিলের সাবেক ফর্মূলা ওয়ান চালক রুবেনস বারিচেল্লো

১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পর ঢাকার ফুটবল লিগ নিয়ে আকর্ষণ তৈরি হতে থাকে। ১৯৫০-৭০–এর দশকে ফুটবল দিনে দিনে পেয়েছে আরও জনপ্রিয়তা। আশির দশকে বাংলাদেশে ফুটবলের তুঙ্গস্পর্শী আবেদনে ম্যারাডোনার ছায়াও এসে পড়ে দারুণভাবে।

১৯৮২ সালের বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা ছিলেন নবীন। তবে স্পেন বিশ্বকাপে ম্যারাডোনা খেললেও তিনি ম্যারাডোনা হয়ে ওঠেন ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে। ফুটবল আর ম্যারাডোনা শব্দ দুটি যেন সমার্থক হয়ে যায় তখন নতুন প্রজন্মের কাছে।

ম্যারাডোনার লাখ লাখ সমর্থক গড়ে ওঠে বাংলাদেশে। ম্যারাডোনা সমর্থকগোষ্ঠী হয়। হোটেল, রেস্টুরেন্ট, সেলুন ইত্যাদির নামকরণ হতে থাকে ম্যারাডোনার নামে।

বাংলাদেশে তখন ফুটবল মানেই আবাহনী-মোহামেডান দুই শিবিরে ভাগ হয়ে যাওয়া। ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে অজপাড়াগাঁওয়ের চায়ের দোকানেও তর্কবিতর্কের ঝড়। ওই সময় টেলিভিশন আসা শুরু হলো মফস্বলে। সেই সুবাদে ১৯৮৬ বিশ্বকাপটাই গ্রামবাংলার অনেকের কাছেই পৌঁছে গেল।

ম্যারাডোনার মৃত্যূতে এভাবেই কেঁদেছেন ভক্তরা

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে বলি, মেক্সিকো বিশ্বকাপের সময় গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জে থাকলেও বিশ্বকাপ দেখার স্বাদ পুরোপুরিই নেওয়া গেছে। বাড়ির সামনেই পদ্মা বাজারে এক চায়ের দোকানে ছিল ২০ ইঞ্চি সাদাকালো টিভি।

গ্রামে তখনো বিদ্যুৎ না যাওয়ায় ব্যাটারি দিয়ে টেলিভিশন চালিয়ে বিশ্বকাপ দেখার ব্যবস্থা হলো। তখন থেকেই ম্যারাডোনা নামটা মনে গেঁথে যায়।

১৯৯০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার সমর্থন আরও বাড়ে। গ্রামগঞ্জে, হাটে-মাঠে সর্বত্র ম্যারাডোনা...ম্যারাডোনা। বাংলাদেশের ফুটবল মানচিত্রে এই নাম খোদাই হতে শুরু করে তখন থেকেই।

গোটা দেশই ভক্ত হয়ে যায় ৫ ফুট ৫ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটার। এ দেশের আবালবৃদ্ধবনিতাকে টেলিভিশনের সামনে বসিয়েছেন ম্যারাডোনা। কত তরুণকে খেলার মাঠে টেনে এনেছেন হিসাব নেই।

তাঁর খেলা দেখেই বাংলাদেশের আশির দশকের প্রজন্ম ফুটবলের প্রেমে হাবুডুবু খেতে থাকে। ১৯৮৬ সালেই শুরু হয় সাভারে বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিকেএসপির যাত্রা। এখন ক্রিকেটের জয়জয়কার হলেও তখন ফুটবলে ভর্তি হওয়ারই প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল বাড়ন্ত কিশোরদের।

দেশীয় ফুটবলাররাও ওই সময় বিরাট তারকা। শেখ আসলাম, কায়সার হামিদ, মোনেম মুন্না, সৈয়দ রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বিরদের খেলা দেখতে স্টেডিয়াম ভেঙে পড়ে দর্শকে।

ম্যারাডোনার জন্য ভক্তদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। বুয়েনস এইরেস, আর্জেন্টিনায়

আমজনতার ভালোবাসার পাত্র তখন ডিয়েগো ম্যারাডোনা। মাঠে তাঁর চলাফেরা, শুটিং, ড্রিবলিং—সবই অনুকরণ করতেন বাংলাদেশের ফুটবলাররা। ম্যারাডোনা মানে তখন স্বপ্নের পুরুষ।

এমন বিরল প্রতিভার ফুটবলজাদু দেখতে পারাটাই স্বপ্নের মতো ছিল শেখ আসলামদের কাছ। ঢাকা লিগে সর্বোচ্চ পাঁচবারের সর্বোচ্চ গোলদাতা আসলাম সেই স্মৃতি তুলে এনে আপ্লুত, ‘ম্যারাডোনা তখন আমাদের কতটা অনুপ্রাণিত করেছিলেন, ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। বিশেষ করে অল্প জায়গা থেকে তাঁর গোল করার যে ঢং, এটি ম্যারাডোনা ছাড়া আর কারও পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমিও চেষ্টা করতাম অনুশীলনে এগুলো রপ্ত করতে। সবাইকে ফাঁকি দিয়ে তিনি যেভাবে বল পায়ে এগিয়ে যেতেন, অবিশ্বাস্য লাগত।’

শুধু আসলাম নন, অনেক ফুটবলারের ওপরই ম্যারাডোনার প্রভাব পড়ে আশি-নব্বই দশকে। সাব্বিরকে তো তাঁর সমর্থকেরা আদর করে ‘বাংলার ম্যারাডোনা’ই ডাকতেন।

ম্যারাডোনা ১০ নম্বর জার্সি পরতেন। ঢাকার ফুটবলেও তখন ১০ নম্বরের বিশাল কদর। নব্বই দশকে দেশের ফুটবলে ফুল হয়ে ফোটা আলফাজ আহমেদের ১০ নম্বরের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার বড় কারণও ছিলেন ম্যারাডোনা।

যে জনপ্রিয়তা তৈরি করে গেছেন ম্যারাডোনা, তাতে অমর হয়ে রইবেন ফুটবল ইতিহাসে

তুখোড় এই স্ট্রাইকার বলছিলেন, ‘ম্যারাডোনার খেলা দেখে এতই মোহাবিষ্ট হয়েছিলাম যে শয়নে–স্বপনে তাঁকে অনুকরণ করতে চাইতাম। আমার খেলোয়াড়ি জীবনে ম্যারাডোনার রয়েছে বিশাল প্রভাব।’

বাংলাদেশ জাতীয় দলের বর্তমান ফুটবলারদের জন্ম ম্যারাডোনা-ঝলকের পর। তাঁরা ম্যারাডোনার খেলা টেলিভিশনে সরাসরি দেখেননি। তাঁর কথা শুনে শুনেই ভক্তের খাতায় নাম লিখিয়েছেন। ম্যারাডোনার প্রয়াণে তাই দোহায় অবস্থানরত বাংলাদেশের ফুটবলাররাও শোকস্তব্ধ।

বাংলাদেশের ফুটবলারদের মনে ম্যারাডোনার প্রবল উপস্থিতি আশির দশকে তাঁর আবির্ভাবের পর থেকেই। কিন্তু এই ফুটবলশিল্পীকে ঘিরে তৈরি হওয়া উন্মাদনা কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের ফুটবল কতটা সামনে এগোতে পারল?

ম্যারাডোনাকে হারানোর শোকের মধ্যেও প্রশ্নটা মনে উঁকি দেয় বৈকি। উত্তরও জানা। এগোতে পারেনি, বরং পিছিয়েছে। বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলের আজকের দর্শকখরাই এর বড় প্রমাণ। যে দেশে ম্যারাডোনার লাখ লাখ ভক্ত, সেই দেশের ফুটবল হারিয়ে ফেলেছে তার অতীত উন্মাদনা।

ম্যারাডোনা জানলে নির্ঘাত দুঃখ পেতেন।