Thank you for trying Sticky AMP!!

‘স্যারদের বলেছিলাম আরেকটু খেলার সুযোগ দিতে’

খেলোয়াড়েরা লড়ছেন বাছাইয়ে টেকার জন্য।

সাইফুল ইসলাম ও হাফিজুর রহমান দুই বন্ধু। পটুয়াখালী থেকে পরশু সন্ধ্যায় লঞ্চে উঠে গতকাল ভোরে নামে সদরঘাটে। এরপর সোজা কমলাপুর বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামে।

ভিড়ে ভরা লঞ্চে একটুও ঘুমাতে পারেনি সারা রাত। ঢুলুঢুলু চোখে এসে সকালে নেমে পড়ে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) আয়োজিত প্রতিভা অন্বেষণের ট্রায়ালে। স্বাভাবিকভাবেই সামর্থ্যের সবটুকু ঝলক দেখাতে পারেনি এই দুই খুদে ফুটবলার। বাছাইপর্ব শেষে তাই ‘ইয়েস কার্ড’ আর পাওয়া হয়নি দুজনের।

ট্রায়াল শেষে স্টেডিয়ামের পুব দিকের গাছের ছায়ায় মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে ছিল দুই ফুটবলার। সাইফুলের বাবা জুয়েল গাজী পটুয়াখালী শহরের অটোরিকশাচালক। বাবা ফুটবল পছন্দ করেন না। তবু ফুটবলকে ভালোবেসে নিয়মিত শহরের একটা ফুটবল একাডেমিতে অনুশীলন করে সাইফুল। বিভাগীয় পর্যায়ের বাছাইয়ে টিকলে তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ঢাকায়।

কিন্তু বাদ পড়ার পর হতাশ সাইফুল বলছিল, ‘জার্নি করে ঢাকায় এসে কীভাবে খেলব? লঞ্চে একটুও ঘুমাতে পারিনি। ঢাকায় এসে কোথায় থাকব, কোনো আত্মীয়স্বজন নেই। তাই সোজা স্টেডিয়ামে চলে আসি। ক্লান্তির কারণেই স্যারদের সামনে ভালো খেলতে পারলাম না।’

বাফুফের ‘ভিশন ২০২২’ প্রকল্পের আওতায় চলছে বয়সভিত্তিক ফুটবলারদের বাছাইপর্ব। এ বছর সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ টুর্নামেন্টের পাশাপাশি আগামী বছরের অনূর্ধ্ব-১৬ এবং এএফসি অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্টের জন্যই মূলত এই ফুটবলারদের বাছাই করার উদ্যোগ বাফুফের।

সারা দেশের আট বিভাগ থেকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা ফুটবলারদের নিয়ে ঢাকায় হচ্ছে এই চূড়ান্ত বাছাই। গতকাল হয়েছে রংপুর, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের বাছাই। আজ ঢাকা, খুলনা ও সিলেট বিভাগের ফুটবলারদের বাছাই করা হবে। আগামীকাল শেষ দিনে ময়মনসিংহ, রাজশাহী ও বাফুফের বিভিন্ন বয়সভিত্তিক ক্যাম্পে থাকা ফুটবলারদের বাছাই চলবে। পুরো বাছাইপ্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করছেন জাতীয় দলের প্রধান কোচ জেমি ডে।

বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন এসেছেন বাছাইয়ের কার্যক্রম দেখতে।

আগামীর ফুটবলার গড়তে এদের জেমির হাত ধরে তুলে আনতে চায় বাফুফে। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় বাছাইটা হচ্ছে, তাতে প্রশ্ন থেকেই যায়। অনেকে জেলা পর্যায়ে খুব ভালো খেলেও ঢাকায় এসে প্রতিভার ঝলক সেভাবে দেখাতে পারছে না।

কাল যেমন তিন বিভাগের ৭৮ জন ফুটবলারকে কয়েক দফায় খেলানো হলো। ফুটবলারদের দুই গ্রুপে ভাগ করে ম্যাচ খেলিয়েছেন বাফুফের কোচরা। এই অল্প সময়ে অনেকে নিজেদের সহজাত প্রতিভা দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে না। এর ওপর ভ্রমণক্লান্তি তো আছেই। চোখে ঘুম নিয়ে কতই–বা ফুটবল খেলা যায়!

দিনাজপুর থেকে এসেছে মিডফিল্ডার শীতল সেবাস্তিয়ান। বাবা সুশীল সেবাস্তিয়ান শহরের একটি প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তাপ্রহরী। শীতল আরও দুই বন্ধুকে নিয়ে দিনাজপুর থেকে পরশু রাতে বাসে এসেছে ঢাকায়। কোথাও থাকার জায়গা নেই বলে ৭০০ টাকা দিয়ে তিন বন্ধু ফকিরাপুল পানির ট্যাংকের পাশে একটি নিম্নমানের হোটেলে রাত কাটিয়েছে। কিন্তু ভ্রমণক্লান্তি লেগে ছিল তিনজনের চোখেই; যদিও শীতল ইয়েস কার্ড পেয়েছে শেষ পর্যন্ত।

উচ্ছ্বসিত শীতল বলছিল, ‘আমি শেষ পর্যন্ত টিকে গেছি। আমার ঢাকায় আসা সার্থক হয়েছে। বাবা অনেক কষ্ট করে আমাকে বাসভাড়া জোগাড় করে দিয়েছেন। জার্নি করে এসে ঠিকমতো খেলতে পারছিলাম না। কিন্তু তারপরও যেটুকু খেলেছি, তাতে খুশি।’

একঝাঁক তরুণ ফুটবলার।

রাঙামাটি থেকে এসেছে কিশোর শিবোলি চাকমা। পরশু রাতে বাসে উঠে ভোররাত চারটায় নামে কমলাপুর বাসস্ট্যান্ডে। এরপর বাকি রাত কমলাপুর স্টেশনে বসে কাটিয়েছে। ভোরে চলে আসে স্টেডিয়ামে। শিবোলির ভাগ্যে ইয়েস কার্ড জোটেনি।

হতাশ শিবোলি বলছিল, ‘রাতে ঘুমাতে পারিনি। এক দিন আগে এসে যে ঢাকায় থাকব, সে উপায় নেই। থাকার কোনো জায়গা নেই আমার। আমার বড় বোন ছাত্রী হোস্টেলে থাকে। ওখানে তো ওঠা যাবে না। ক্লান্তি নিয়ে খেলেছি অল্প সময়। স্যারদের বলেছিলাম আরেকটু খেলার সুযোগ দিতে। কিন্তু স্যারেরা বলেছেন, যা খেলেছ, তাতেই হয়েছে। তুমি এবার মাঠ থেকে বের হয়ে যাও।’

কক্সবাজারের কিশোর গোলকিপার মং ক্লা প্রচণ্ড হতাশ। ভোরবেলা বাস থেকে নেমে সোজা স্টেডিয়ামের গেটে চলে আসে মং। গেট খুলতেই দোতলার একটা চেয়ারে বসে একটু বিশ্রামের চেষ্টা করে। কিন্তু ওইটুকু বিশ্রামে কি মাঠে ভালো খেলা সম্ভব? মং বলছিল, ‘মাঠে নামার পর ক্লান্ত লাগছিল। এত কষ্ট করে এসেছি, তারপরও যদি আরেকটু বেশি সময় খেলার সুযোগ দিত, তাহলে ভালো হতো।’

পটুয়াখালীর দুই ফুটবলার হাফিজুর রহমান (বায়ে) ও সাইফুল ইসলাম ।

বাফুফের ফুটবলার বাছাইয়ের এমন প্রক্রিয়া এবারই প্রথম নয়। এভাবে একজন ফুটবলারকে পুরোটা যাচাইয়ের সুযোগ খুব কমই থাকে। দূরদূরান্ত থেকে যেসব ফুটবলার ঢাকায় খেলার স্বপ্ন নিয়ে আসে, এভাবে বাছাইয়ের পর তাদের ফুটবল উৎসাহেও ভাটা পড়ে অনেক সময়। মন থেকে মুছে যেতে পারে ফুটবলার হওয়ার ইচ্ছা।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাফুফের ডেভেলপমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান ও সহসভাপতি আতাউর রহমান বলেন, ‘ওরা ভ্রমণক্লান্তি নিয়ে এখানে খেলতে এসেছে এবং এভাবে ভালো খেলা সম্ভব না, সে ব্যাপারে আমিও একমত। আমি কোনো ফুটবলারের অভিভাবক হলে এটাই বলতাম। এভাবে ক্লান্তি নিয়ে ৫ থেকে ১০ মিনিট খেলে ভালো কিছু দেখানো সম্ভব না। কিন্তু আমাদের বাস্তবতাও বুঝতে হবে।’

বাস্তবতাটা কী? আতাউর রহমান সেটির ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করলেন, ‘কাল যে ৭৫ জনকে কোচ দেখেছেন, সবাইকে রাখতে পারলে খুশি হতাম। কিন্তু বাফুফেতে আর্থিক সংকট আছে। এখানে সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। তাই মোটামুটি ভালোমানের যারা, তাদের অগ্রাধিকার দিয়ে কোচ বাছাই করেছেন। এদের আবাসনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আমাদেরই দেখতে হবে। তবে ভবিষ্যতে আরও ভালোভাবে যাতে বাছাইপ্রক্রিয়াটা সময় নিয়ে করা যায়, সেটাও আমাদের বিবেচনায় আছে।’