হিদালগো চিরদিন থাকবেন প্লাতিনিদের হৃদয়ে
>হারিয়ে যাওয়া ফ্রান্সকে আবার ফুটবল মানচিত্রে ফিরিয়েছেন মিশেল হিদালগো। ৮৭ বছর বয়সে মারা গেছেন এই ফরাসি কোচ
রক্ষণের তোয়াক্কা তিনি কখনোই করেননি। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডার। কোচিং জীবনেও দলের খেলোয়াড়দের শুধু একটি কথাই বলে গেছেন টিপু সুলতানের মতো—আক্রমণ!
খেলোয়াড়ি বা কোচিং জীবনে যেমন গোলবার আগলে রাখার কথা ভাবেননি, জীবন নিয়েও তাঁর দর্শনটা অনেকটা সে রকমই ছিল। শেষ জীবনে এসে রোগ-ব্যাধি বাসা বেঁধেছিল শরীরে। কিন্তু তিনি তোয়াক্কা করেননি জীবন বাঁচানোর। শেষ পর্যন্ত হাসিখুশি থেকে গেছেন। এই তো সপ্তাহ কয়েক আগে ফ্রান্সের ১৯৮৪ ইউরো জয়ী কোচ মিশেল হিদালগোর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন মিশেল প্লাতিনিসহ তাঁর সাবেক শিষ্যদের অনেকেই। রোগে আক্রান্ত হিদালগো হাসিখুশিতে ভরা সময় কাটিয়েছেন তাঁদের সঙ্গে।
এভাবে হাসতে হাসতেই গত পরশু মার্শেইয়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেছেন হিদালগো। পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে অবিনশ্বরের পথে যাত্রাকালে প্লাতিনিদের গুরুর বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। ১৪ বছরের পেশাদার খেলোয়াড়ি জীবনে খেলেছেন মাত্র তিনটি ক্লাবের হয়ে—লা হাভরে, রাঁস ও মোনাকো। অর্জন বলতে তিনটি লিগ শিরোপা আর একবার ইউরোপিয়ান কাপের রানার্সআপ। রাঁসের হয়ে ১৯৫৬ সালে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ৪-৩ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচে গোল পেয়েছিলেন হিদালগো।
অনেক বছর ধরেই ভালো ফুটবল উপহার দিলেও কোনো শিরোপা জিততে পারছিল না ফ্রান্স। সাফল্য-বুভুক্ষু দেশটির ফেডারেশন তাই দলের দায়িত্ব তুলে দেন হিদালগোর হাতে। ১৯৭৬ সালে দায়িত্ব পেয়ে দলটিকে নিজের মতো করে সাজান হিদালগো। মাঝমাঠে তিনি গড়ে তোলেন ‘জাদুকরী চতুষ্টয়’। যে চতুষ্টয়ের নেতা ছিলেন প্লাতিনি। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আলাইন জিরেসে, জিন তিগানা ও বানার্ড জেংহিনি।
চারজনের কানেই হিদালগো দিয়েছিলেন সুন্দর ফুটবল আর আক্রমণের মন্ত্র। আর দিয়েছিলেন লাগামহীন স্বাধীনতা। এই চতুষ্টয়ের সামনে তিনজন ফরোয়ার্ড। এভাবেই দল সাজাতেন হিদালগো। আর এভাবে আক্রমণাত্মক আর সুন্দর ফুটবলের মন্ত্রে উজ্জীবিত ফ্রান্স হিদালগোর অধীনে উঠেছিল ১৯৮২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে আর জিতেছিল ১৯৮৪ ইউরো।
১৯৫৮ বিশ্বকাপের পর ১৯৮২ সালেই প্রথম বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলে ফ্রান্স। অসাধারণ ফুটবল খেলে ১২০ মিনিটের খেলা শেষে পশ্চিম জার্মানির সঙ্গে ৩-৩ গোলে ড্র করে ফ্রান্স। এরপর টাইব্রেকারে ৫-৪ গোলে হারে তারা। ১৯৬০ থেকে ১৯৮০—এই কয় বছর ইউরোর বাছাইপর্ব উতরাতে না পারা ফ্রান্স ১৯৮৪ সালে হয়ে গেল চ্যাম্পিয়ন। এরপর ২০০০ সালেও ইউরোর শিরোপা জিতেছে ফ্রান্স, রানার্সআপ হয়েছে ২০১৬ সালে। ১৯৮২ সালের পর জিতেছে দুটি বিশ্বকাপ। কিন্তু হারিয়ে যাওয়া ফ্রান্সকে আবার ফুটবল মানচিত্রে ফিরিয়ে এনেছিলেন হিদালগোই।
সেই সময়ের কথা স্মরণ করে প্লাতিনি হিদালগোকে নিয়ে বলেছেন, ‘মিচেলই ফ্রান্সকে জাগিয়ে তুলেছিলেন। ফিরিয়ে দিয়েছিলেন আমাদের শিল্পিত ফুটবল। সুন্দর ফুটবল খেলাটাকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি। আর আমাদের সবাইকে দিয়েছিলেন নিজেকে মেলে ধরার স্বাধীনতা। তিনি মাঠে আমাকে ফুল হয়ে ফুটতে সাহায্য করেছেন। আজ মানুষ যে আমাকে যেমন খেলোয়াড় হিসেবে মনে রেখেছে এর পুরোটাই তাঁর অবদান।’
শুধু একজন ফুটবল গুরু হিসেবেই নন, প্লাতিনির কাছে মিচেল হিদালগো ছিলেন তার চেয়েও বেশি কিছু, ‘তাঁকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত যে স্মৃতি সেটা হচ্ছে তিনি অতিশয় একজন ভদ্রলোক, একজন অসাধারণ শিক্ষক এবং সর্বোপরি মানবতাবাদী একজন মানুষ। মিচেল হিদালগো চিরদিন আমার হৃদয়ে অমলিন থাকবেন।’
ফরাসি পত্রিকা লেকিপে জেংহিনি তুলে ধরেছেন হিদালগোর ফুটবল-দর্শন, ‘তিনি তিনজন নম্বর টেন রেখেছিলেন দলে—প্লাতিনি, জিরেসে ও আমাকে। এর সামনে থাকত তিনজন ফরোয়ার্ড। আমাদের ঝুঁকি নিতে হতো আর এটা তিনি থোড়াই পাত্তা দিতেন।’ ফ্রান্সের মহান এই কোচ ৭৫টি ম্যাচে দলের ডাগআউটে ছিলেন। রেমন্ড ডমেনেখ ও বর্তমান কোচ দিদিয়ের দেশম ছাড়া এর চেয়ে বেশি ম্যাচে ফ্রান্সকে কেউ কোচিং করাননি।
এমন একজন কোচের বিদায়ে শোকাহত পুরো ফ্রান্সের ফুটবল। ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি নোয়েল লা গ্রাত বলেছেন, ‘আমরা দুঃখে ভেসে যাচ্ছি। পুরো ফেডারেশন গুমরে কাঁদছে।’ শুধু ফ্রান্স ফুটবল ফেডারেশন কেন, এমন একজন কোচের বিদায়ে আসলে গুমরে কাঁদছে পুরো ফুটবলবিশ্বই।