Thank you for trying Sticky AMP!!

শেখ কামাল বলতেন, 'ভাইডি বেশি দূর যাইয়ো না'

আজ বিদায় নিয়েছেন সাবেক ফুটবলার গোলাম রব্বানী হেলাল। ফাইল ছবি

কিশোর বয়সেই আবাহনীতে খেলতে এসেছিলেন গোলাম রাব্বানী হেলাল। জীবদ্দশায় এই প্রতিবেদককে বলেছিলেন, 'আমার বয়স তখন সাড়ে চৌদ্দ থেকে পনেরো হতে পারে সর্বোচ্চ।' সেটি ছিল চুয়াত্তরের নভেম্বর মাস। কৈশোরের শেষ ধাপ পেরিয়ে তারুণ্যে পা রাখার অপেক্ষায় হেলাল। তারপর দীর্ঘ ভ্রমণ। বাংলাদেশের ফুটবল আলো কাড়া। তবে সব আলো ছেড়ে আজ তিনি চলে গেলেন না ফেরার দেশে। বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে মত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন বাংলাদেশের ফুটবলে সত্তর-আশির দশকের এই তারকা।

মস্তিস্কে রক্তক্ষরণে তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় গত ২৮ মে। তখনই ডাক্তাররা বলে দিয়েছিলেন, 'বাঁচার সম্ভাবনা প্রায় শুন্য।' কারণ এত রক্তক্ষরণ হয়েছে যে অস্ত্রোপচার সম্ভব নয়। শেষ পর্যন্ত আর ফিরে এলেন না হেলাল। যাঁর কথা এলেই ভেসে ওঠে ১৯৮২ সালে বাংলাদেশের ফুটবলে সেই জেল-অধ্যায়। লিগে আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচে গোলমালের সূত্র ধরে তৎকালীন ফেডারেশন কর্মকর্তাদের ইন্ধনে পুলিশ ধরে নিয়ে যায় আবাহনীর ৯-১০জন ফুটবলারকে। জেলে পাঠানো হলো কাজী সালাউদ্দিন, আশরাফ উদ্দিন চুন্নু, কাজী আনোয়ার ও গোলাম রাব্বানী হেলালকে। আজ হেলালের চির বিদায়ে জেল-সঙ্গী হারালেন বাকি ৩জন।

পঁচাত্তর থেকে আবাহনীতে খেলা শুরু হেলালের। তখন এতই নবীন ছিলেন যে, আবাহনীর ক্লাবের গেটের বাইরে যাওয়া ছিল বারণ। হেলাল সেই স্মতি নিয়ে বলেছিলেন, 'তখন সন্ধ্যার সময় শেখ কামালসহ হারুনুর রশিদ ভাইয়েরা আবাহনী ক্লাব লনে বসে আড্ডা মারতেন। আমি বাইরে গেলে শেখ কামাল বলতেন, ''ভাইডি বেশি দূর যাইয়ো না। হারিয়ে যাবা। এত আন্তরিকভাবে বলতেন যে কথাটা মনে গেঁধে রয়েছে।'''


বরিশাল থেকে উঠে এসেছেন। তাই তাঁকে মজা করে 'ভাইডি' ডাকতেন শেখ কামাল। যিনি তরুণদের খুব ভালোবাসতেন।

টুটুল, চুন্নু, হেলালদের ঘিরে তখন তারুণ্য খেলা করত আবাহনী-আঙিনায়। টুটুল-হেলাল ছিলেন সমবয়সী। চুন্নু এক-দুই বছরের বড়। তখনকার দিনে আবাহনীতে কিছুদিন খেলেন বর্তমানে গোলকিপিং কোচ বরিশালের মেহেদি হাসান বাবুল। বরিশাল থেকে তিনিই হেলালকে এনেছেন আবাহনীতে। সেই বাবলু প্রিয় বন্ধুকে হারিয়ে আজ শোক স্তব্ধ, 'হেলালের মতো মানুষ কমই দেখিছ। এত দিলখোলা ছিল যে ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না। আমি কত বড় বন্ধুকে হারলাম সে শুধু আমিই জানি।'


১৯৭৫-১৯৮৮ পর্যন্ত খেলোয়াড় হিসেবে আবাহনীতে ছিলেন হেলাল। খেলা ছেড়ে আবাহনীর পরিচালক, ম্যানেজার কত ভুমিকায় দেখা গেছে তাঁকে! ম্যানেজার থাকার সময় দলবদলে অনেক ফুটবলারকে 'হাইজ্যাক' করে নিয়ে রাখতেন নিজের বাসায়। ধানমন্ডিতে আবাহনী ক্লাবের পাশেই ছিল তাঁর বাসা। মোহামেডান থেকে একবার মোস্তফা কামালকে হাইজ্যাক করেন। সেটা নিয়ে কত গল্প! সাবেক লেফট ব্যাক মাসুদ রানা বলছিলেন, 'দলবদলের লুকোচুরি খেলায় হেলাল ভাইয়ে বাসায় কত সিনেমা দেখেছি হিসাব নেই!'হেলাল শুধু ফুটবলার নন, সংগঠক হিসেবেও এ দেশের ফুটবল উন্নয়নে কাজ করেছেন। ছিলেন বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের সদস্যও।


ষাটোর্ধ্ব এই জীবনে তাঁকে মানুষ আবাহনীর হেলাল' নামেই চেনে। তবে মাঝখানে একবার ছন্দপতন হয়েছিল 'সামান্য' একটা কারণে। সেটা ১৯৮১ সালে। নিজেই বলেছিলেন, 'একাশিতে আমি আর টুটুল অন্য একটা ক্লাবে চলে গেলাম। ক্লাব সবাইকে টাকা দেয়। কিন্তু আমাকে আর টুটুলকে দেয় না। আমরা দুজনই সবচেয়ে কম টাকা পেয়েছি। ক্লাব মনে করে আমরা নিজেদের লোক। টাকার কী দরকার? অথবা টাকা দিতে তাড়াহুড়ো করার কী আছে। পরে দিলেই হবে ইত্যাদি। আমাদের চাহিদাও ছিল অনেক কম। তাই কিছুদিনের জন্য দল ছাড়লাম। আমি বিজেএমসিতে, টুটুল ব্রাদার্সে। মাস দু-এক ছিলাম ওই দলে।'

খেলোয়াড় জীবনের ছবি। সামনে (বাঁয়ে) হেলাল, পেছনে সালাউদ্দিন। সংগৃহীত ছবি

মজার ব্যাপার, বিজেএমসিতে খেলার ওই সময়টাও আবাহনীর ক্লাবে খেতেন-ঘুমাতেন হেলাল। শুধু অনুশীলন করতেন বিজেএমসিতে। মৌসুম শুরুর আগের দিন গেলেন বিজেএমসি ক্লাবে। ওই বছর বিজেএমসি থেকে এক লাখ ৩০ হাজার টাকা পেয়েছেন। সেই টাকা নিয়েও আছে একটা গল্প। হেলাল বলেছিলেন, 'ওই এক লাখ ৩০ হাজার মধ্যে এক লাখ টাকা হারুন ভাই আমার কাছ থেকে নিয়ে গেছেন আবাহনী টিম বানাতে। হারুন ভাই টাকা চেয়েছেন। আমি জিজ্ঞেস করলাম কেন? উনি বললেন, 'তুমি টাকা দিয়ে কী করবা? বুঝুন অবস্থা, একজন খেলোয়াড়ের ওপর ক্লাব কর্মকর্তার অধিকার কতটা থাকলে এমন কথা বলতে পারেন!'


সত্তর দশকে আবাহনী ক্লাব খেপ খেলতে পাঠাত একসঙ্গে দলের ১১ জনকেই। ৫০০ টাকা করে পড়ত খেলোয়াড়দের ভাগে, তা থেকে ক্লাব পেত ২০০ টাকা। বলেছিলেন হেলাল। যোগ করেন, 'আমরা আবাহনীর প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম শেখ কামালের স্মৃতিকে সম্মান জানাতে। নইলে আবাহনী পাড়ার ক্লাব হতে পারত। শেখ কামালের ক্লাব বলেই রয়ে গেলাম। ছিয়াত্তরে কোনো খেলোয়াড়ের চুক্তি ছিল না। হারুন ভাই খেলোয়াড়দের বলেছিলেন, চাঁদা তুলতে পারলে টাকা পাবে তোমরা।'


সেই দুঃসময় পেরিয়ে আবাহনী উঠে দাঁড়ায় স্বমহিমায়। তাতে হেলালের অবদান কখনো ভোলার নয়। খেলোয়াড় হিসেবে তিনি রক্ষণ, মাঝমাঠ, আক্রমণ সব বিভাগেই খেলেন। তাঁর একটা ব্যাকভলি আজও মনে রেখেছেন এক সংগঠক। বলছিলেন, 'ওটা গোল হলে আমার দেখা অন্যতম সেরা গোল হতো।' বলটা আটকে দিয়েছিলেন গোলরক্ষক শহিদুর রহমান সান্টু। ১৯৭৯ লিগে ওয়ারীর কাছে দুবার হেরেছিল আবাহনী। পরের লিগেই সেই ওয়ারীর বিপক্ষে হ্যাটট্রিক করেছিলেন হেলাল। ১৯৭৯-১৯৮৫ সাল পর্যন্ত খেলেন জাতীয় দলে। তাঁর থ্রু পাস ছিল দারুণ।


আসলে তাঁর সবই ছিল দেখার মতো। রুচিশীল, পরিপাটি মানুষ। বিশ্বকাপ ফুটবলের ম্যাচ দেখার নেশা ছিল। চলাফেরা করতেন উচু স্তরের মানুষদের সঙ্গে। থাইল্যান্ড ফুটবল ও এএফসির অন্যতম সাবেক শীর্ষ কর্মকর্তা ওয়াউরি মাকুদি ছিলেন তাঁর বন্ধু। হেলাল এবার হাসপাতালে ভর্তি হলে মাকুদি বলেছিলেন, কোনভাবে থাইল্যান্ড পর্যন্ত পাঠিয়ে দিতে। বাকিটা তিনি দেখবেন। সেই সুযোগটা দিলেন না হেলাল। চলেই গেলেন সবাইকে কাঁদিয়ে।

তাঁর একটাই সমস্যা ছিল। শরীরের প্রতি অযত্ন। সেটিরই চূড়ান্ত খেসারত দিয়ে এভাবে চলে যাওয়া! পাশে পরিবারও ছিল না। এটাই বড় দুঃখ।