Thank you for trying Sticky AMP!!

যে তারকার চোটে কেঁদেছিল বাংলাদেশ

দেশকে আন্তর্জাতিক সাফল্য উপহার দিতে না পারার আক্ষেপ আছে সাব্বিরের। ছবি: সংগৃহীত

সেই সন্ধ্যাটা ছিল ভয়ংকর। বৃষ্টিভেজা সেই সন্ধ্যাতে খেলার মাঠের এক ঘটনা বিমূঢ় করে দিয়েছিল গোটা দেশকে। দেশের সেরা ফুটবলারের চোট শঙ্কিত করে তুলেছিল সবাইকে। গোলযোগ ছড়িয়ে পড়েছিল শহরে। পরদিন দৈনিক পত্রিকার প্রথম পাতায় ব্যানার শিরোনাম এখনো মনে করতে পারেন অনেকে—দেশে যেন বড় কোনো বিপর্যয়ই ঘটে গেছে!

২৬ বছর আগে, ১৯৯৪ সালের সেই সন্ধ্যায় প্রিমিয়ার ফুটবল লিগের খেলা চলছিল মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব ও পিডব্লুডির মধ্যে। সরকারি সংস্থা গণপূর্ত অধিদপ্তরের ফুটবল দল এই পিডব্লুডির অস্তিত্ব দেশের ফুটবলে এখন আর নেই। যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন এই পিডব্লুডি ছিল দেশের ফুটবলের মাঝারি মানের শক্তি। আবাহনী–মোহামেডান–ব্রাদার্সের মতো বড় দলগুলোক 'ধরা' খাওয়াতো এই দলটি প্রায়ই। ধরা খাওয়ানো বলতে যে পয়েন্ট কেড়ে নেওয়া—সেটা হয়তো বুঝতে পারবেন অনেকেই।


সেদিন পিডব্লুডির বিপক্ষে ম্যাচেই তাদের গোলরক্ষকের রাফ ট্যাকলে হাঁটু গুঁড়ো হয়ে গিয়েছিল দেশসেরা তারকা রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বিরের। ফুটবল মাঠে চোট সাধারণ ঘটনাই। কিন্তু সেদিন সাব্বিরের চোট কোনো সাধারণ কিছু ছিল না। আজ থেকে ২৬ বছর আগে ফুটবল নিয়ে, মোহামেডান, আবাহনীর মতো ক্লাবগুলো নিয়ে মানুষের যে আবেগ, সেই আবেগের বিস্ফোরণ ঘটেছিল সাব্বিরের চোটে। পরদিন দৈনিকে স্ট্রেচারে করে সাব্বিরকে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তিনি হাঁটু ভাঁজ করতে পারছেন না। পাশে দাঁড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদছেন মোহামেডান দলে সাব্বিরের সতীর্থরা— এ ছবিটি একটা প্রজন্মের ফুটবলপ্রেমীদের মানসপটে এখনো নাড়া দেয়। ১৯৯৪ সালের লিগে সাব্বিরের সেই চোট তাঁর ক্যারিয়ারকে প্রায় শেষ করে দিয়েছিল। দেড় বছর চিকিৎসা শেষে তিনি ফিরেছিলেন ১৯৯৬ সালে, মোহামেডানের জার্সিতেই। সে মৌসুমে তাঁর 'কামব্যাক' ছিল রাজকীয়ই। কিন্তু ক্যারিয়ারটা খুব বড় করতে পারেননি তিনি। ১৯৯৭ সালে মাত্র ৩২ বছর বয়সেই অবসরের ডাক দেন স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের ফুটবলের সেরা এই 'প্লেমেকার'। ফুটবল দর্শকেরা তাঁকে 'ঢাকার ম্যারাডোনা' নামে ডেকেও আনন্দ পেত।


নিজের চোটের সেই দুঃস্বপ্ন আজও তাড়িয়ে বেড়ায় সাব্বিরকে। তবে তিনি কাউকে দোষারোপ করেন না, 'খেলায় তো অনেক কিছুই হয়। তবে সেদিন পিডব্লুডির গোলরক্ষক সোহান কিছুটা বাড়াবাড়ি করেছিল।, সেটাও খেলার অংশ। আমি ভুলে যেতে চাই। তবে এটা ঠিক, ওই চোট আমার ক্যারিয়ারকে সংক্ষিপ্ত করে ফেলেছিল। চোটটা যখন পাই, তখন আমি ফর্মের তুঙ্গে। ওটা না হলে খুব সহজেই ২০০০ সাল পর্যন্ত আমি খেলে যেতে পারতাম।'


সেদিনের ঘটনাটা স্পষ্টই মনে আছে সাব্বিরের, 'ডানপ্রান্ত থেকে একটা বল এসেছিল। ক্রসটা কে করেছিল মনে নেই। আমি বলটা এয়ারে থাকা অবস্থাতেই ফ্লিক করে দ্বিতীয় বার দিয়ে গোল করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু পিডব্লুডির গোলরক্ষক আমার শরীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমি পড়ে যাই। সে দ্বিতীয়বার ঝাঁপটা দেয় বেকায়দায় থাকা আমার পায়ের ওপর। সঙ্গে সঙ্গেই আমি বুঝতে পারি, ভয়ংকর কিছু ঘটে গেছে। আমি পা'টা সোজাই করতে পারছিলাম না।'


সে সময়কার দেশের বিখ্যাত শল্য চিকিৎসক ডা. সালেকের প্রতি কৃতজ্ঞ সাব্বির, 'সালেক সাহেব আমার হাঁটুতে প্রথম অস্ত্রোপচার করেন। প্রাথমিক চিকিৎসাটা খুব ভালো হয়েছিল। পরে যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা করাতে যাই। সেখানকার চিকিৎসকেরাও প্রথম অস্ত্রোপচারের প্রশংসা করেছিলেন।'

১৯৯৪ সালের লিগে মোহামেডান–পিডব্লুডি ম্যাচে সাব্বিরকে স্ট্রেচারে করে মাঠের বাইরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন সে সময় মোহামেডানের ম্যানেজার বাদল রায়। স্ট্রেচারের একপ্রান্ত ধরে রেখেছেন সাব্বিরের মোহামেডান–সতীর্থ বিপ্লব মারমা। ছবি: সংগৃহীত

ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়টাই কাটিয়েছেন মোহামেডানে। দলের মধ্যমণি হয়ে। ১৯৮৭ সালে ধানমন্ডি ক্লাব (আজকের শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব) থেকে মোহামেডানে যোগ দেওয়ার পর আর পেছনে ফিরে তাঁকাতে হয়নি। কিন্তু ক্যারিয়ারের শেষটা তাঁর ভালো হয়নি। অনেকটা অভিমান করেই অবসরে চলে যান। তবে এখন আর কোনো অভিযোগ কারও বিরুদ্ধেই নেই সাব্বিরের, 'চোটের পর ১৯৯৬ সালে মাঠে ফিরে আমার মনে হয়, আমি খুব ভালো খেলেছিলাম। মোহামেডান দুই মৌসুম পর সেবার লিগ জিতেছিল। এশিয়ান কাপ উইনার্স কাপে লাওসের ইলেকট্রিসিটি ক্লাবকে আমরা ৮–০ গোলে হারিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল ক্যারিয়ারটা দীর্ঘ করতে পারব। কিন্তু সেটি হয়নি। ১৯৯৭ সালের দিকে নিয়মিত মাঠে নামার সুযোগ পাইনি। কেন বলতে পারব না, হয়তো সে সময় ক্লাব অফিশিয়ালদের অন্য কোনো ভাবনা ছিল। কিছুটা বিরক্ত হয়েই অবসরের ঘোষণা দিই। কারও বিরুদ্ধেই এখন আর আমার কোনো অভিযোগ নেই।'


লাখো মানুষের ভালোবাসা নিত্য সঙ্গী হয়ে ছিল তাঁর ক্যারিয়ারে। সে সব দিনগুলো আজও ভুলতে পারেন না, 'আমি বহুদিন ঈদের বাজার করতে শপিং মলে যেতে পারিনি। স্ত্রী অভিযোগ করত, “তোমাকে নিয়ে তো কোথাও যাওয়া যায় না।” মোহাম্মদপুরে আমার বাসার সামনে সারাক্ষণ ভিড় লেগে থাকত। মাঠে নামার সময় দর্শকদের সেই তালির আওয়াজ আমি কখনো ভুলতে পারি না।'


এত কিছুর পরেও সাব্বিরের আক্ষেপ একটাই—দেশকে আন্তর্জাতিক সাফল্য উপহার দিতে না পারা। আজ ক্রিকেটের উত্থান দেখে সেই আক্ষেপটাই পোড়ায় তাঁকে, 'দেশকে সাফল্য দিতে না পারার আফসোসটা সারাজীবন থাকবে। কীসের কমতি ছিল আমাদের! ভালো মানের ফুটবলারের অভাব ছিল না, কিন্তু আমরা সে সময় সাফ গেমসের মতো একটা প্রতিযোগিতায় সোনা জিততে পারিনি। ব্যর্থ হয়েছি বারবার। সাফে সোনা প্রথম দিকেই জিতলে দেশের ফুটবলের ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো। জাতীয় দল নিয়ে সে সময় গরজটাও কম ছিল বাফুফের—এটা অবশ্যই বলব। ভবিষ্যতের কথা কখনোই ভাবা হয়নি। ভরা জোয়ারের মধ্যেও যে এক সময় ভাটা আসে, সেটাই ফুটবল সংগঠকেরা ভুলে গিয়েছিলেন। তারই ফল এখন ফুটবল পাচ্ছে। ক্রিকেট সাফল্য দিচ্ছে, তাই এটি নিয়ে মানুষ মাতামাতি করে। খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার।'


সাফল্য না পাওয়ার পেছনে দুর্ভাগ্যকেও দায়ী করেন সাব্বির। তাঁর মতে, সে দুর্ভাগ্যগুলো এমনই যার কোনো ব্যাখ্যা তিনি দিতে পারবেন না, 'এই প্রজন্মকে সেগুলো আসলে বলে বোঝানো যাবে না। '৮৫ সাফে টাইব্রেকারে হেরে গেলাম। ৮৭'তে প্রতিপক্ষের হাফে খেলছি, আক্রমণের পর আক্রমণ, একের পর এক গোল মিস করছি। কাউন্টার অ্যাটাকে গোল খেয়ে গেলাম। '৮৯ সাফে মোনেম মুন্নার মতো ডিফেন্ডারের সঙ্গে গোলরক্ষক কাননের (সাঈদ হাসান কানন) এমন ভুল বোঝাবুঝি হলো, সেটা ব্যাখ্যাতীত। মুন্না আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আল্লাহ তাঁকে জান্নাতবাসী করুক। সেও হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। কানন তো এখনো সেই ভুলটার কথা বলে। '৯১ সালে ভারতকে হারালাম আমরা। প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের বিপক্ষে আবারও ভুলের খেসারত। অফ সাইড ট্র্যাপ দিতে গিয়ে গোল খেয়ে যাই। আসলে এসব বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য, এই প্রজন্মকে সেই ম্যাচগুলো দেখাতে পারি না আমরা, কোনো রেকর্ড নেই। তারা দেখলে বুঝত।'


দেশের জার্সিতে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত খেলেছেন সাব্বির। মোট ৩৪টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ। এর আগে বয়সভিত্তিক ফুটবলেও খেলেছেন। অনূর্ধ্ব–১৬, ১৯, ২৩। অনূর্ধ্ব–১৯ ও ২৩ দলের অধিনায়কত্ব করেছেন। আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে নিজের একটি পেনাল্টি মিসের ঘটনা তাঁকে এখনো পোড়ায়, '১৯৮৯ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ইরানের বিপক্ষে হোম ম্যাচ। সাত মিনিটের মাথায় পেনাল্টি পেয়ে গেলাম। ইরানের গোলরক্ষক তখন আহমেদ রেজা আবেদ জাদেহ। ১৯৯৮ বিশ্বকাপ খেলেছিল। পেনাল্টিটা বারে মারলাম। সে ম্যাচে আমরা হেরে গিয়েছিলাম ২–১ গোলে। আসলাম ভাই বাংলাদেশের পক্ষে গোল করেছিলেন। এখনো ভাবি, ওই পেনাল্টিটা কাজে লাগাতে পারলে ইতিহাসটা অন্যরকম হতো।'


১৯৮৯ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেই ঢাকায় থাইল্যান্ডের বিপক্ষে মধ্যমাঠ থেকে বল নিয়ে চারজনকে কাটিয়ে 'ম্যারাডোনা স্টাইলে' গোল আছে তাঁর। সে কথা মনে করিয়ে দিতেই সাব্বিরের আবার আক্ষেপ, 'কই ওই ম্যাচের ভিডিও কি এই জেনারেশনকে দেখানো হয়েছে কখনো? আমার ছেলেও তো দেখেনি সেটি। কোনো রেকর্ড রাখা হয়নি। সেদিন বলটা ধরে কী মনে করেই যেন থাইল্যান্ডের বক্সের দিকে দৌড় শুরু করেছিলাম। একে একে চারজনকে কাটালাম। গোলরক্ষকের বাম দিক দিয়ে জালে ঠেলে দিলাম। কিন্তু এসব বলে লাভ কি, কাউকে তো দেখাতে পারছি না, সেই গোলটা!'


সাব্বিরের আক্ষেপ, যেন দেশের ফুটবলেরই আক্ষেপ। কীভাবে যেন আমরা হারিয়ে ফেললাম দারুণ একটা জিনিস! ২৬ বছর আগে সাব্বিরের চোটের গল্পটাই তো সেই রোমাঞ্চকর দিনগুলোকে মনে করিয়ে দেয় !